রাজরানী? এতবার সুপ্রভা এই আশীর্বাদের পুনরাবৃত্তি করে কেন, বকুলকে রাজরানী করিতে এত তাহার উৎসাহ কিসের? রাজরানী হওয়ার শখ ছিল নাকি সুপ্রভার, মনে সেই ক্ষোভ রহিয়া গিয়াছে? কিছু বুঝিবার উপায় নাই। সুপ্রভাকে অসুখী মনে হয় কদাচিৎ। চুপচাপ বসিয়া সে অনেক সময়ই থাকে, সেটা তার স্বভাব, মুখ তাহার সব সময় বিমর্ষ দেখায় না, চোখে তাহার সব সময় ঘনাইয়া আসে না উৎসুক দিবা-স্বপ্নাতুরার দৃষ্টি। তবু শ্যামা মাঝে মাঝে সন্দেহ করে। অত যার রূপ সে কি একেবারেই নিজের মূল্য জানে না, কুমারী জীবনে আশা কি সে করে নাই, কল্পনা কি তার ছিল না? বুড়া বয়সে রাখাল যখন তাহাকে বিবাহ করিয়া তিন পুত্রের জননী সতীনের সংসারে আনিয়াছিল গোপনে সে কি দু-একবিন্দু অশ্রুপাত করে নাই?
বাড়ি ভাড়ার কুড়িটা টাকা নিয়মিত আসে। দু মাস টাকা পাঠাইয়া কনক একবার শ্যামাকে একখানা পত্র লিখিল। পাশে কোন বাড়িতে বিদ্যুতের আলো নেওয়া হইতেছে, দেখিয়া কনকের শখ জাগিয়াছে তারও বিদ্যুতের আলো চাই। বাড়িটা তাদের পছন্দ হইয়াছে, স্থায়ীভাবে তারা ওখানে রহিয়া গেল, এক কাজ করলে হয় না দিদি? খরচপত্র করিয়া তারা বিদ্যুৎ আনাক, মাসে মাসে বাড়ি ভাড়ার টাকায় সেটা শোধ হইবে? এই পত্র পাইয়া শ্যামা বড় চিন্তায় পড়িয়া গেল। এখানে তাহার নানা রকম খরচ আছে, স্কুলে মাহিনা, জামাকাপড় এসব তাহাকেই দিতে হয়, এটা ওটা খুচরা খরচাও আছে অনেক, বাড়ি ভাড়ার টাকা না আসিলে সে করিবে কি? অথচ বিদ্যুৎ আনিতে না দিলে ওরা যদি অন্য বাড়িতে উঠিয়া যায়? সঙ্গে সঙ্গে আবার কি ভাড়াটে মিলিবে? শেষে শ্যামা মিনতি করিয়া কনককে চিঠি লিখিল। লিখিল, ওই কুড়িটা টাকা তাহার সম্বল, ওই টাকা কটির জোরে সে পরের বাড়ি পড়িয়া আছে, বাড়িতে বিদ্যুৎ আনিবার তার ক্ষমতা কই? শ্যামা যে কি দুঃখে পড়িয়াছে। কনক যদি তাহা জানিত–
এ চিঠি ডাকে দিবারও প্রয়োজন হইল না, কনকলতার স্বামীর নিকট হইতে সবিনয় নিবেদন ভণিতার আর একখানা পত্র আসিল, শ্যামার বাড়ি হইতে আপিসে যাতায়াত করা বড়ই অসুবিধা, একটি ভালো বাড়ি পাওয়া গিয়াছে শহরের মধ্যে, ইংরাজি মাসটা কাবার হইলে তাহারা উঠিয়া যাইবে। কলিকাতার কেরানি ভাড়াটের বাসা-বদলানো রোগের খবর তো শ্যামা জানি না, তাহার মুখ শুকাইয়া গেল। কনকলতার উপর রাগ ও অভিমানের তাহার সীমা রহিল না। শ্যামার সঙ্গে না তাহার অত ভাব হইয়াছিল, দুঃখের কথা বলিতে বলিতে শ্যামার চোখে জল আসিলে সে না সান্ত্বনা দিয়া বলিত, ভেব না দিদি, ভগবান মুখ তুলে চাইবেন? …শ্যামা কত নিরুপায় সে তাহা জানে, কলকাতার বাড়ি ভাড়া করিয়াই সে থাকিবে তবু শ্যামার বাড়িতে থাকিবে না। এতকাল অসুবিধা ছিল না, আজ হঠাৎ অসুবিধা হইয়া গেল?
