ফাল্গুন মাস কাবার হইয়া আসিল। শীত একেবারে কমিয়া গিয়াছে। একদিন রোদ খাওয়াইয়া লেপগুলি শ্যামা তুলিয়া রাখিল। শ্যামার শরীরটা আজকাল ভালো আছে, তিন ছেলের মার আবার শরীর–তবু, সানন্দ মনে আরেকটি সন্তানের শখ যেন উঁকি মারিয়া যায়, একা থাকিবার সময় অবাক হইয়া শ্যামা হাসে, কি কাণ্ড মেয়েমানুষের, মাগো!
বিধান দশটার সময় ভাত খাইয়া জুতা মোজা হাফপ্যান্ট আর শার্ট পরিয়া স্কুলে যায়, শ্যামা তাহার চুল আঁচড়াইয়া দেয়, আঁচল দিয়া মুছিয়া দেয়। প্রথম প্রথম ছেলের মুখে সে একটু পাউডার মাখাইয়াও দিত, বড়লোকের ছেলেদের মাঝখানে গিয়া বসিবে, একটু পাউডার না মাখিলে কি চলে? স্কুলে ছেলেরা ঠাট্টা করায় বিধান এখন আর পাউডার মাখাইতে দেয় না। বলে, তুমি কিছু জান না মা, পাউডার দেখলে ওরা সবাই হাসে, স্যারসুদ্ধ। কি বলে জান? বলে চুন তো মেখেই এসেছিস, এবার একটু কালি মাখ, বেশ মানাবে ততাকে, মাইরি ভাই, মাইরি।
মাইরি বলে? বিধানের স্কুলে বড়লোকের সোনার চাদ অভিজাত ছেলেদের মুখে এই কথাটির উচ্চারণ শ্যামার বড় খাপছাড়া মনে হয়। এমনি কত কথা বিধান শিখিয়া আসে, মাইরির চেয়েও ঢের বেশি খারাপ কথা। অনেক বড় বড় শব্দও সে শিখিয়া আসে, আর সঙ্কেত, শ্যামা যার মানেও বুঝিতে পারে না। তাহার অজানা এক জগতের সঙ্গে বিধান পরিচিত হইতেছে, অল্প অল্প একটু যা আভাস পায়, তাতেই শ্যামা অবাক হইয়া থাকে। সে একটা বিচিত্ৰ গর্ব ও দুঃখ বোধ করে। বাড়িতে এখন বিধানের জিজ্ঞাসা কমিয়া গিয়াছে, প্রশ্নে প্রশ্নে আর সে শ্যামাকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তোলে না। ছাদে উঠিয়া, খানিক দূরে বধের উপর দিয়া যে রেলগাড়ি চলিয়া যায়, ছেলেকে তাহা দেখানোর সাধ শ্যামার কিন্তু কমে নাই, জ্ঞান ও বুদ্ধিতে ছেলে তাহাকে ছাড়াইয়া যাইতেছে বলিয়া গর্ব ও আনন্দের সঙ্গে শ্যামার দুঃখ এইটুকু।
বকুল আছে।
সে কিন্তু মেয়ে। ছেলের মতো শ্যামার কাছে মেয়ের অত খাতির নাই। ছ বছরের মেয়ে, সে তো বুড়ি। শ্যামা তাহাকে দিয়া দুটি-একটি সংসারের কাজ করায়, মণিকে খেলা দিতে বলে; সময় পাইলে প্রথম ভাগ খুলিয়া একটু একটু পড়ায়। মেয়েটা যেন দুরন্ত হইয়াছে, সেরকম মাথা নাই, কিছু শিখিতে পারে নাই, তাহাকে অক্ষর চিনাইতেই শ্যামার একমাস সময় লাগিয়াছে, কতদিনে কর খল শিখিবে, কে জানে। মাঝে মাঝে রাগ করিয়া শ্যামা মেয়ের পিঠে একটা চড় বসাইয়া দেয়। বিধানও মারে। প্রথম ভাগের পড়া যে শিখিতে পারে না, তাহার প্রতি বিধানের অবজ্ঞা অসীম। এক একদিন সকালবেলা হঠাৎ সে তাঁহার ক্লাসমাস্টার অমূল্যবাবুর মতো গম্ভীর মুখ করিয়া হুকুম দেয়, এই বুকু, নিয়ে আয় তো বই তোর–বুকু ভয়ে ভয়ে বই লইয়া আসে, তাহার ছেড়া ময়লা প্রথম ভাগখানি। ভয় পাইলে বোঝা যায়, কি বড় বড় আশ্চর্য দুটি চোখ বকুলের। পড়া ধরিয়া বোনের অজ্ঞতায় বিধান খানিকক্ষণ শ্যামার সঙ্গে হাসাহাসি করে, তারপর কখন যে সে অমূল্যবাবুর মতো ধ করিয়া চাটি মারিয়া বসে, আগে কারো টের পাইবার যো থাকে না। শ্যামা শুধু বলে, আহা খোকা, মারিস নে বাবা।
