বৌটির নাম কনকলতা। শ্যামা জিজ্ঞাসা করিত, তোমার স্বামী কত মাইনে পান?
কনক বলিত, কত আর পাবে, মাছিমারা কেরানি তো, বেড়ে বেড়ে নব্বইয়ের মতো হয়েছে খরচ চলে না দিদি। একটা ছেলে পড়ালে আরো কিছু আসে, আমি বারণ করি–সারাদিন আপিস করে আবার ছেলে পড়াবে না কচু–কি হবে বেশি টাকা দিয়ে যা আছে তাই ঢের—নয়? মাসের শেষে বডড টানাটানি পড়ে দিদি, খরচ চলে না।
কনক এমনিভাবে কথা বলিত, উল্টাপাল্টা পুব-পশ্চিম। বলিত, একা স্বাধীনভাবে সে মহাস্ফূর্তিতে আছে, আবার বলিত, একা একা থাকতে ভালো লাগে না দিদি, আত্মীয়স্বজন দুচারটি কাছে না থাকলে বড় যেন ফঁকা ফাকা লাগে–নয়?
শ্যামা বুঝিত, আনন্দে আহলাদে সোহাগে সে ডগমগ, কথা সে বলে না, শুধু বকবক করে, ওর কথার কোনো অর্থ নাই। কনকের বয়স বোধহয় ছিল কুড়ি-বাইশ বছর, শ্যামা যে বয়সে প্রথম মা হইয়াছিল—এই বয়সে বৌটির অবিশ্বাস্য খুকিভাবে শ্যামা থ বনিয়া যাইত, কেমন রাগ হইত শ্যামার। মেয়েমানুষ এমন নির্ভয়, এমন নিশ্চিন্ত, এমন আহলাদী? এই বুদ্ধি-বিবেচনা লইয়া সংসারে ও টিকিবে কি করিয়া? বড়লোকের মেয়ে বুঝি এমনি অসার হয়?
তবু বিরুদ্ধ সমালোচনা-ভরা শ্যামার মন, কি দিয়া কনক যেন আকর্ষণ করিত। চৌবাচ্চার ধারে ওরা যখন পরস্পরের গায়ে জল ছিটাইয়া হাসিয়া লুটাইয়া পড়িত, কনকের স্বামী যখন তাহাকে শূন্যে তুলিয়া চৌবাচ্চায় একটা চুবানি দিয়া, আবার বুকে করিয়া ঘরে লইয়া যাইত, খানিক পরে শুকনো কাপড় পরিয়া আসিয়া কনকের কাজের ছন্দে আবার অকাজের ছন্দ মিশিতে থাকিত, তখন শ্যামার–কে জানে কি হইত শ্যামার, চোখের জল গাল বাহিয়া তাহার মুখের হাসিতে গড়াইয়া আসিত।
কনকের স্বামী আপিস গেলে সে নিচে নামিয়া বলিত, সব দেখে ফেলেছি কনক!
কনকের লজ্জা নাই, সে হাসিয়া ফেলিত—জ্বালিয়ে মারে দিদি, আপিস গেলে যেন বাঁচি।
দোতলার ঘরখানা আর ছাদটুকু ছিল শ্যামার গৃহ, জিনিসপত্রসহ সে বাস করিত ঘরে, রাধিত ছাদে, একখানা করোগেটেড টিনের নিচে। পাশে শুধু নকুবাবুর ছাদ নয়, আশপাশের আরো কয়েক বাড়ির ছাদ হইতে উদয়াস্ত শ্যামার সংসারের গতিবিধি দেখা যাইত। প্রথম প্রথম অনেকগুলি। কৌতুহলী চোখ দেখিতেও ছাড়িত না। যখন তখন ছাদে উঠিয়া নকুবাবুর বৌ জিজ্ঞাসা করিত, কি। করছ বকুলের মা? শ্যামা বলিত, রাধছি দিদি বলিত, সংসারের কাজকর্ম করছি দিদি কি রাধলেন এবেলা? ব্রাধিত এবং সংসারের কাজকর্ম করিত, শ্যামা আর কিছু করিত না? ধানকলের ধূমোদ্গারী চোঙটার দিকে চাহিয়া থাকিত না? রাত্রে ছেলেমেয়েরা ঘুমাইয়া পড়িলে জাগিয়া বসিয়া থাকি না, হিসাব করিত না দিন মাস সপ্তাহের, টাকা আনা পয়সার?
