নূতন যারা শ্যামাকে দেখিল তারা কিছু বুঝিতে পারে না, আগে যারা তাহাকে দেখিয়াছে। তারাই শুধু টের পায় বনগাঁ তাহাকে কি ভাবে বদলাইয়া দিয়াছে।
আবার শীত শেষ হইয়া আসিল। ফাল্গুন মাসে একটি কন্যা জন্মিল শ্যামার। বকুল বুঝি আবার শুরু হইল গোড়া হইতে। কিন্তু বকুলের কি সুন্দর দুটি ডাগর চোখ ছিল। এ মেয়ের চোখ কোথায়? হায়, শ্যামার মেয়ে জন্মিয়াছে অন্ধ হইয়া। গর্ভের অনাদিকালের অন্ধকার তাকে ঘিরিয়া রহিল, এ জগতের আলো সে চিনিবে না কোনোদিন।
জন্মান্ধ? কার পাপের ফল ভোগ করিতে তুই পৃথিবীতে আসিলি খুকি! দৃষ্টি তোর হরণ করিল কে? ভাবিতে ভাবিতে শ্যামা স্মরণ করে, বনগাঁয় একদিন সন্ধ্যার সময় কলাবাগানে ছায়ার মতো কি যেন দেখিয়া তার গা ছম্ছ করিয়াছিল, স্নানের আগে এলোচুলে তেল মাখিবার সময় আর একদিন পাগলা হাবুর বুড়ি দিদিমা তাহাকে দেখিয়া ফেলিয়াছিল, অজ্ঞাতসারে আরো কবে কি ঘটিয়াছিল কে জানে!
কি আর করা যায়, অন্ধ মেয়েকে শ্যামা সমান আদরেই মানুষ করে, যেমন সে করিয়াছিল বকুলকে, যার ডাগর দুটি চোখ শ্যামাকে অবিরত অবাক করিয়া রাখিত। দু মাস বয়স হইতে না হইতে শীতল মেয়েকে বড় ভালবাসিল! বিধান একটা ঠাকুর আনিয়াছিল, তাহাকে ছাড়াইয়া দিয়া শ্যামা আবার রান্না আরম্ভ করিলে মেয়ে কোলে করিয়া বসিয়া থাকার কাজটা পাইয়া শীতল ভারি খুশি। এখানে আসিয়া বনগাঁর পোষা কুকুরটির জন্য শীতলের মন কেমন করিত, খুকিকে কোলে পাইয়া কুকুরের শোক সে ভুলিয়া গেল। শীতলের বা পায়ের বেদনাটা আবার চাড়া দিয়া উঠিয়াছে। এ জন্য দোষী করে সে শ্যামাকে। শ্যামার জন্যই তো চাকরি করিতে দুর্বল পা লইয়া দুবেলা তাহাকে হাঁটাহাঁটি করিতে হইত বনগাঁয়!
অবসর সময়টা শ্যামা তার পায়ে তৰ্পিন তেল মালিশ করিয়া দেয়। অসুস্থ স্বামীকে চাকরি করিতে পাঠাইয়া অপরাধ যদি তার হইয়া থাকে, এ তার অযোগ্য প্ৰায়শ্চিত্ত নয়।
মোহিনী কলিকাতায় চাকরি করে কিন্তু শ্বশুরবাড়ি বেশি সে আসে না, বোধহয় পিসির বারণ আছে। শ্যামা তাকে দুদিন নিমন্ত্ৰণ করিয়াছিল, দুদিন আসিয়া সে খাইয়া গিয়াছে, নিজে হইতে একদিনও খোঁজখবর নেয় নাই। বিধান প্রথম প্রথম কাকার বাড়ি গিয়া মোহিনীর সঙ্গে সর্বদা দেখা সাক্ষাৎ করিত এখন সেও আর যায় না। রাগ করিয়া শ্যামাকে সে বলে, এমনি লাজুক হলে কি হবে, মোহিনী বড় অহঙ্কারী মা–কতবার গিয়েছি আমি, কত বলেছি আসতে, এল একবার? নেমন্তন্ন না করলে বাবুর আসা হয় না, ভারি জামাই আমার!–এদিকে তো মাছিমারা কেরানি পোস্টাপিসের!
