তবু, এই সব অভাব অনটনের মধ্যেও শ্যামার দিনগুলি সুখে কাটিয়া যায়। ছেলেমেয়েদের অসুখ বিসুখ নাই। শীতলের যাহাই হইয়া থাক, তাহাকে সামলাইয়া চলা সহজ। নিজের শরীরটাও শ্যামার এত ভালো আছে যে, সংসারের সমস্ত খাটুনি খাটিতে তাহার কিছুমাত্র কষ্ট হয় না, কাজ করিতে যেন ভালোই লাগে।
চৈত্র শেষ হইয়া আসিল। ছাদে দাঁড়াইলে বসাকদের বাড়ির পাশ দিয়া রেলের উঁচু বাঁধটার ধারে প্রকাণ্ড শিমুল গাছটা হইতে তুলা উড়িয়া যাইতে দেখা যায়। পূর্বে খানিকটা ফ্ৰকা মাঠের পর টিনের বেড়ার ওপাশে ধানকলের প্রকাণ্ড পাকা অঙ্গন, কুলিরা প্রত্যহ ধান মেলিয়া শুকাইতে দেয়, ধান খাইতে আঁক বাধিয়া পায়রা নামিয়া আসে। পায়রার কঁকের ওড়া দেখিতে শ্যামা বড় ভালবাসে, অতগুলি পাখি আকাশে বার বার দিক পরিবর্তন করে একসঙ্গে, সকাল ও বিকাল হইলে উড়িবার সময় একসঙ্গে সবগুলি পায়রার পাখার নিচে রোদ লাগিয়া ঝঝ করিয়া ওঠে, শ্যামা অবাক হইয়া ভাবে, কখন কোন দিক বাকিতে হইবে, সবগুলি পাখি একসঙ্গে টের পায় কি করিয়া? ধানকলের এক কোনায় ছোট একটি পুকুর, ইঞ্জিনঘরের ওদিকে আরো একটা বড় পুকুর আছে, বয়লারের ছাই ফেলিয়া ছোট পুকুরটির একটি তীরকে ওরা ধীরে ধীরে পুকুরের মধ্যে ঠেলিয়া আনিয়াছে। পুকুরটা বুজাইয়া ফেলিবে বোধহয়। ছাই ফেলিবার সময় বাতাসে রাশি রাশি ছাই সাদা মেঘের মতো টিনের প্রাচীর ডিঙ্গাইয়া, রেলের বধ পার হইয়া কোথায় চলিয়া যায়। আজকাল এসব শ্যামা যেমন ভাবে চাহিয়া দেখে কতকাল তেমনি ভাবে সে তা দেখে নাই। বিকালে ছাদে গিয়া সে মণিকে ছাড়িয়া দেয়, মণি বকুলের সঙ্গে ছাদময় ছোটাছুটি করে। আলিসায় ভর দিয়া শ্যামা কাছে। ও দূরে যেখানে যা কিছু দেখিবার আছে, দেখিতে থাকে, বোধ করে কেমন একটা উদাস উদাস ভাব, একটা অজানা ঔৎসুক্য। পরপর অনেকগুলি গাড়ি রেললাইন দিয়া দুদিকে ছুটিয়া যায়, তিনটি সিগনেলের পাখা বার বার ওঠে নামে। ধানকলের অঙ্গনে কুলি মেয়েরা ছড়ানো ধান জড়ো করিয়া নৈবিদ্যের মতো অনেকগুলি স্তুপ করে, তারপর হোগলার টুপি দিয়া ঢাকিয়া দেয়। ছোট পুকুরটিতে ধানকলের বাবু জাল ফেলায়, মাছ বেশি পড়ে না, এতটুকু পুকুরে মাছ কোথায়?–জাল ফেলাই সার। শ্যামার হাসি পায়। তাহার মামাবাড়ির পুকুরেও জাল ফেলিলে আর দেখিতে হইত না, মাছের লেজের ঝাপটায় জাল খান খান হইয়া যাইত। পারিপার্শ্বিক জগতের দৃশ্য ও ঘটনা শ্যামা এমনিভাবে খুঁটিয়া খুঁটিয়া উপভোগ করে, বাড়িঘর, ধানকল, রেললাইন, রাস্তার মানুষ, এসব আর কবে তাহার এত ভালো লাগিয়াছিল?–অথচ মনে মনে অকারণ উদ্বেগ, দেহে যেন একটা শিথিল ভারবোধ, হাইতোলা আলস্য। বিধান আজকাল বিকালের দিকে শঙ্করদের বাড়ি খেলিতে যায়, ছেলেকে না দেখিয়া তার কি ভাবনা হইয়াছে?
