হাজার কণ্ঠের গৰ্জনে তার জবাব এল, কোথায় বসন্ত রায়? উপদেশ চাই না! হাঙ্গামা নেই, চুপ করে বসে আছি। বসে থাকব যতদিন দরকার! উপদেশ চাই না।
অতি কষ্টে লরি থেকে নেমে ভদ্রলোক হাত নেড়ে নেড়ে কিছুক্ষণ কথা কইলেন সার্জেণ্টদের দলপতির সঙ্গে, তারপর ব্যস্তসমস্তভাবে ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলেন তার গাড়ির দিকে পাশের রাস্তায়।
আবার শান্ত হয়ে গেল চারদিক।
আবদুল বলে, এবার চিনেছি–অমৃতবাবু। বসন্ত রায়ের একজন ফেট। সব মিটিঙে হাজির থাকে, বক্তৃতা দেবার খুব শখ। কিন্তু বিশেষ বলতে পায়ও না, বলতে পারেও না ভালো।
এমন লোককে পাঠানোর মানে? রসুল বলে বিরক্তির সুরে।
পাঠিয়ে দিল যাকে পেল হাতের কাছে।
এভাবে চলে যাবার হুকুম পাঠানো উচিত হয় নি। নিজে এসে সব জেনে বুঝে–
হৈচৈ হুল্লোড় নেই, হাঙ্গামা নেই, কিন্তু চারদিকের থমথমে ভাবটাই কেমন উগ্র মনে হয় রসুলের। ধৈর্যের পরীক্ষা যেন চরমে উঠেছে।
লাঠিচার্জ হবে না বোধহয়, আবদুল বলে।
কি জানি!
ব্যাপার কোথায় গড়াবে ভাবছি। দুপক্ষই চুপচাপ থাকবে এমনি ভাবে?
তাই কখনো থাকে। এক পক্ষ ভাঙবেই, ধৈর্য হারাবে।
আমরা চুপচাপ আছি। ওরা তো মিছেমিছি হাঙ্গামা বাধাবে না। তবে?
দেখা যাক। ডর লাগছে?
কিসের ডর? আমি তো একা নই।
কথাটা বড় ভালো লাগে রসুলের। এমন কিছু নতুন নয় কথাটা চমকে দেবার মতো, কিন্তু তারও অনুভূতির সঙ্গে মিলে যাওয়ায় মনের কথার প্রতিধ্বনির মতো মিষ্টি মনে হয়। জখমের, রক্তপাতের হয়তোবা মরণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোন মহাপুরুষের কিছুমাত্র ভয় হয় না জানা নেই রসুলের। তার বেশ ভয় করে, বেশ জোর করেই ভয়টা বশে রাখতে হয় তাকে। ভয় তাকে কাবু করতে পারে নি কোনোদিন কোনো অবস্থাতে এইটুকু সে সত্য বলে জানে, ভয় তার একেবারে হয় না এ মিথ্যাকে স্বীকার করতে লজ্জা তার হয়। নিজের কাছে বা পরের কাছে এর বেশি বাহাদুরি দেখাবার সাধ তার নেই, এইটুকুতেই সে সন্তুষ্ট। আজ ভয় ভাবনা বেশি রকম ক্ষীণ লাগছিল তার কাছে, বেপরোয়া সাহসের সঙ্গে নতুন একটা বিশ্বাসের, নিৰ্ভয়ের ভাব অনুভব করছিল। আবদুলের কথায় তার কাছে স্পষ্ট হয়েছে আবদুল ও তার সম অনুভূতি : সে একা নয়! আঘাতের বেদনা বা মৃত্যুর সমাপ্তি অনেকের মধ্যে ভাগাভাগি হয় যাবে।
লাঠিচার্জ শুরু হয় খানিক পরে।
এ পরিচিত ঘটনা রসুলের। বিশৃঙ্খলা, কোলাহল, মানুষের দিশেহারা ছুটোছুটির মধ্যেও সে অনুভব করে লাঠিচার্জের উদ্দেশ্য সফল হবে না নিরস্ত্র কতগুলি যুবক ও বালক জখম হওয়া ছাড়া। যারা নড়বে না ঠিক করেছে তাদের হঠানো যাবে না। দুজন পুলিশ এগিয়ে এসেছে কাছাকাছি। বেছে নেবার সময় ওদের নেই, এ ক্ষেত্রে সবাই সমানও বটে। রসুল পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে ডান দিকের পুলিশটার দিকে। ওদের সকলের মুখ তার চেনা মনে হয়, সবগুলি মুখ যেন এক ছাচে গড়া।
মাথা বাঁচাবার জন্য হাত দুটি সে উঁচু করে ধরে। লাঠি এসে পড়ে কাধের কাছে, বাহুমূলে–লাঠির গোড়ার দিকটা। লাঠি ধরেছিল যে হাত, সে হাত ইচ্ছে করে লাঠি তাকে মারে আগা দিয়ে নয়, মাঝখান দিয়ে নয়, গোড়ার দিক দিয়ে! ব্যথা একটু লাগে, কিন্তু রসুল তা অনুভব করতে পারে না। তার চোখ ছিল লাল পাগড়ির নিচেকার মুখটিতে আঁটা। স্পষ্ট দেখতে পায় লাঠি মারার সঙ্গে মুখটি তার চোখ ঠেরে চলে গেল।
আবদুল! দেখেছিস?
