কি আনন্দেই ওরা দিন কাটায়! সাজিয়া-গুজিয়া ফিটফাট হইয়া থাকে, গান করে, গ্রামোফোন বাজায়, দিবারাত্ৰ শ্যামার কানে ভাসিয়া আসে ওদের হাসির শব্দ। মেয়ে দুটি শুধু নয়, মোটা সরযূ পর্যন্ত যেন উল্লাসে একটা হালকা হিল্লোলে ভাসিয়া বেড়ায়। বাপ-মা আর মেয়েরা যেন বন্ধু, সমানভাবে তাহারা হাসি-তামাশা করে, তাস খেলে চারজনে মিশিয়া, একসঙ্গে সিনেমা দেখিতে যায়। বাড়িতে লোকজনও কি আসে কম। সকলে তাহারা ধাত্রী ডাকিতে আসে না। অনেক বন্ধুবান্ধব আছে ওদের স্ত্রী ও পুরুষ! তাদের মধ্যে কয়েকটি যুবক যে প্রায়ই কেন আসে শ্যামা তাহা বেশ বুঝিতে পারে। কাঠের বেড়ার একটি ফোকরে চোখ রাখিয়া ও-বাড়িতে পুরুষ ও নারীর। নিঃসঙ্কোচ মেলামেশা দেখিয়া শ্যামা থ বনিয়া যায়, গান শুনিতে শুনিতে তাহার ভাত পোড় লাগে।
বিভা এ-বাড়িতে বেশি আসে না, সে একটু অহঙ্কারী। শামু হরদম আসা-যাওয়া করে। শামুর প্রকৃতিটা শ্যামার একটু অদ্ভুত মনে হয়, একদিকে যেমন সে সরল অন্যদিকে আবার তেমনি পাকা। পোকায় কাটা ফুলের মতো সে, খানিক অসাধারণ ভালো খানিক অসাধারণ মন্দ। এমনি বয়সে বিবাহ হইয়া বকুল শ্বশুরবাড়ি গিয়াছে, মেয়েটাকে শ্যামার একটু ভালবাসিতে ইচ্ছা হয়, শিশুর মতো সরল আগ্রহের সঙ্গে শামু তাহার ভালবাসাকে গ্রহণ করে, শ্যামা হয় খুশি। কিন্তু বিধানের সঙ্গে শামুর আলাপ করিবার ভঙ্গিটা শ্যামার ভালো লাগে না। কেমন সব হেঁয়ালিভরা ঠাট্টা শামু করে, কেমন দুষ্ট দুষ্ট মুচকি হাসি হাসে, আড়চোখে কেমন করিয়া সে যেন বিধানের দিকে তাকায়–সকলের সামনে কি একটা অদ্ভুত কৌশলে সে যেন গোপন একটা ভাবতরঙ্গ তার আর বিধানের মধ্যে প্রবাহিত করিয়া রাখে। অতিশয় দুর্বোধ্য, সূক্ষ্ম ও গভীর একটা লুকোচুরি খেলা। শ্যামা কিছু বুঝিতে পারে না, তবু ভালোও তাহার লাগে না। একটু সে সতর্ক হইয়া থাকে। শামু বিধানের ঘরে গেলে মাঝে মাঝে নানা ছলে দেখিয়া আসে ওরা কি করিতেছে। কোনোদিন শামুকে বিধান পড়া বলিয়া দেয়, সেদিন শামুর শ্রদ্ধাপূর্ণ নিরীহ ভাবটি শ্যামার ভালো লাগে। কোনোদিন বিধান জ্ঞানবিজ্ঞানের কথা বলে, বুঝিতে না পারিয়া শামু ফ্যালফ্যাল করিয়া তাকায়, আর থাকিয়া থাকিয়া ঢোক গেলে, সেদিনও শ্যামার মন্দ লাগে না। সে অসন্তুষ্ট হয় সেদিন, যেদিন শামু করে দুষ্টামি। দরজার বাহিরে শ্যামা থমকিয়া দাঁড়ায়। চোখ ঘুরাইয়া মুখভঙ্গি করিয়া শামু কথা বলে, বিধানের মুখের কাছে তৰ্জনী তুলিয়া শাসায়, তারপর হাসিয়া যেন গলিয়া পড়ে–দেখিয়া রাগে শ্যামার গারি রি করিতে থাকে। একি নির্লজ্জ ব্যবহার অত বড় আইবুড়ড়া মেয়ের! এত কিসের অন্তরঙ্গতাঃ বিধান ওকে এত প্রশ্রয় দেয় কেন?