শীতল বলে, বুড়ো বয়সে তোমার যে চেহারার খোলতাই হচ্ছে গো, বয়স কমছে নাকি দিনকে দিন?
শ্যামা বলে, দূর দূর! কি সব বলে ছেলের সামনে!
শীতলের নজর পড়িয়াছে, শ্যামার ঘেঁড়া কাপড় দেখিয়া তাহার চোখ টাটায়, শ্যামার জন্য সে রঙিন কাপড় কিনিয়া আনে। শ্যামা প্রথমে জিজ্ঞাসা করে, কটাকা নিলে? টাকা পেলে কোথা?
হুঁ, কটা টাকা আর পাই নে আমি, উপরি পেয়েছি কাল। একটি পয়সা তো দাও না, আমার খরচ চলে কিসে উপরি না পেলে?
খরচ চলে? শীতল তাহা হইলে আরো উপরি টাকা পায়, খুশিমতো খরচ করে, তাহাকে যে টাকা আনিয়া দেয়, তা-ই সব নয়? শ্যামা রাগিয়া বলে, কি রকম উপরি পাও শুনি?
নিশ্চয় আরো বেশি, মিথ্যে বলছ বাবু তুমি–নিজে নিজে খরচ কর তো সব? আমার এদিকে খরচ চলে না, ঘেঁড়া কাপড় পরে আমি দিন কাটাই।
আরে মুশকিল, তাই তো কাপড় কিনে আনলাম।–আচ্ছা তো নেমকহারাম তুমি। | শ্যামা রঙিন কাপড়খানা নাড়াচাড়া করে, মিষ্টি করিয়া বলে, কি টানাটানি চলেছে বোঝ না। তো কিছু, কি কষ্টে যে মাস চালাই ভাবনায় রাতে ঘুম হয় না দু-চারটে টাকা যদি পাও, কেন নষ্ট কর?–এনে দিলে সুসার হয়। তোমার খরচ কি? বাজে খরচ করে নষ্ট কর বৈ তো নয়, যা স্বভাব তোমার জানি তো! হাতে টাকা এলে আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে যায়। এবার থেকে আমায় এনে দিও, তোমার যা দরকার হবে চেয়ে নিও–আর কটা মাস মোটে, ধারটা শোধ হয়ে গেলে তখন কি আর টানাটানি থাকবে, না তুমি দশ-বিশ টাকা বাজে খরচা করলে এসে যাবে?
শ্যামা বলে, শীতল শোনে। শ্যামাকে বোধহয় সে আর একজনের সঙ্গে মিলাইয়া দেখে যে এমন মিষ্টি মিষ্টি কথা বলিয়া বুঝাইয়া টাকা আদায় করিত, বলিত আমার দুখানা গয়না গড়িয়ে দে, টাকাটা তাহলে আটকা থাকবে, নইলে তুই তো সব খরচ করে ফেলবি দরকারের সময় তুই তোর গয়না বেচে নিস, আমি যদি একটি কথা কই–
সে এসব বলিত মদের মুখে। শ্যামা কি?
তারপর শ্যামা বলে, এ কাপড় তো পরতে পারব না আমি ছেলের সামনে, ও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে, আমার লজ্জা করবে বাবু।
না পরতে পার, ওই নর্দমা রয়েছে ওখানে ফেলে দাও।–শীতল বলে।
রাতে ছেলেমেয়েরা সব ঘুমাইয়া পড়িলে শ্যামা আস্তে আস্তে শীতলকে ডাকে, বলে, হ্যাগো ঘুমুলে নাকি? ফুটফুটে জোছনা উঠেছে দিব্যি, ছাতে যাবে একবারটি?
শীতল বলে, আবার ছাতে কি জন্যে–কিন্তু সে বিছানা ছাড়িয়া ওঠে।
শ্যামা বলে, গিয়ে একটা বিড়ি ধরাও, আমি আসছি।
রঙিন কাপড়খানা পরিয়া শ্যামা ছাদে যায়। বড় লজ্জা করে শ্যামার–শীতলকে নয়, বিধানকে। ঘুম ভাঙিয়া রাতদুপুরে তার পরনে রঙিন কাপড় দেখিলে, ও যা ছেলে, ওর কি আর বুঝিতে বাকি থাকিবে, শীতলের মন ভুলানোর জন্যে সে সাজগোজ করিয়াছে? অথচ শীতল শখ করিয়া কাপড়খানা আনিয়া দিয়াছে, একবার না পরিলেই বা চলিবে কেন?