উদ্ভ্রান্ত চিন্তাও শ্যামা করিত, নিশ্বাস ফেলিত। জননীর জীবন কেমন যেন নীরস অর্থহীন মনে হইত শ্যামার কাছে। কোথায় ছিল এই চারিটি জীব, কি সম্পর্ক ওদের সঙ্গে তাহার, অসহায় স্ত্রীলোক সে, মেরুদণ্ড বাকানো এ ভার তার ঘাড়ে চাপিয়া বসিয়াছে কেন? কিসের এই অন্ধ মায়া? জগজ্জননী মহামায়া কিসের ধাধায় ফেলিয়া তাহাকে দিয়া এত দুঃখ বরণ করাইতেছেন? সুখ কাকে। বলে একদিনের জন্য সে তাহা জানিতে পারি না, তাহার একটা প্রাণ নিড়াইয়া চারটি প্রাণীকে সে বাচাইয়া রাখিয়াছে কেন? কি লাভ তাহার? চোখ বুজিয়া সে যদি আজ কোথাও চলিয়া যাইতে পারিত! ওরা দুঃখ পাইবে, না খাইয়া হয়তো মরিয়া যাইবে, কিন্তু তাহাতে কি আসিয়া যায় তার? সে তো দেখিতে আসিবে না। পেটের সন্তানগুলির প্রতি শ্যামা যেন বিদ্বেষ অনুভব করিত সব তাহার শত্ৰু, জন্ম-জন্মান্তরের পাপ! কি দশা তাহার হইয়াছে ওদের জন্য।
শেষের দিকে শ্যামা আর চাইতে পারি না, মাসিক বার টাকায় এতগুলো মানুষের চলে। না। তাই কুড়ি টাকা ভাড়ায় সমস্ত বাড়িটা কনকলতাকে ছাড়িয়া দিয়া সে বনগাঁয়ে রাখালের আশ্রয়ে চলিয়া আসিয়াছে।
বড় রাস্তা ছাড়িয়া ছোট রাস্তা, পুকুরের ধারে বিঘা পরিমাণ ছোট একটি মাঠ, লাল ইটের একতলা একটি বাড়ি ও কলাবাগানের বেড়ার মধ্যবর্তী দুহাত চওড়া পথ, তারপর রাখালের পাকা ভিত, টিনের দেয়াল ও শণের ছাউনির বৈঠকখানা। তিনখানা তক্তপোষ একত্ৰ করিয়া তার উপরে সতরঞ্চি বিছানো আছে। তিন জাতের মানুষের জন্য হুকা আছে তিনটি কাঠের একটা আলমারিতে। বিবর্ণ দপ্তর, কাঠের একটি বাক্সের সামনে শীর্ণকায় টিকিসমেত একজন মুহুরি। রাখালের মুহুরি? নিজে সে সামান্য চাকরি করে, মুহুরি দিয়া তাহার কিসের প্রয়োজন? বাহিরের ঘরখানা দেখিলেই সন্দেহ হয় রাখালের অবস্থা বুঝি খারাপ নয়, অনেকটা উকিল মোক্তারের কাছারি ঘরের মতো তাহার বৈঠকখানা। বৈঠকখানার পরেই বহিরাঙ্গন, সেখানে দুটা বড় বড় ধানের মরাই। তারপর রাখালের বাসগৃহ, আট-দশটি ছোট বড় টিনের ঘরের সমষ্টি, অধিবাসীদের সংখ্যাও বড় কম নয়।
কদিন এখানে বাস করিয়াই শ্যামা বুঝিতে পারিল রাখাল তাহাকে মিথ্যা বলিয়াছিল, সে দরিদ্র নয়! মধ্যবিত্তও নয়। সে ধনী। চাকরি রাখাল সামান্য মাহিনাতেই করে কিন্তু সে অনেক জমিজমা করিয়াছে, বহু টাকা তাহার সুদে খাটে! রাখালের সম্পত্তি ও নগদ টাকার পরিমাণটা অনুমান করা সম্ভব নয়, তবু সে যে উঁচুদরের বড়লোক চোখ কান বুজিয়া থাকিলেও তাহা বোঝ যায়। মোটরগাড়ি, দামি আসবাব, গৃহের রমণীবৃন্দের বিলাসিতার উপকরণ গ্রাম্য গৃহস্থের ধনবত্তার পরিচয় নয়, তাহাদের অবস্থাকে ঘোষণা করে পোষ্যের সংখ্যা, ধানের মরাই, খাতকের ভিড়। রাখালের তিনটি জোড়া তক্তপোষ সকালবেলা খাতকের ভিড়ে ভরিয়া যায়।