হুঁ। লেগেছে খুব? হাড় ভাঙে নি তো?
লাগে নি। একটুও লাগে নি। দেখি নি তুই?
কি? কি দেখি নি?
চোখের পলকের ঘটনা, কি দেখতে কি দেখেছে কে জানে! লাঠির গোড়ার দিকটা হয়তো এসে লেগেছে ঘটনাচক্রে। তবু রাজপথে বসে মনে মনে আকাশপাতাল আউড়ে যায় রসুল। সে যেন মুক্তি পেয়েছে, স্বাধীন হয়ে গেছে দেশের আকাশে মাটিতে খনিগহ্বরে সমুদ্রে। নিশ্বাসে সে স্বাদ পায় বাতাসের। পথের স্পর্শ তার লাগে অন্য রকম। গায়ের সেই সভায় যেন থেমে গিয়েছিল। তার মনের গতি, তারপর থেকে এতদিন যেন সে বাস করছিল সেই সভার দিনটি পর্যন্ত সীমা টেনে দেওয়া পুরোনো পরিবর্তনহীন জীবনে, পীড়ন পেষণ মৃত্যু দুর্নীতি হতাশার অভিশাপের মধ্যে। কিন্তু বদলে গেছে–সব বদলে গেছে। ভোঁতা অন্ধকার হৃদয়ে পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে নতুন চেতনাস্পন্দন। জোয়ার ঢুকেছে এঁদো ডোবায়।
ক্ষতচিহ্নটা কি মিলিয়ে গেছে? চিন্চিন্ করছে না যেন আর। মনে দাগ কেটে কেটে লেখা প্রশ্নটা হয়ে গেছে ঝাপসা, অকারণ। কেন যে এত ক্ষোভ, এত অসন্তোষ জাগিয়ে রেখেছিল সে একদিন একজনের অন্যায় করার নিয়মেরও ব্যভিচারে! ওরকম হয়। এটা সৃষ্টিছাড়া কিছু ছিল না, সে যেমন ভাবত। জগতে যে একা করে দেখে নিজেকে, জীবনে কোনো অন্যায় না করেও সেই পারে আত্মহত্যা করতে, অন্যায়ের আত্মগ্লানিতে সেই হতে পারে হিংস্র ক্ষ্যাপা পশু। পিছন থেকে অনায়াসে মানুষকে ছুরি মারে যে গুণ্ডা, সে শুধু গুপ্তাই থাকে যতদিন না পর হয়ে যায় তার অন্য সব গুণ্ডারা, একেবারে একা না হয়ে যায় তখন সে হয় বিকারেরও ব্যভিচার,শয়তান মানুষ থেকে আসল শয়তান!
আবদুল, এবার কিছু ঘটবে।
কি ঘটবে?
জবর কিছু দেখছি না ছটফট করছে?
গুলির আওয়াজের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রসুলের ডান হাতটা যেন খেয়ালখুশিতেই আচমকা ছিটকে লাফিয়ে উঠে অসাড় হয়ে পড়ে যায়।
আবদুল বলে, কোথায় লাগল দেখি?
ফাটা কপাল কিনা, ডান হাতটাতেই লেগেছে।
দুজনেরই পরনে পাজামা। একটি ছেলে তাড়াতাড়ি কেঁচার কাপড় খুলে খানিকটা ছিঁড়ে নেয়, পকেটের রুমালটা দলা পাকিয়ে ক্ষতমুখে চেপে বসিয়ে জোরে কাপড় জড়িয়ে বাঁধতে থাকে।