রসুল বলে চলে, বাঁ হাতে সব হয়তো আবার অভ্যাস করতে হবে। সাইকেল চালিয়ে কলেজে যেতে অসুবিধে হবে না এক হাতে কিন্তু—
আজকেই শেষ, অক্ষয় ভাবে, আজকে একটু খেয়ে শেষ করে দেবে। জীবনে আর কোনোদিন ছেবে না এ জিনিস। আজ থেকেই আর খাবে না ঠিক করেছিল সত্য, দু পেগের বেশি এক ফেঁটাও খাবে না ভেবে রেখেও জীবনে শেষ দিনের খাওয়া বলেই অনেক বেশি হয়ে গিয়েছিল কালকের পরিমাণ, তাও সত্য। কিন্তু কাল তো সে জানত না আজ এমন অভিজ্ঞতা তার জুটবে, এমন অদ্ভুত অভাবনীয় ঘটনা ঘটতে দেখবে সে চোখের সামনে। গুলির আওয়াজে কেঁপে কেঁপে উঠছে। বুক আর বাতাস, আহত হয়ে পড়ে যাচ্ছে মরে যাচ্ছে আশপাশের মানুষ, মানুষ তবু নড়ে না, মৃত্যুপণ করে মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। নিজের চোখে দেখেছে ঘটনা এখনো শেষ হয় নি। রাজপথের রঙ্গমঞ্চে জীবন্ত নাটকের রোমাঞ্চকর মর্মান্তিক অভিনয়, তবু যেন সে বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না এ ব্যাপার সত্যই ঘটেছে, এখনো রাস্তা জুড়ে জেদী মানুষগুলি প্রতীক্ষা করছে এর পর কি ঘটে দেখা যাক! উত্তেজনায় দেহ-মন তার কেমন হয়ে গেছে। মাথার মধ্যে কেমন করছে। সে নয় গেল। আজ এই বিশেষ দিনে এই বিশেষ ঘটনা উপলক্ষে একটু যদি সে খায়, একটা কি দুটো মাত্ৰ পেগ, এমন কি দোষের হবে সেটা?
সাড়ে আটটা বাজে। আধঘণ্টার মধ্যে বার বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর হোটেল আছে, কিন্তু সেখানে পেগের দামও বড় বেশি। তাড়াতাড়ি করে গিয়ে একটা কি দুটো গরম পেগ খেয়ে নিয়ে একটু তফাত থেকে এখানকার ব্যাপারের কি পরিণতি হয় কিছুক্ষণ দেখে বাড়ি ফিরে গেলে কি এমন ক্ষতি হবে কার? কি এমন অপরাধ হবে তার?
অলকাকে সমস্ত ঘটনার বিবরণ দিয়ে তার শরীর-মনের অবস্থা বর্ণনা করে সে যদি সব কথা বুঝিয়ে বলে, সে কি বুঝবে না? বিশ্বাস করবে না যে শুধু এই জন্যেই আজ সে একটু খেয়েছে, নইলে সত্যই ঘুতো না, নিশ্চয় প্রতিজ্ঞা পালন করত? তবে, হয়তো কিছু বলারও দরকার হবে না। অলকাকে। দু-একটা পেগ খেয়ে গেলে অলকা হয়তো টেরও পাবে না। এতটুকুতে কিছুই হয় না। তার। বেশ একটু মৌজের অবস্থাতেই তাকে দেখতে অলকা অভ্যস্ত, সে অবস্থা না দেখলেই সে খুশি হবে।
কিন্তু যদি গন্ধ পায়? ছিটকে সরে গিয়ে তফাতে দাঁড়িয়ে মুখে বেদনা ও হতাশার সেই অসহ্য ভঙ্গি এনে থরথর কাঁপতে থাকে আবেগ উত্তেজনার চাপে? বুঝিয়ে বলার পরেও যদি সে শান্ত না হয়, সুস্থ না হয়?
কোথায় গড়ানো জীবন নিয়ে আজ সে দাঁড়িয়েছে জীবনের এই অবিস্মরণীয় পরিবেশে। ধিক্ তাকে। শত ধিক্!
কিন্তু কি হয় একটু খেলে? আজকের মতো পেগ খাবার এমন দরকার তো তার কোনোদিন আসে নি। শুধু শখ করে নেশার জন্যই খেয়েছে এতদিন। আজ একটু খেয়ে মাথাটা ঠিক করে নেওয়া তার বিশেষ প্রয়োজন, মনের একটু জোর না বাড়ালে তার চলবে না। দরকারের সময় ওষুধ হিসাবেও তো মদ খায় মানুষ?
