শ্যামা উদ্বিগ্ন হইয়া বলে, কি ভাবছিস রে তুই? কার কথা ভাবছিস?
কিছু ভাবছি না তো!
মোটরটা চালা না খোকা, মণি কেমন হাসবে দেখিস।
বিধান মোটরে চাবি দিয়া ছাড়িয়া দেয়! মোটরটা চক্রাকার ঘুরিয়া ওদিকের দেয়ালে ঠোকুর। খায়। শ্যামা নিজেই উচ্ছসিত হইয়া বলে, যাঃ তোর মোটরের কলিশন হয়ে গেল! বিধান বসিয়া থাকে, খেলনাটিকে উঠাইয়া আনিবার স্পৃহা তাহার দেখা যায় না। সেলাই বন্ধ করিয়া শ্যামা হুঁচটি কাপড়ে বিধাইয়া রাখে। বিধানের হঠাৎ এমন মনমরা হইয়া যাওয়ার কোনো কারণই সে খুঁজিয়া পায় না। বুড়ো মানুষের মতো একি উদাস গাম্ভীর্য অতটুকু ছেলের?
ক্ষিদে পেয়েছে তার?
বিধান মাথা নাড়ে।
তবে তোর ঘুম পেয়েছে খোকা। আয় আমরা শুই।
ঘুম পায় নি তো!
ওরে দুৰ্জ্জেয়, তবে তোর হইয়াছে কি!
তবে চল, ছাদ থেকে কাপড় তুলে আনি!
সিঁড়িতে ছাদে শ্যামা অনর্গল কথা বলে। বিধানের জীবনে যত কিছু কাম্য আছে, জ্ঞানপিপাসার যত কিছু বিষয়বস্তু আছে, সব সে তাহার মনে পড়াইয়া দিতে চায়। ছেলের এই সাময়িক ও মানসিক সন্ন্যাসে শচীমাতার মতোই তাহার ব্যাকুলতা জাগে। কাপড় তুলিয়া কুঁচাইয়া সে বিধানের হাতে দেয়। বিধান কাপড়গুলি নিজের দুই কধে জমা করে। কাপড় তোলা শেষ হইলে শ্যামা আলিসায় ভর দিয়া রাস্তার দিকে চাহিয়া বলে, কুলপি-বরফ খাবি খোকা?
এমনি ভাবে কথা দিয়া পূজা করিয়া, কুলপি-বরফ ঘুষ দিয়া শ্যামা ছেলের নীরবতা ভঙ্গ করে।
বিধান জিজ্ঞাসা করে, কুলপি-বরফ কি করে তৈরি করে মা?
শ্যামা বলে, হাতল ঘোরায় দেখিস নি? বরফ বেটে চিনি মিশিয়ে ওরা ওই যন্ত্রটার মধ্যে রেখে হাতল ঘোরায়, তাইতে কুলপি-বরফ হয়।
চিনি তো সাদা, রং কি করে হয়?
একটু রং মিশিয়ে দেয়।
কি রং দেয় মা? আলতার রং।
দুর! আলতার রং বুঝি খেতে আছে? অন্য রং দেয়।
কি রং?
গোলাপ ফুলের রং বার করে নেয়।
গোলাপ ফুলের রং কি করে বার করে মা?
শিউলি বোঁটার রং কি করে বার করে দেখিস নি?
সেদ্ধ করে, না?
হ্যাঁ।
তুমি আলতা পর কেন মা?
পরতে হয় রে, নইলে লোকে নিন্দে করে যে।
কেন?
এ কেন-র অন্ত থাকে না।
বিধানের প্রকৃতির আর একটা অদ্ভুত দিক আছে, পশুপাখির প্রতি তার মমতা ও নির্মমতার সমন্বয়। কুকুর বিড়াল আর পাখির ছানা পুষিতে সে যেমন ভালবাসে, এক এক সময় পোষা জীবগুলিকে সে তেমনি অকথ্য যন্ত্রণা দেয়। একবার সন্ধ্যার সময় ঝড় উঠিলে একটি বাচ্চা শালিক পাখি বাড়ির বারান্দায় আসিয়া পড়িয়াছিল, বিধান ছানাটিকে কুড়াইয়া আনিয়াছিল, আঁচল দিয়া পালক মুছিয়া লণ্ঠনের তাপে সেঁক দিয়া তাহাকে বাচাইয়াছিল শ্যামা। পরদিন খাঁচা আসিল। বিধান নাওয়া খাওয়া ভুলিয়া গেল। ক্ষুদ্র বন্দি জীবটি যেন তাহারই সম্মানীয় অতিথি। হরদম ছাতু ও জল সরবরাহ করা হইতেছে, বিধানের দিন কাটিতেছে খাঁচার সামনে। কি তাহার গভীর মনোযোগ, কি ভালবাসা। অথচ কয়েকদিন পরে, এক দুপুরবেলা পাখিটিকে সে ঘাড় মটকাইয়া মারিয়া রাখিল। শ্যামা আসিয়া দেখে, মরা পাখির ছানাটিকে আগলাইয়া বিধান যেন পুত্ৰশোকেই আকুল হইয়া কাঁদিতেছে।
ও খোকা, কি করে মরল বাবা, কে মারলে?