ঘরে ঢুকিয়া শ্যামা বলে, কি হচ্ছে তাদের!–খুব সাবধানে বলে। বিধান না টের পায় সে অসন্তুষ্ট হইয়াছে।
শামু বলে, মাসিমা, আপনার ছেলে বাজি হেরে দিচ্ছে না–দিন তো শাসন করে?
কিসের বাজি বাছা?–শ্যামা বলে।
বললে জিভ দিয়ে আমি যদি নাক তে পারি দু টাকার সন্দেশ খাওয়াবে। নাক লাম, এখন দিচ্ছে না টাকা।
জিভ দিয়া নাক ছোঁয়া? এই ছেলেমানুষি ব্যাপার লইয়া ওদের হাসাহাসি? ছি, কি সব ভাবিতেছিল সে। তার সোনার টুকরো ছেলে, তার সম্বন্ধে ও কথা মনে আনাও উচিত হয় নাই। শ্যামা অপ্রতিভ হইয়া যায়।
বিভা আসিলে বসে না, দাঁড়াইয়া দু চারটি কথা বলিয়া চলিয়া যায়। আঁচল লুটানো শিথিল কবরী বিলাসী বাবু মেয়ে সে, উদাসী আনমনা তার ভাব, এ বাড়ির সকলের কত গভীর অপরাধ সে যেন ক্ষমা করিয়াছে এমনি উদার ও নম্ৰ তাহার গর্ব। রাজরানী যে শখ করিয়া দরিদ্র প্রজার গৃহে আসিয়াছে, স্মিত একটু হাসি, ছেঁড়া লেপ তোশক ভাঙা বাক্স প্যাঁটরা ময়লা জামাকাপড় দেখিয়াও নাক না সিঁটকানোর মহৎ উদারতা, এই সব উপহার দিয়া সে চলিয়া যায়। বসিতে বলিলে বলে, এই যে, বসি, বসার জন্য কি, বসেই তো আছি সারাদিন! এদিক-ওদিক তাকায় বিভা। শ্যামার হাঁড়ি কলসী, লোহার চায়ের কাপ, ড়ো চটের আসন, গোবরলেপা ন্যা সব লক্ষ্য করে কিন্তু না, বিভার স্বপন লাগা চোখে সমালোচনা নাই। কৃত্রিম না থাকা নয়, সত্যই নাই। শ্যামা গামছা পরিয়া গা ধোয় বলিয়া বিভা তাকে অসভ্য মনে করে না, হাসে না মনে মনে। সে শুধু দুঃখ পায়। তার দয়া হয়। খ্ৰীটি সমবেদনার সঙ্গেই সে মনে করে যে আহা, একটু শিক্ষাদীক্ষা পাইলে এমনটা হইত না, সকলের সামনে গামছা পরিতে শ্যামা লজ্জা পাইত।
হাসি যদি কখনো পায় বিভার, সে বিধানের জন্য। হঠাৎ ঘর হইতে বাহির হইয়া বিভাকে দেখিলে আবার সে ঘরে ঢুকিয়া যায়, বিভা যেন অসূর্যম্পশা অন্তঃপুরচারিণী, নিচের বাড়িওয়ালার মেয়ে-বৌয়ের মতো লজ্জাশীলা। বিধান নিজে লজ্জা পাইয়া সরিয়া গেলে কথা ছিল না, বিভার লজ্জা বাঁচানোর জন্য ভদ্রতা করিয়া সে সরিয়া যায় বলিয়াই বিভার হাসি পায়।
আপনার বড় ছেলে বুঝি? সে জিজ্ঞাসা করে।
শ্যামা বলে, হ্যাঁ।
এত অল্প বয়সে পড়া ছেড়ে চাকরিতে ঢুকেছেন?
দুঃখের সংসার মা, উপায় কি! নইলে ছেলে আমার বড় ভালো ছিল পড়াশোনায়, ওর কি এ সামান্য চাকরি করার কথা?–বলিয়া শ্যামা নিশ্বাস ফেলে, কি পরীক্ষা দিয়ে ডেপুটি হয় না তাই দেবার জন্য তৈরি হচ্ছিল, ভগবান বিরূপ হলেন।
বিভা বলে, ও।
শ্যামার একদিকের প্রতিবেশীরা এমনি। নিচের তলার মতোই ঘরোয়া গৃহস্থ মানুষ, সরযুদের মতো উড়ু উড়ু পাখি নয়। শ্যামার মতো তাদেরও ছোট ছেলের গন্ধ ভরা হেঁড়া লেপ তোশক! কর্তা ছিলেন আদালতের পেস্কার, পেনশন লইয়া এখন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করেন। প্রতি মাসের দুই তারিখে সকালবেলা ভাড়ার রসিদ হাতে সিঁড়ির শেষ ধাপে উঠিয়া ডাকেন, বিধানবাবু! নেত্যবাবু! আছেন নাকি?