বাড়িওয়ালার ছেলেমেয়ে বৌ নাতিনাতনি একতলাটা বোঝাই হইয়া থাকে–কখানা মাত্র ঘর, কি করিয়া ওদের কুলায় কে জানে! তিনটি বিবাহিত পুত্রকে তিনখানা ঘর ছাড়িয়া দিলে বাকি সকলে থাকে কোথায়? বাকি ঘর তো থাকে মোটে একখানি। কর্তা গিনি, একটি বিধবা মেয়ে, ছোট মেয়ে আর মেয়ের জামাইও এখানে থাকে তারা, পেটেণ্ট ওষুধের ক্যানভাসার ভাইপোটি, সকলে ওই একখানা ঘরে থাকে নাকি? প্রথমটা শ্যামার বড় দুর্ভাবনা হইত। তারপর একদিন রাত্রে ব্ৰাধিয়া বাড়িয়া বাড়িওলা গিনির সঙ্গে খানিক আলাপ করিতে গিয়া সে ব্যাপার বুঝিয়া আসিয়াছে। বড় দুখানা ঘরের প্রত্যেকটির মাঝামাঝি এদেয়াল হইতে ওদেয়াল পর্যন্ত তার টাঙানো আছে, তাতে ঝুলানো আছে ছিটের পর্দা। দিনের বেলা পর্দা গুটানো থাকে, রাত্রে পর্দা টানিয়া দুখানা ঘরকে চারখানা করিয়া তিন ছেলে আর মেয়ে-জামাই শয়ন করে। পর্দার উপরে একটি বিদ্যুতের বাতি জ্বালিয়া দুদিকের দম্পতিকে আলো দেয়।
সিঁড়ির নিচে যে স্থানটুকু আছে ক্যানভাসার ভাইপোটি সেখানে থাকে। নাম তাহার বনবিহারী। সিঁড়ির উপরে রেলিং ঘেঁষিয়া সঁড়াইলে নিচে বনবিহারীকে দেখিতে পাওয়া যায়। সারাদিন বাহিরে বাহিরে ঘুরিয়া রাত্রি আটটা নটার সময় সে ফিরিয়া আসে। ওষুধের সুটকেসটি চৌকির নিচে ঢুকাইয়া জামাটি খুলিয়া সে পেরেকে টাঙাইয়া দেয়, কাপড় গায়ে দিয়া চৌকিতে বসিয়া জুতার ফিতা খোলে। তারপর চৌকিতে পা তুলিয়া নিজের পা টিপিতে আরম্ভ করে নিজেই। হঠাৎ বাড়িওলা গিনি ডাক দেয়, বনু এলি, বনু? পাউরুটি আনা হয় নি, ভোলা ভুলে এসেছে, যা তো বাবা মোড়ের দোকান থেকে চট করে একটা রুটি নিয়ে আয়–সকালে উঠে খাই খাই করে সবাই তো খাবে আমায়। কোনোদিন বড় বৌ কোলের ছেলেটিকে দিয়া যায়, বলে, দেখ তো ভাই পার নাকি ঘুম পাড়াতে, হেঁটে হেঁটে? ডানা আমার ছিঁড়ে গেল। কোনোদিন বাড়িওলা স্বয়ং আসেন দাবার ছক লইয়া, বলেন, আয় বনু বসি একদান।-বনুর ভাত ঢাকা দিয়ে রাখ বৌমা, দুধ থাকে। তো দিও দিকি বনুকে একটু, দু হাতাই দিও ক্ষীর করে রাখ বাকিটা। কালকের মতো ঘন। কোরো না বাছা ক্ষীর, ঘন ক্ষীর খেয়ে আজ পেট কামড়েছে–পাতলাই রেখ আর চিনি দিও একটু। ভানু, ও ভানু, তামাক দে দিকি মা–বড় কলকেতে দিস বেশি তামাক দিয়ে।
এসব দেখিয়া শুনিয়া শ্যামার চোখে যদি জল আসিত, সে জল সোজা গিয়া পড়িত বনবিহারীর মাথায় পথের ধুলায় ধূসর রুক্ষ চুলে। এক একদিন বিভা আসিয়া দাঁড়ায়। ঝুঁকিয়া দেখিয়া ফিসফিস করিয়া বলে, অনেক মানুষ দেখেছি, এমন বোকা কখনো দেখি নি মাসিমা। এমন করে এখানে তোর পড়ে থাকা কেন? মেসে গিয়ে থাকলেই হয়!