রাখালকে চিঠিখানা দেখাইয়া শ্যামা বলিল, ঠাকুরজামাই এবার কি হবে? কুড়িটে করে টাকা পাচ্ছিলাম, ভগবান তাতেও বাদ সাধলেন।
রাখাল বলিল, আহা, কলকাতায় কি আর ভাড়াটে নেই। যাক না ওরা, ফের ভাড়াটে আসবে–ওপরে একখানা নিচে তিনখানা ঘর, কুড়ি টাকায় ও বাড়ি লুফে নেবে না? পাড়ার কাউকে চিঠি দাও না?
হারান ডাক্তারকে শ্যামা একখানা পত্ৰ লিখিয়া দিল! হারান জবাব দিল, ভয় নাই, বাড়ি শ্যামার খালি থাকিবে না, দু-এক মাসের মধ্যে আবার অবশ্যই ভাড়াটে জুটিবে।
ইংরাজি মাসের পাঁচ ছয় তারিখে শ্যামা ভাড়ার টাকার মনিঅৰ্ডার পাইত এবার দশ তারিখ হইয়া গেল টাকা আসিল না। কনকলতারা কোথায় উঠিয়া গিয়াছে শ্যামা জানি না। নিজের বাড়ির ঠিকানাতেই সে তাগিদ দিয়া চিঠি লিখিল, ভাবিল পোস্টাপিসে ওরা কি আর ঠিকানা রাখিয়া যায় নাই?এ পত্রের কোনো জবাব শ্যামা পাইল না।
মন্দা বলিল, দিচ্ছে ভাড়া! এতকাল যে দিয়েছিল তাই ভাগ্যি বলে জেন বৌ! কলকাতার লোকে বাড়ি ভাড়া দেয় নাকি? একমাস দু মাস দেয় তারপর যদ্দিন পারে থেকে অন্য বাড়িতে উঠে যায়–ঘর ভাড়া আদায় মোকদ্দমা করে।
শ্যামা বিবৰ্ণ মুখে বলিল, আমার যে একটি পয়সা নেই ঠাকুরঝি? আমি যে ওই কটা টাকার ভরসা করছিলাম?
মন্দা বলিল, জলে তো পড় নি?
তারপর বলিল, বাড়িটা বেচে দিলেই পার তো বৌ? এত কষ্ট সয়ে ও বাড়ি রেখে করবে কি? থাকতেও তো পারছ না নিজে? টাকাটা হাতে এলে বরং লাগবে কাজে তারপর কপালে থাকে বাড়ি আবার হবে, না থাকে হবে না! দাদা বেরিয়ে এসে কিছু একটা করবে নিশ্চয়। নাও যদি করে বৌ, ছেলে তো উপযুক্ত হয়ে উঠবে তোমার বাড়ির টাকা শেষ হতে হতে–তখন আর তোমার দুঃখ কিসের?
মুখখানা মন্দা ম্লান করিয়া আনিল, দুঃখের সঙ্গে বলিল, ও বাড়ি বেচতে বলতে আমার ভালো লাগছে ভেব না বৌ–-আমার বাপের ভিটে তো। কিন্তু কি করবে বল? নিরুপায় হলে মানুষকে সব করতে হয়?
বাড়িটা বিক্রয় করিয়া ফেলার কথা শ্যামা ভাবিতেও পারে না। একটা বাড়ি না থাকিলে মানুষের থাকিল কি? দেশে একটা ভিটা থাকিলেও শহরতলির এই বাড়িটা সে বিক্রয় করিয়া ফেলিতে পারি, কিন্তু দেশ পর্যন্ত কি শ্যামার আছে। যে গ্রামে সে জন্মিয়াছিল তার কথা ভালো। করিয়া মনেও নাই। মামার ভিটেখানা নিজের মনে করিয়াছিল, বেচিয়া দিয়া মামা নিরুদ্দেশ হইয়া গেল। স্বামীর ওই একরত্তি বাড়িটুকু সে পাইয়াছে, বুকের রক্ত জল করা টাকায় বাড়ির সংস্কার করিয়াছে, আজ তাও সে বিক্রি করিয়া দিবে? ও-বাড়ির ঘরে ঘরে জমা হইয়া আছে তাহার বাইশ বছরের জীবন, ওইখানে সে ছিল বধূ, ছিল জননী, চারিটি সন্তানকে প্রসব করিয়া ওইখানে সে বড় করিয়াছে, ও বাড়ির প্রত্যেকটি ইট যে তার চেনা, দেয়ালের কোথায় কোন পেরেকের গর্তে কবে সে চুন লেপিয়া দিয়াছিল তাও যে তার স্মরণ আছে। পরের হাতে বাড়ি ছাড়িয়া দিয়া আসিতে তার মন যে কেমন করিয়াছিল, জগতে কে তাহা জানিবে! হায়, ও-বাড়ির প্রত্যেকটি ইটের জন্য শ্যামার যে অপত্যস্নেহ!