রাগে-দুঃখে সারাদিন শ্যামা ছটফট করিল, যতবার রাখাল ও মন্দার হীন ষড়যন্ত্রের কথা আর টাকার অঙ্কটা সে মনে করিল গা যেন তাহার জ্বলিয়া যাইতে লাগিল। কত কষ্টের টাকা তাহার, শীতল তো পাগল, কবে তাহার কমল প্রেসের চাকরি ঘুচিয়া যায় ঠিক নাই, দুটো টাকা জমানো না থাকিলে ছেলেদের লইয়া তখন সে করিবে কি? শীতলকে সে অনেক জেরা করিল কবে টাকা দিয়াছে? রাখাল কবে টাকা ফেরত দেবে বলেছে? টাকার পরিমাণটা সত্যই সাত শ, না আরো বেশি? এমনি সব অসংখ্য প্রশ্ন। শীতলও এখন অনুতাপ করিতেছিল, প্রত্যেকবার জেরা শেষ করিয়া শ্যামা যখন তাহাকে রাগের মাথায় যা মুখে আসিল বলিয়া গেল, সে কথাটি বলিল না।
শুধু যে কথা বলিল না তা নয়, তাহার বর্তমান বিষণ্ণ মানসিক অবস্থায় এ ব্যাপারটা এমন গুরুতর আকার ধারণ করিল যে সে আরো মনমরা হইয়া গেল এবং কয়েকদিন পরেই শ্যামাকে শোনাইয়া আবোল-তাবোল কি যে সব কৈফিয়ত দিতে লাগিল শ্যামা কিছুই বুঝিল না। শীতল ফাজলামি আরম্ভ করিয়াছে ভাবিয়া সে রাগিয়া গেল। শীতল অনুতপ্ত, বিষণ্ণ ও নম্ৰ হইয়া না থাকিলে এতটা বাড়াবাড়ি করিবার সাহস হয়তো শ্যামার হইত না; এবার শীতলও রাগিয়া উঠিল। অনেকদিন পরে শ্যামাকে একটা চড় বসাইয়া দিল, তারপর সে-ই যেন মার খাইয়াছে এমনি মুখ করিয়া শ্যামার আশপাশে ঘণ্টাখানেক ঘোরাঘুরি করিয়া বাহির হইয়া গেল! বাড়ি ফিরিল একদিন পরে।
এতকাল পরে আবার মার খাইয়া শ্যামাও নম্ৰ হইয়া গিয়াছিল, শীতল বাড়ি ফিরিলে সে যেভাবে সবিনয় আনুগত্য জানাইল, প্রহৃত স্ত্রীরাই শুধু তাহা জানে এবং পারে। তবু অশান্তির অন্ত হইল না। পরস্পরকে ভয় করিয়া চলার জন্য দারুণ অস্বস্তির মধ্যে তাহাদের দিন কাটিতে লাগিল।
শ্যামা বলে, বেশ ভদ্রতা করিয়াই বলে–তুমি এমন মন খারাপ করে আছ কেন?
শীতলও ভদ্রতা করিয়া বলে, টাকাটা যদ্দিন না শোধ হচ্ছে শ্যামা–
হঠাৎ মাসিক উপার্জন একেবারে অর্ধেক হইয়া গেলে চারদিকে তাহার যে ফলাফল ফুটিয়া ওঠে, চোখ বুজিয়া থাকিলেও খেয়াল না করিয়া চলে না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেন একটা শক্ৰতার সৃষ্টি হইতে থাকে।
শেষে শ্যামা একদিন বুক বধিয়া টাকা তুলিবার ফর্মে নাম সই করিয়া তাহার সেভিংস ব্যাংকের খাতাখানা শীতলের হাতে দিল। খাতায় শুধু জমার অঙ্কপাত করা আছে, সত্যভামাকে দিয়া পাঁচটি সাতটি করিয়া টাকা জমা দিয়া শ্যামা শ পাঁচেক টাকা করিয়াছে, একটি টাকা কোনোদিন তোলে নাই।
টাকাটা তুলে কমলবাবুকে দাও গে, ধারটা শোধ হয়ে যাক, টাকা থাকতে মনের শান্তি নষ্ট করে কি হবে? আস্তে আস্তে আবার জমবেখন।
খাতাখানা লইয়া শীতল সেই যে গেল সাতদিনের মধ্যে আর সে বাড়ি ফিরিল না। শ্যামা যে বুঝিতে পারিল না তা নয়, তবু একি বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা হয় যে তার অত কষ্টের জমানো টাকাগুলি লইয়া শীতল উধাও হইয়া গিয়াছে? একদিন বিষ্ণুপ্রিয়ার বাড়ি গিয়া শ্যামা কমল প্রেসে লোক পাঠানোর ব্যবস্থা করিয়া আসিল। সে আসিয়া খবর দিল প্রেসে শীতল যায় নাই। শীতল গাড়ি চাপা পড়িয়াছে অথবা তাহার কোনো বিপদ হইয়াছে শ্যামা একবার তাহা ভাবে নাই, কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়া শীতলকে ভালোরকম চিনিত না বলিয়া হাসপাতালে, থানায় আর খবরের কাগজের আপিসে খোঁজ করাইল। গাড়িটাড়ি চাপা পড়িয়া থাকিলে শীতলের একটা সংবাদ অবশ্যই পাওয়া যাইত, শ্যামাকে এই সান্ত্বনা দিতে আসিয়া বিষ্ণুপ্রিয়া অবাক হইয়া বাড়ি গেল। শ্যামা যেভাবে তার কাছে স্বামীনিন্দা করিল, ছোটজাতের স্ত্রীলোকের মুখেও বিষ্ণুপ্রিয়া কোনোদিন সে সব কথা শোনে নাই।
বিধান জিজ্ঞাসা করে, বাবা কোথায় গেছে মা?