রোজগারপাতি বুঝি নেই।–শ্যামা বলে।
কুড়ি পঁচিশ ও যা পায় মাসিমা একজনের পক্ষে তাই ঢের। তাছাড়া এমন করে থাকার চেয়ে না খেয়ে মরাও ভালো।–পুরুষমানুষ নয় ও!
রাগে বিভা গরগর করে। শ্যামা একটু অবাক হয়, এত রাগ কেন বিভার? কোথায় কোন কাপুরুষ যুবক ক্রীতদাসের জীবনযাপন করে খেয়াল করিয়া বিচলিত হওয়ার স্বভাব তো বিভার নয়! হঠাৎ বিভা করে কি, ঝুঁকিয়া ডাক দেয়, বনুবাবু মা আপনাকে ডাকছেন, উপরে আসবেন একবার?
বনবিহারী মুখ তুলিয়া তাকায়, বলে, যাই।
সে উঠিয়া আসিলে শ্যামাকে অবাক করিয়া দিয়া বিভা তাহাকে বকে। রীতিমতো ধমকায়। বলে, কি যে প্রবৃত্তি আপনার বুঝি নে কিছু, একেবারে আপনার ব্যাবোন নেই, সারাদিন ঘুরে এত রাত্রে ফিরে এলেন, এখনো আপনাকে সংসারের কাজ করতে হবে? কেন করেন আপনি? আমি হলে তো সবাইকে চুলোয় যেতে বলে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়তাম, এত কি আহলাদ সকলের। বিনে মাইনের চাকর নাকি আপনি!–এমনি ভাবে কত কথাই যে বিভা তাহাকে বলে। বলে, সংসারে এমন নিরীহ হইয়া থাকিলে চলে না। একটু শক্ত হইতে হয়। অপদার্থ জেলিফিশ তো নয় বনবিহারী!
বলিতে বলিতে এত রাগিয়া ওঠে বিভা যে হঠাৎ মুখ ঘুরাইয়া গটগট করিয়া সে ভিতরে চলিয়া যায়। মুখ নিচু করিয়া বনবিহারী নামে নিচে। শ্যামা দাঁড়াইয়া ভাবিতে থাকে যে বিভা অনেকদিন এখানে আছে, বনবিহারীর সঙ্গে পরিচয় তাহার অনেক দিনের, বিভার গায়ে পড়িয়া বাবকি করাটা যেমন বিসদৃশ শোনাইল আসলে হয়তো তা তেমন খাপছাড়া নয়।
এখানে আসিয়া অল্পে অল্পে শ্যামার মন কিছু সুস্থ হইয়াছে।
তবে শ্যামা আর সে শ্যামা নাই। বনগাঁয়ে হঠাৎ সে যেরকম শান্ত ও নির্বাক হইয়া গিয়াছিল, এখানেও সে প্রায় তেমনি হইয়া আছে, শুধু তার এই পরিবর্তন এখন আর অস্বাভাবিক মনে হয় না! আসন্ন সন্তান সম্ভাবনার সঙ্গে পরিবর্তনটুকু খাপ খাইয়া গিয়াছে। চলাফেরা কাজকর্ম সমস্তই তার ধীর মন্থর, সংসারটাকে ঠেলিয়া তুলিবার জন্য তার ধৈর্যহীন উৎসাহ আর নাই, নিজের সংসারে থাকিবার সময় সে একদিন ছেলেমেয়ের জামার ছাটটি পর্যন্ত ক্রমাগত উন্নততর করিতে না পারিলে স্বস্তি পাইত না, সংসারের তুচ্ছতম খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলি পর্যন্ত তার কাছে ছিল গুরুতর, এখন সে শুধু মোটামুটি সংসারটা চালাইয়া যায়, ছোটখাটো ক্ৰটি ও ফঁকি সে অবহেলা করে। সংসারের যেখানে বোতাম ছিড়িয়া ফাঁক বাহির হয় সেখানে সেফটিপিন পুঁজিয়া কাজ চালাইতে তাহার বাধে না। ছেলেদের জীবনের প্রত্যেকটি মিনিটের হিসাব রাখা আর হইয়া ওঠে না, বিধান দেরি করিয়া বাড়ি ফিরিলে কারণ জিজ্ঞাসা করিতে সে ভুলিয়া যায়, শীতের সন্ধ্যায় ফণীর পায়ে মোজা না উঠিলেও তার চলে। ঘরের আনাচে কানাচে ধুলাবালি, জামাকাপড়ে ময়লা, চৌবাচ্চায় শ্যাওলা জমিতে পারে।