কি এক দারুণ অস্বস্তিতে টান টান হয়ে গেছে শিরাগুলি অক্ষরের। ঘড়ির সেকেন্দ্রে কাটার মতো মনটা পাক দিচ্ছে উপরে উঠে নিচে নেমে ঘুরে ঘুরে। আর কখনন কি সে একসঙ্গে অনুভব করেছে মদ খাবার এমন দুরন্ত তৃষ্ণা আর প্রবল বাধা নিজের মধ্যে? সেই কখন থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ছোট ব্যালকনিতে। আলসের ভর দিয়ে ব্যথা ধরে গিয়েছে হাতে-পায়ে, শরীর আড়ষ্ট হয়ে এসেছে খানিকটা। ওরা তার চেয়ে অনেক আরামে বসে আছে পথে। তার মতো নিরাপদ ওরা নয় কিন্তু সেটা কি খেয়াল আছে ওদের কারো, বিপদ বা নিরাপত্তার কথা? দোকানের আলোগুলি আজ রাস্তায় পড়ে নি। ওপর থেকে স্তিমিত নিস্তেজ আলোয় পথের অবিস্মরণীয় নাটকের এখনকার শান্ত সম্ভাবনাপূর্ণ দৃশ্যটির অভিনয় ও অভিনেতাদের দিকে চেয়ে ভিতরে তোলপাড় চলতে থাকে। অক্ষয়ের। অগাধ বিষাদের সমুদ্রের সাইক্লোনিক মন্থনের মতো। এত ক্লান্তি আর এত শূন্যতা কি আছে আর কারো জীবনে? এতখানি অসুস্থতা, আত্মবিশ্বাস? চিন্তা আর অনুভূতির গভীর বিপর্যয়ের মধ্যেও কে যেন তারই মনের মধ্যে বসে মৃদু ব্যঙ্গের সুরে বলছে, নিজের সঙ্গে খেলা এসব মাতালের, এক পেগ টান সব ঠিক হয়ে যাবে, বাজে চিন্তা উড়ে যাবে কুয়াশার মতো, জীবন ভরে উঠে থইথই করবে আনন্দে কয়েকটা পেগ চালাবার পরেই।
নিজেই কি সে জানে তার কথারও কোনো মূল্য নেই, ভাবনা চিন্তা অনুভূতিরও কোনো অর্থ হয় না? এলকোহলের বাষ্প মাত্র সব?
নিজেকেই সে বিশ্বাস করে না।
অথচ মরণের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তো মানুষ নিজের ওপর বিশ্বাস বজায় রাখতে পারে। মরে যদি মরণটাও তার কাজে লাগবে, এ বিশ্বাস নিয়ে মরতে তো পারে মানুষ।
এ রকম বিশ্বাস ছাড়া বুঝি স্বাদ থাকে না জীবনের, যেমন তার গেছে। জীবনের স্বাদ না থাকলে বুঝি বিশ্বাসও থাকে না কোনো কিছুতে, তার যেমন নেই।
বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে হৈচৈ করে কত রাত কেটে যায়, কিন্তু সেই চরম আনন্দোচ্ছাসের মধ্যেও সে থেকেছে বিচ্ছিন্ন, স্বতন্ত্র, একা। সে শুধু আদায় করেছে নিজের সুখ, কামনা করেছে নিজের উপভোগ, হাজার খুঁটিনাটি হিসাব ধরে মনে মনে বিচার করেছে কতটুকু সে পেল, ওরা তাকে ঠকাল কতখানি! রাজপথের ওদের সঙ্গেও সে একতা বোধ করতে পারছে না, ওদের জন্যই যত চিন্তা জেগেছে তার মনে সব সে পাক খাওয়াচ্ছে নিজেকে কেন্দ্র করে।
কীর্তি ওদের, তাকে ছুতো করে সে একটু মদ খেতে চায় প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে। ওদের মৃত্যুঞ্জয়ী গৌরবকে আত্মসাৎ করে সে মেটাতে চায় তার উৎসবের বুভুক্ষা! ওরা তার কেউ নয়, তার কাছে ওদের মূল্য আর সার্থকতা শুধু এইটুকু যে ওরা তাকে দার্শনিক করে তুলেছে।