শ্যামা মাদুর লইয়া যায়, মাদুর পাতিয়া দুজনে বসে : চাদের আলোয় বসিয়া দুজনে দুটোএকটা সাংসারিক কথা বলে, বেশি সময় থাকে চুপ করিয়া। বলার কি আর কথা আছে ছাই এ বয়সে! হ্যাঁ, শীতল শ্যামাকে একটু আদর করে, শীতলের স্পর্শ আর তেমন মোলায়েম নয়, কখনো যেন স্ত্রীলোকের সঙ্গ পায় নাই, এমনি আনাড়ির মতো আদর করে। শ্যামা দোষ দিবে কাকে? সেও তো কম মোটা হয় নাই!
তারপর একদিন শ্যামা সলজ্জভাবে বলে, কি কাণ্ড হয়েছে জান?
শীতল শুনিয়া বলে, বটে নাকি!
শ্যামা বলে, হ্যাঁ গো, চোখ নেই তোমার?–কি হবে বল তো এবার, ছেলে না মেয়ে?
মেয়ে।
উঁহু, ছেলে।–বুকু বেঁচে থাক, আমার আর মেয়েতে কাজ নেই বাবু। বলিয়া শ্যামা হাসে। মধুর পরিপূর্ণ হাসি, দেখিয়া কে বলিবে, শীতলের মতো অপদাৰ্থ মানুষ তাহার মুখে এ হাসি যোগাইয়াছে।
০৪. মামা আসিয়া হাজির
মাঝখানে একটা শীত চলিয়া গেল, পরের শীতের গোড়ার দিকে, শ্যামার নূতন ছেলেটির বয়স যখন প্রায় আট মাস, হঠাৎ একদিন সকালবেলা মামা আসিয়া হাজির।
শ্যামার সেই পলাতক মামা তারাশঙ্কর।
ছোটাখাটো বেঁটে লোকটা, হাত-পা মোটা, প্ৰকাণ্ড চওড়া বুক। একদিন ভয়ঙ্কর বলবান ছিল, এখন মাংসপেশীগুলি শিথিল হইয়া আসিয়াছে! শেষবার শ্যামা যখন তাকে দেখিয়াছিল মাথার চুলে তাহার পাক ধরে নাই, এবার দেখা গেল প্রায় সব চুল পাকিয়া গিয়াছে। সে তো আজকের কথা নয়। শ্যামার বিবাহের কিছুদিন পরে জমিজমা বেচিয়া গ্রামের সবচেয়ে বনেদি ঘরের বিধবা মেয়েটিকে সাথী করিয়া নিরুদ্দেশ হইয়াছিল, শ্যামার বিবাহ হইয়াছে আজ একুশ-বাইশ বছর। বিবাহের সাত বছর পরে তার সেই প্রথম ছেলেটি হইয়া মারা যায়, তার দু বছর পরে বিধানের জন্ম। গত আশ্বিনে বিধানের এগার বছর বয়স পূর্ণ হইয়াছে।
মামার বয়স ষাট হইয়াছে বৈকি! কিন্তু যে লোহার মতো শরীর তাহার ছিল, এতটা বয়সের ছাপ পড়ে নাই, শুধু চুলগুলি পাকিয়া গিয়াছে, দুটো-একটা দাঁত বোধহয় পড়িয়া গিয়াছিল, মামা সোনা দিয়া বাঁধাইয়া লইয়াছে, কথা বলিবার সময় ঝিকমিক করে। এখনো সে আগের মতোই সোজা হইয়া দাঁড়ায়, মেরুদণ্ডটা আজো এতটুকু বাঁকে নাই। চোখ দুটো মনে হয় একটু স্তিমিত হইয়া আসিয়াছে, তা সে চোখের দোষ অথবা মানসিক শ্রান্তি বোঝা যায় না। শ্যামার বিবাহের সময় মামা ছিল সন্ন্যাসী, গেরুয়া পরিত, লম্বা আলখাল্লা ঝুলাইয়া সযত্নে বাবরি আঁচড়াইয়া ক্যাম্বিশের জুতা পায়ে দিয়া যখন গ্রামের পথে বেড়াইতে যাইত, মনে হইত মস্ত সাধু, বড় ভক্তি করিত গ্রামের লোক। এবার মামার পরনে সরু কালোপাড় ধুতি, গায়ে পাঞ্জাবি, পায়ে চকে জুতো–একেবারে বাবুর বাবু!
শীতল চিনিতে পারে নাই। শ্যামা প্ৰণাম করিয়া বলিল, ও মাগো, কোথায় যাব, এ যে মামা! কোথা থেকে এলে মামা তুমি?
