দেখিয়া শুনিয়া শ্যামা নিশ্বাস ফেলিল। রাগ ও বিদ্বেষ এবার যেন তাহাদের হইল না, অনেক অভিজ্ঞতা দিয়া শ্যামা এখন বুঝিতে পারিয়াছে রাখাল একা নয়, এমনি জগৎ। এমন করিয়া মিথ্যা বলিতে না জানিলে, ছল ও প্রবঞ্চনায় এমন দক্ষতা না জন্মিলে, সকালে উঠিয়া দশ-বিশটি খাতকের মুখ দেখিবার সৌভাগ্য মানুষের হয় না। রাখালের দোষ নাই। মানুষের মাঝে মানুষের মতো মাথা উঁচু করিবার একটিমাত্র যে পন্থা আছে তাই সে বাছিয়া নিয়াছে। রাখাল তো ধর্মযাজক নয়, বিবাগী সন্ন্যাসী নয়, সে সংসারী মানুষ, সংসারে দশজনে যেভাবে আত্মােন্নতি করে সেও তেমনিভাবে অর্থসম্পদ সঞ্চয় করিয়াছে!
শ্যামা সব জানে। বড়লোক হইবার সমস্ত কলাকৌশল! কেবল স্ত্রীলোক করিয়া ভগবান তাহাকে মারিয়া রাখিয়াছেন।
রাখালের দ্বিতীয় পক্ষের বৌ সুপ্রভাকে দেখিয়া প্রথমে শ্যামা চোখ ফিরাইতে পারে নাই। রাখালের দুবার বিবাহ করার কারণটাও তখন সে বুঝিতে পারিয়াছিল। এত রূপ দেখিলে মাথা ঠিক থাকে পুরুষমানুষের! একটি ছেলে আর একটি মেয়ে হইয়াছে সুপ্রভার, শ্যামা আসিবার আগে সে নাকি অনেকদিন অসুখেও ভুগিয়াছিল, তবু এখনো সে ছবির মতো, প্রতিমার মতো সুন্দরী। এমন সতীন থাকিতে মন্দা যে কেমন করিয়া এখানে গৃহিণীর পদটি অধিকার করিয়া আছে, চারিদিকে সকলকে হুকুম দিয়া বেড়াইতেছে–সুপ্রভাকে পর্যন্ত, ভাবিয়া প্রথমটা শ্যামা আশ্চর্য হইয়া গিয়াছিল। তারপর সে টের পাইয়াছে যতই রূপ থাক সুপ্রভার বুদ্ধি নাই, বড় সে বোকা। পুতুলের মতো সে পরের হাতে নড়েচড়ে, সাহস করিয়া যে তাহার উপর কর্তৃত্ব করিতে যায় তারই কর্তৃত্ব স্বীকার করে, একেবারে সে মাটির মানুষ, ঘোরপ্যাচ বোঝে না, নিজের পাওনা গণ্ডা বুঝিয়া লইতে জানে না। তবু রাখাল কিনা আজো ছোটবৌ বলিতে অজ্ঞান, মনে মনে সকলেই সুপ্ৰভাকে ভয় করে, এ বাড়িতে আদরের তাহার সীমা নাই। সুপ্ৰভা প্ৰভুত্ব করার চেয়ে নির্ভর করিতেই ভালবাসে। বেশি, আদর পাওয়াটাই তার জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্য। মন্দার গৃহিণীপনার ভিত্তিও ওইখানেই সুপ্রভাকে সে নয়নের মণি করিয়া রাখিয়াছে। কে বলিবে সুপ্রভা তাহার সতীন? স্নেহে-যতে সুপ্রভার দিনগুলিকে সে ভরাট করিয়া রাখে, নিজের হাতে সে সুপ্রভাকে সাজায়, সুপ্রভার ঘরখানা। সাজায়, সুপ্রভার শয্যা রচনা করিয়া দেয়, সতীনের প্রতি স্বামীর গভীর ভালবাসাকে হাসিমুখে গ্রহণ করে।
সতীনের সংসারেও তাই এখানে কলহ-বিবাদ মান-অভিমান মন-কষাকষি নাই। মন্দা ভুলিয়া গিয়াছে সে বধূ। এই মূল্য দিয়া সে হইয়াছে গৃহিণী।