বুকল বড় অভিমানী মেয়ে, কারো সামনে সে কখনো কাঁদে না; ছাদে চিলেকুঠির দেয়াল আর আলিসার মাঝখানে তাহার একটি হাতখানেক ফাঁক গোসাঘর আছে, সেইখানেই নিজেকে খুঁজিয়া দিয়া সে কাঁদে। তারপর গোসাঘরখানাকে পুতুলের ঘর বানাইয়া সে খেলা করে। যে পুতুলটি তাহার ছেলের বৌ তার সঙ্গে বকুলের বড় ভাব, দুজনে যেন সই। তাকে শোনাইয়া সে সব মনের কথা বলে। বলে, বাবাকে সব বলে দেব, বাবা দাদাকে মারবে, মাকেও মারবে, মারবে না ভাই বৌমা? এ্যা করে জিব বের করে দাদা মরে যাবে–মা কেঁদে মরবে, হু।
শীতলের কি হইয়াছে শ্যামা বুঝিতে পারে না, লোকটা কেমন যেন ভেঁাতা হইয়া গিয়াছে, স্ফূৰ্তিও নাই। দুঃখও নাই। সময়মতো আপিসে যায়, সময়মতো ফিরিয়া আসে, কোনোদিন পাড়ার অখিল দত্তের বাড়ি দাবা খেলিতে যায়, কোনোদিন বাড়িতেই থাকে। বাড়িতে যতক্ষণ থাকে, রাগারাগিও করে না, দীনদুঃখীর মতো মুখের ভাবও করিয়া রাখে না, স্ত্রী ও পুত্রকন্যার সঙ্গে তাহার কথা ও ব্যবহার সহজ ও স্বাভাবিক হয়, অথচ তার কাজে কারো যেন মূল্য নাই কিছুই সে যেন। গ্রাহ্য করে না। শ্যামার টাকা লইয়া পালানোর পর হইতে তাঁহার এই পাগলামি-না-করার পাগলামি আরম্ভ হইয়াছে। ধার করিয়া রাখালকে টাকা দেওয়ার অপরাধ, শ্যামার জমানো টাকাগুলি নষ্ট করার অপরাধ, তাহার কাছে অবশ্যই পুরোনো হইয়া গিয়াছে, মনে আছে কিনা তাও সন্দেহ। মাস গেলে আগের টাকার অর্ধেক পরিমাণ টাকা আনিয়া সে শ্যামাকে দেয়, আগে হইলে এই লইয়া কত কাণ্ড করিত, হয় অনুতাপে সারা হইত, না হয় নিজে নিজে কলহ বাধাইয়া শ্যামাকে গাল দিয়া বলিত, যা সে আনিয়া দেয় তাই যেন শ্যামা সোনামুখ করিয়া গ্রহণ করে, ঘরে বসিয়া গেলা যাহার একমাত্র কর্ম, অত তাহার টাকার আঁকতি কেন?–এখন টেরও পাওয়া যায় না কম টাকা আনিয়াছে এটা সে খেয়াল করিয়াছে। শ্যামা যদি নিশ্বাস ফেলিয়া বলে, কি করে যে মাস চালাব, সে অমনি অমায়িকভাবে বলিয়া বসে, ওতেই হবে গো, খুব চলে যাবে, বাড়ি ভাড়া দিতে হয় না, ইয়ে করতে হয় না, কি কর অত টাকা?
কমল ঘোষের টাকাটা মাসে মাসে কিছু কম করিয়া দিলে হয়তো চলে, শীতলকে এ কথা বলিতে শ্যামার বাধে। ঋণ যত শীঘ্ৰ শোধ হইয়া যায় ততই ভালো। এদিকে খরচ চলিতে চাহে। না। বিধানকে স্কুলে দেওয়ার পর খরচ বাড়িয়াছে, বই খাতা, স্কুলের মাহিনা, পোশাক, জলখাবারের পয়সা এ সব মিলিয়া অনেকগুলি টাকা বাহির হইয়া যায়। যেমন তেমন করিয়া ছেলেকে শ্যামা স্কুলে পাঠাইতে পারে না, ছেলের পরিচ্ছদ ও পরিচ্ছন্নতা সম্বন্ধে বিষ্ণুপ্রিয়া যে তাহাকে সতর্ক করিয়া দিয়াছিল, নিতান্ত অভাবের সময়েও শ্যামা তাহা অগ্রাহ্য করিতে পারে না। খরচ সে কমাইয়াছে। অন্য দিকে। সত্যভামার এতকালের চাকরিটি গিয়াছে। নিজের জন্য সেমিজ ও কাপড় কেনা শ্যামা বন্ধ করিয়াছে, এ সব বেশি পরিমাণে তাহার কোনোদিন ছিল না, চিরকাল জোড়াতালি দিয়া কাজ চালাইয়া আসিয়াছে, এখন বড় অসুবিধা হয়। স্বামী-পুত্র ছাড়া বাড়িতে কেহ থাকে না তাই রক্ষা, নতুবা লজ্জা বাঁচিত না। শীতল আর বিধান বাহিরে যায়, ওদের জামাকাপড় ছাড়া শ্যামা আর কিছু ধোপাবাড়ি পাঠায় না, বাড়িতে কাচিয়া লয়। ছেলেমেয়েদের দুধ সে কমাইতে পারে নাই, কমাইয়াছে মাছের পরিমাণ। মাঝে মাঝে ফল ও মিষ্টি আনাইয়া সকলকে খাওয়ানোর সাধও সে ত্যাগ করিয়াছে। এই ত্যাগটাই সবচেয়ে কষ্টকর। শ্যামার ছেলেমেয়েরা ভালো জিনিস খাইতে বড় ভালবাসে।