শ্যামা বলে, চুলোয়।
শ্যামা ব্ৰাধে বাড়ে, ছেলেমেয়েদের খাওয়ায়, নিজে খায়, কিন্তু বাঘিনীর মতো সব সময় সে যেন কাহাকে খুন করিবার জন্য উদ্যত হইয়া থাকে। জ্বালা তাহার কে বুঝিবে? তিনটি সন্তানের জননী, স্বামীর উপর তাহার নির্ভর অনিশ্চিত। একজন পরম বন্ধু তাহার ছিলরাখাল। সে তাহাকে ঠকাইয়া গিয়াছে, স্বামী আজ তাহার সঞ্চয় লইয়া পলাতক। বোকার মতো কেন যে সে সেভিংস ব্যাংকের খাতাখানা শীতলকে দিতে গিয়েছিল। রাত্রে শ্যামার ঘুম হয় না। শীতের রাত্রি, ঠাণ্ডা লাগিবার ভয়ে দরজা বন্ধ করিয়া দিতে হয়, শ্যামা একটা লণ্ঠন কমাইয়া রাখে, ঘরের বাতাস দূষিত হইয়া ওঠে। শ্যামা বার বার মশারি ঝাড়ে, বিধানের গায়ে লেপ তুলিয়া দেয়, বুকুর কথা বদলায়, মণিকে তুলিয়া ঘরের জল বাহির হওয়ার নালিটার কাছে বসায়, আরো কত কি করে। চোখে তাহার জলও আসে।
এমনি সাতটা রাত্রি কাটাইবার পর অষ্টম রাত্রে পাগলের মতো চেহারা লইয়া শীতে কাঁপিতে কাঁপিতে শীতল ফিরিয়া আসিল। শ্যামা জিজ্ঞাসা করিল, খেয়ে এসেছ?
শীতল বলিল, না।
সেই রাত্রে শ্যামা কাঠের উনানে ভাত চাপাইয়া দিল! রান্না শেষ হইতে রাত্রি তিনটা বাজিয়া গেল। শীতল ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, ডাকিয়া তুলিয়া তাহাকে খাইতে বসাইয়া শ্যামা ঘরে গিয়া শুইয়া পড়িল। কাছে বসিয়া শীতলকে খাওয়ানোর প্রবৃত্তি হইল না বলিয়া শুধু নয়, ঘুমে তাহার শরীর অবশ হইয়া আসিতেছিল।
পরদিন শীতল শ্যামাকে এক শ টাকা ফেরত দিল।
আর কই? বাকি টাকা কি করেছ?
আর তুলি নি তো?
তোল নি, খাতা কই আমার?
খাতাটা হারিয়ে গেছে শ্যামা, কোনখানে যে ফেললাম–
শ্যামা কাঁদিতে আরম্ভ করিয়া দিল, সব টাকা নষ্ট করে এসে আবার তুমি মিছে কথা বলছ, আমি পাঁচ শ টাকা সই করে দিলাম এক শ টাকা তুমি কি করে তুললে, মিছে কথাগুলো একটু আটকাল না তোমার মুখে, দোতলায় ঘর তুলব বলে আমি যে টাকা জমাচ্ছিলাম গো।