কলিকাতার চেয়ে ঢের বেশি সুখেই শ্যামা এখানে বাস করিতে লাগিল। পরের বাড়ি পরের আশ্রয়ে থাকিবার একটু যা লজ্জা! এখানে আসিবার আগে শ্যামা ভাবিয়াছিল এমন নিরুপায় হইয়া আত্মীয়ের বাড়ি যাইতেছে, পদে পদে কত অপমান সেখানে না জানি তাহার জুটিবে, এখানে। কিছু দিন ভয়ে ভয়ে থাকিবার পর দেখিল গায়ে পড়িয়া অপমান কেহ করে না, সে যে এখানে। আশ্রিতা, সময়ে অসময়ে সেটা মনে করাইয়া দিবারও কেহ এখানে নাই, মানাইয়া চলিতে পারিলে এখানে বাস করা কঠিন নয়।
এখানকার গ্রাম্য আবহাওয়াটিও শ্যামার বেশ লাগিল। শহরতলির যে বাড়িতে বিবাহের পর। হইতে এতকাল সে বাস করিয়াছিল সেখানটা শহরের মতো ঘিঞ্জি নয়, তবু সেখানে তাহারা যেন বন্দি জীবনযাপন করিত, ইটের অরণ্যের মধ্যে প্রকৃতির যেটুকু প্রকাশ ছিল তা যেন শহরের পার্কের মতো ছেলেভুলানো ব্যাপার। তাছাড়া, সেখানে তারা ছিল কুনো, ঘরের কোণে নিজেদের লইয়া থাকিত, প্রতিবেশী থাকিয়াও ছিল না। এখানে জীবনের সঙ্গে জীবনের বড় নিবিড় মেশামিশি। মিতালি যেখানে নাই সেখানেও অজস্র মেলামেশা আছে, সহজ বাস্তব মেলামেশা, শহরের মেলামেশার মতো কোমল ও কৃত্রিম নয়, খাটি জিনিস! শ্যামার ছেলেমেয়েরা যেন হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিয়াছে। এখানে তাহারা প্রকাণ্ড অঙ্গন পাইয়াছে, বাগান পুকুর পাইয়াছে, ধূলামাটিতে খেলা করার। সুযোগ পাইয়াছে, আর পাইয়াছে সঙ্গী। বাড়িতেই শ্যামার প্রত্যেকটি ছেলেমেয়ের সাথী আছে, বিধানের জন্মের সময় মন্দা যে কোলের ছেলেটিকে লইয়া কলকাতায় গিয়াছিল তার নাম অজয়, সকলে অজু বলিয়া ডাকে, বিধানের সঙ্গে তাহার খুব ভাব হইয়া গেল। অজয় এক ক্লাস নিচে পড়ে। পড়াশোনায় বিধান বড় ভালো, মন্দার ছেলেদের মাস্টার একদিন বিধানকে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া এই রায় দিয়াছেন। মন্দা জানিয়া খুশি হইয়াছে, বিধান কলকাতার ছেলে বলিয়া অজয়ের সঙ্গে তাহার ঘনিষ্ঠতায় মন্দার যেটুকু ভয় ছিল, মাস্টারের মন্তব্য শোনার পর আর তাহা নাই।
সুপ্ৰভা বকুলকে ভালবাসিয়া ফেলিয়াছে।
বলে, কি মেয়ে আপনার বৌদিদি, দিয়ে দিন মেয়েটাকে আমাকে, দেবেন?
বলে, মেয়ে বলে ওকে কিছু শেখাচ্ছেন না, এ তো ভালো কথা নয়? আজকালকার দিনে লেখাপড়া গানটান না জানলে কে নেবে মেয়েকে? একটু একটু সবই শেখাতে হবে ঠাকুরঝি।
সুপ্ৰভাই উদ্যোগ করিয়া বকুলকে মেয়েস্কুলে ভর্তি করিয়া দিল, বলিল, স্কুলের মাহিনা সেই দিবে। গানটান শিখাইবার যখন উপায় নাই, লেখাপড়াই একটু শিখুক। বকুলকে সে যত্ন করে, লুকাইয়া ভালো জিনিস খাইতে দেয়, যে সব জিনিস শুধু মন্দা ও তার ছেলেমেয়ের জন্য বরাদ্দ। কিন্তু একা বকুল ওসব খাইতে চায় না, বলে, দাদাকে দাও, ভাইকে দাও? সুপ্রভা তাতে বড় খুশি হয়। কি নিঃস্বার্থপর মেয়েটার মন? যেমন দেখিতে সুন্দর, তেমনি মিষ্টি স্বভাব, ও যেন রাজরানী হয় ভগবান!