মামা হাসিয়া বলিল, এক জায়গা থেকে কি আর এসেছি মা যে নাম করব, চরকি বাজির মতো ঘুরতে ঘুরতে একবার তোক দেখতে এলাম, আপনার জন কেউ তো আর নেই; বুড়ো হয়েছি, কোন দিন চোখ বুজি তার আগে ভাগ্নীটাকে একবার দেখে যাই, এইসব ভাবলাম আর কি—এরা তোর ছেলেমেয়ে না? কটি রে?
শ্যামাকে মামা বড় ভালবাসিত, সে তো জানিত মামা কবে কোন বিদেশে দেহ রাখিয়াছে, এতকাল পরে মামাকে পাইয়া শ্যামার আনন্দের সীমা রহিল না। কি দিয়া সে যে মামার অভ্যর্থনা করিবে! বাইশ বছর পরে যে আত্মীয় ফিরিয়া আসে তাকে কি বলিতে হয়, কি করিতে হয় তার জন্য? মামাকে সে নানারকম খাবার করিয়া দিল, বাজার হইতে ভালো মাছ তরকারি আনিয়া রান্না করিল, বেশি দুধ আনাইয়া তৈরি করিল পায়েস। মামা বড় ভালবাসিত পায়েস। এখনো তেমনি ভালবাসে কিনা কে জানে?
মামার সঙ্গে একটু ভদ্রতা করিয়া শীতল কোথায় পলাইয়াছিল, মামা ইতিমধ্যে শ্যামার ছেলেদের সঙ্গে ভাব জমাইয়া ফেলিয়াছে–ভারি মজার লোক, এমন আর শ্যামার ছেলেরা দেখে নাই। রাঁধিতে রাঁধিতে শ্যামা হাসিমুখে কাছে আসিয়া দাঁড়ায়, বলে আর তোমাকে পালিয়ে যেতে দেব না মামা, এবার থেকে আমার কাছে থাকবে। তোমার জিনিসপত্তর কই?।
মামা বলে, সে এক হোটলে রেখে এসেছি, কে জানত বাবু তোরা আছিস এখানে?
শ্যামা বলে, ওবেলা গিয়ে তবে জিনিসপত্তর সব নিয়ে এস, কলকাতা এসেছ কবে?
মামা বলে, এই তো এলাম কাল না পরশু, পরশু বিকেলে।
বিধান আজ স্কুলে গেল না। মামা আসিয়াছে বলিয়া শুধু নয়, বাড়িতে আজ নানারকম রান্না হইতেছে, মামা কি একাই সব খাইবে? এগারটা পর্যন্ত কোথায় আড্ডা দিয়া আসিয়া তাড়াহুড়া করিয়া স্নানাহার সারিয়া শীতল প্রেসে চলিয়া গেল, মামার সঙ্গে একদণ্ড বসিয়া কথা বলার সময় পাইল না। আজ তাহার এত তাড়াতাড়ি কিসের সে-ই জানে, বাড়িতে একটা মানুষ আসিলে শীতল যেন কি রকম করে, সে যেন চোর, পুলিশ তাহার খোঁজ করিতে আসিয়াছে।
রাঁধিতে রাঁধিতে শ্যামা কত কি যে ভাবিতে লাগিল। সঙ্গিনীটির কি হইয়াছে? হয়তো মরিয়া গিয়াছে, নয়তো মামার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হইয়াছে অনেকদিন আগেই। ও সব সম্পর্ক আর কতকাল টেকে? মরুক, ওসব দিয়া তার কি দরকার? কেলেঙ্কারি ব্যাপার চুকাইয়া দিয়া মামা ফিরিয়া আসিয়াছে, এই তার ঢের। আচ্ছা, এতকাল মামা কি করিতেছিল? টাকা-পয়সা কিছু সঞ্চয় করিয়াছে। নাকি? তা যদি করিয়া থাকে তবে মন্দ হয় না। মামার সম্পত্তি হাতছাড়া হইয়া যাওয়ায় শীতলের মনে বড় লাগিয়াছিল, মামা হয়তো এবার সুদে-আসলে সে পাওনা মিটাইয়া দিবে? পুরুষমানুষের ভাগ্য, বিদেশে ধূলিমুঠা ধরিয়া মামার হয়তো সোনামুঠা হইয়াছে, মামার কাপড়-জামা দেখিলেও তাই মনে হয়। মামার তো আর কেউ নাই, যদি কিছু সঞ্চয় করিয়া থাকে শ্যামাই তাহা পাইবে। এই বয়সে আর একজন সঙ্গিনী জুটাইয়া মামা আর তাহার দেশান্তরী হইতে যাইবে না!