বিধান কথা বলে না, শুধু কাঁদে।
সত্যভামা আজো এ বাড়িতে কাজ করে, সে উঠানে বাসন মাজিতেছিল, বলিল, নিজে গলা টিপে মেরে ফেললে মা, এমন দুরন্ত ছেলে জন্মে দেখি নি–সুন্দোর ছ্যানাটি গো।
তুই মেরেছিস? কেন মেরেছিস খোকা?–শ্যামা বার বার জিজ্ঞাসা করিল, বিধান কথা বলিল না, আরো বেশি করিয়া কাঁদিতে লাগিল। শেষে শ্যামা রাগিয়া বলিল, কাঁদিসনে মুখপোড়া ছেলে, নিজে মেরে আবার কান্না কিসের?।
মরা পাখিটাকে সে প্রাচীর ডিঙ্গাইয়া বাহিরে ফেলিয়া দিল।
রাত্রে শ্যামা শীতলকে ব্যাপারটা বলিল। বলিল, এসব দেখিয়া শুনিয়া তাহার বড় ভাবনা হয়। কেমন যেন মন ছেলেটার, এত মায়া ছিল পাখির বাচ্চাটার উপর। ছেলেটার এই দুর্বোধ্য কীর্তি লইয়া খানিকক্ষণ আলোচনা করিয়া তাহারা দুজনেই ছেলের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, বিধান তখন ঘুমাইয়া পড়িয়ছিল। এরকম রহস্যময় প্রকৃতি ছেলেটা পাইল কোথা হইতে? ওর দেহ-মন তাদের দুজনের দেওয়া, তাদের চোখের সামনে হাসিয়া কাঁদিয়া খেলা করিয়া ও বড় হইয়াছে, ওর মধ্যে এই দুর্বোধ্যতা কোথা হইতে আসিল?
শ্যামা বলে, তোমায় এ্যাদ্দিন বলি নি, মাঝে মাঝে গম্ভীর হয়ে ও কি যেন ভাবে, ডেকে সাড়া পাইনে।
শীতল গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়া বলে, সাধারণ ছেলের মতো হয় নি।
শ্যামা সায় দেয়, কত বাড়ির কত ছেলে তো দেখি, আপন মনে খেলাধুলো করে, খায় দায় ঘুমোয়, এ যে কি ছেলে হয়েছে, কারো সঙ্গে মিল নেই। কি বুদ্ধি দেখেছ?
শীতল বলে, কাল কি হয়েছে জান, জিজ্ঞেস করেছিলাম, দশ টাকা মন হলে আড়াই সেরের দাম কত, সঙ্গে সঙ্গে বললে, দশ আনা। কতদিন আগে বলে দিয়েছিলাম, যত টাকা মন আড়াইসের তত আনা, ঠিক মনে রেখেছে।
বাড়িতে একটা পোষা বিড়াল ছিল, রানী। একদিন দুপুরবেলা গলায় দড়ি বাধিয়া জানালার শিকের সঙ্গে ঝুলাইয়া দিয়া কাপিতে কাঁপিতে বিধান তাহার মৃত্যুযন্ত্রণা দেখিতেছিল। দেখিয়া শ্যামা সেদিন ভয়ানক রাগিয়া গেল। রানীকে ছাড়িয়া দিয়া ছেলেকে সে বেদম মার মারিল। বিধানের স্বভাব কিন্তু বদলাইল না। পিঁপড়ে দেখিলে সে টিপিয়া মারে, ফড়িং ধরিয়া পাখা ছিড়িয়া দেয়, বিড়ালছানা, কুকুরছানা পুষিয়া হঠাৎ একদিন যন্ত্রণা দিয়া মারিয়া ফেলে। বার তের বছর বয়স হওয়ার আগে তাহার এ স্বভাব শোধরায় নাই।