কিন্তু মোহনী একদিন বিনা আহ্বানেই আসিল। লজ্জায় মুখ রাঙা করিয়া বিধানের কাছে সে স্বীকার করিল যে বকুলের চিঠি পাইয়া সে আসিয়াছে। বকুলকে এখন একবার আনা দরকার। পনের দিনের ছুটি লইয়া সে বাড়ি যাইতেছে, ইতিমধ্যে শ্যামা যদি তাহার পিসিকে একখানা চিঠি লিখিয়া দেয় আর চিঠির জবাব আসার আগেই বিধান যদি সেখানে গিয়া পড়ে, বকুলকে পাঠানোর একটা ব্যবস্থা মোহিনী তবে করিতে পারে।
মোহিনীর কথাবার্তা বিধানের কাছে হেঁয়ালির মতো লাগে, সে বলে, বোসো তুমি, মাকে বলি।
মোহিনী বলে, না না, আমি গেলে বলবেন।
কিন্তু তা হয় না, শ্যামাকে না বলিলে এসব সাংসারিক ঘোরপ্যাচ কে বুঝিতে পারিবে?
বিধান শ্যামাকে সব শোনায়। শুনিবামাত্র ব্যাপার আঁচ করিয়া শান্ত নির্বাক শ্যামার সহসা আজ দেখা দেয় অসাধারণ ব্যস্ততা।
কই মোহিনী? ডাক খোকা, মোহিনীকে ডাক।
শ্যামার চোখ ছলছল করে। আসিবার জন্য তাই বকুল ইদানীং এত করিয়া লিখিতেছিল। তারা আনিবার ব্যবস্থা করতে পারে নাই বলিয়া মেয়ে তার জামাইকে এমন চিঠি লিখিয়াছে যে, বিনা নিমন্ত্রণে যে কখনো আসে না সে যাচিয়া আসিয়াছে বকুলকে আনানোর ষড়যন্ত্ৰ করিতে, ছুটি লইয়া। যাইতেছে বাড়ি! মোহিনীকে কত জোরই যে শ্যামা করে! সজল চোখে কতবার যে সে মোহিনীকে মনে করাইয়া দেয় তার হাতে যেদিন মেয়েকে সঁপিয়া দিয়াছিল সেইদিন হইতে শ্যামার ছেলের সঙ্গে তার কোনো পার্থক্য নাই, বিধান যেমন মোহিনীও তেমনি শ্যামার কাছে। অনুযোগ দিয়া বলে, তোমার বাড়ির কারুর কি উচিত ছিল না বাবা এ কথাটা আমায় লিখে জানায়! আমি তার মা, আমি জানতে পেলাম না কমাস কি বৃত্তান্ত? পিসি না বুঝুক, তুমি তো বোঝ বাবা মার দুঃখু?
মোহিনীকে সে-বেলা এখানেই খাইয়া যাইতে হয়। জামাই কোনোদিন পর নয়, তবু আজ মোহিনী যেন বিশেষ করিয়া আপন হইয়া যায়। মনটা ভালো মোহিনীর, বকুলের জন্য টান আছে। মোহিনীর, না আসুক সে নিমন্ত্রণ না করিলে, অবুঝ গোয়ার সে নয়, মধুর স্বভাব তার।
চার-পাচদিন পরে বিধান গিয়া বকুলকে লইয়া আসিল। বলিল, উঃ মাগো, কি গালটা পিসি আমাকে দিলে। বাড়িতে পা দেয়া থেকে সেই যে বুড়ি মুখ ছুটাল মা, থামল গিয়ে একেবারে বিদায় দেবার সময়, অমঙ্গল হবে ভেবে তখন বোধহয় কিছু বলতে সাহস হল না, মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি আর যাচ্ছিনে বাবু খুকির শত্রবাড়ি এ জন্মে।
বকুল তো আসিল, এ কোন বকুল? একি রোগা শরীর বকুলের, নিম্প্ৰভ কপোল, ভীরু চোখ, কান্তিবিহীন মুখ, লাবণ্যহীন বর্ণ? মেয়েকে তার এমন করিয়া দিয়াছে ওরা!–পেট ভরে খেতেও ওরা দিত না বুঝি খুকি? খাটিয়ে মারত বুঝি দিনরাত? আমি কি জানতাম মা এত ততাকে কষ্ট দিচ্ছে! আনবার জন্যে লিখতিস, ভাবতাম আসবার জন্যে মন কেমন করছে তাই ব্যাকুল হয়েছিস–পোড়া কপাল আমার।