এবার লাঠিচার্জ হবে মালুম হচ্ছে আবদুল। হবে নাকি?
একটা সিগারেট দে তবে, টেনে নিই।
ক্ষতটা লাঠির, প্রশস্ত কপালের ডান পাশে চুলের ভেতর থেকে ডান চোখের ভুরু পর্যন্ত চিরস্থায়ী ক্ষতের যে দাগটা আছে। মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে যে এই পুরস্কার জোটে মানুষের, আজো বিশ্বাস করতে পারে না রসুল। দুর্ভিক্ষের সময় পড়া ছেড়ে দিয়ে সে গাঁয়ে ফিরে গিয়েছিল, কয়েকজনকেও যদি বাঁচাতে পারে। গায়ের নাম চিরবাগী, জমিদার শ্ৰীচপলাকান্ত বসু। গায়ে পৌঁছবার তিন দিন পরে দাফন-কাফন সারতে হয়েছিল তার নিজের মায়ের। না খেয়ে মা তার মরেন নি, অসুখে মারা যান। আকস্মিক এ আঘাতেও সে কাবু হয় নি, কোমর বেঁধে উঠেপড়ে লেগেছিল গাঁয়ে একটা রিলিফ সেন্টার খুলতে। হঠাৎ এক দিন তার কাছে হাজির হয়েছিল। জিয়াউদ্দীন, শ্ৰীচপলাকান্তের নায়েব জাতীয় স্থানীয় কর্মচারী। গাঁয়ের শতকরা আশি জন প্রজা মুসলমান। আসল নায়েব নকুড় ভট্টাচার্য, শাসন চালায় জিয়াউদ্দীন শত অত্যাচার চালালেও কেউ যাতে না বলতে পারে যে হিন্দু অত্যাচার করেছে মুসলমানের ওপর।
এ গাঁয়ে রিলিফ সেন্টার কেন? অন্য কোথাও কর গিয়ে। কর্তা বলেছেন, ওসব হাঙ্গামা এখানে চলবে না।
খেতে না পেয়ে গাদা গাদা লোক মরছে, তাদের কয়েকজনকে কোনো মতে জীবন্ত রাখার চেষ্টার নাম হাঙ্গামা! আসল কথা ছিল ভিন্ন। গায়ে রিলিফ সেন্টার হলে, মানুষ বাঁচানো আন্দোলন। চললে, বাইরের নজর এসে পড়তে পারে চিরবাগীর ওপর। জমিদারির আয়ে চলে না, তাই। শ্ৰীচপলাকান্ত কারবার করছিল। অন্যায় অনাচার নোংরামি মজুতদারি চোরাকারবার এ সমস্তের কি কার কাছে ধরা পড়ে কে জানে; ঘুষ খায় না এমন অফিসার একজনও যে নেই তাই-বা কে বলতে পারে!
তবু রসুল থামে নি। চালা তুলেছিল, খাদ্য জুগিয়েছিল, ভলান্টিয়ার গড়েছিল–নিজে পেছনে থেকে। খিচুড়ি বিতরণ আরম্ভ করার আগের দিন বিকালে লাল দিঘির ধারের মাঠে সভার আয়োজন করেছিল—নিজে পেছনে থেকে। দুর্ভিক্ষপীড়িতদের বাঁচাবার উদ্দেশ্যে ডাকা সেই সভায় কি করে দাঙ্গা বেধেছিল রসুল জানে না, সভার এক কোণে দাঙ্গা বাধার সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে লাল পাগড়ির আবির্ভাব হয়েছিল তাও সে বুঝতে পারে নি। লাঠির ঘায়ে কপাল ফাঁক হয়ে হাজার ফুলকি দেখে ঘুরে পড়বার ঠিক আগে এক লহমার জন্য লাল পাগড়ির নিচেকার মুখটি সে দেখেছিল, আজো সেই পৈশাচিক আক্ৰোশে বিকৃত মুখের ছাপ তার মনে আঁকা হয়ে আছে।
কেন এ আক্রোশ? কেন এ বীভৎস হিংসা? জগতের কোনো অন্যায়, কোনো অনিয়মের সঙ্গে খাপ খায় না, এ যেন অন্যায়ের অনিয়মেরও ব্যভিচার! মাথা ফাটাবার হুকুম পেয়েছিল, মাথা ফাটাক। ক্ষমতার দম্ভে প্রচণ্ড উল্লাস জাক মাথা ফাটাতে, তার মাথা তুলবার স্পর্ধায় রাগে ফেটে যাক কলিজা, সব সে মেনে নিতে রাজি আছে মানানসই বলে। কিন্তু সে-ই যেন যুগ যুগ ধরে অকথ্য অত্যাচারে জর্জরিত করেছে, অসহ্য যন্ত্রণা দিয়ে দিয়ে উন্মাদ করে দিয়েছে, এমন অন্ধ। উৎকট প্রতিহিংসার বিকার কেন?
রসুল জানে না। মনের পর্দায় প্রশ্নটা তার স্থায়ীভাবে লেখা হয়ে আছে ক্ষোভের হরফে।
প্রথম দিকে কোলাহল প্রচণ্ড হয়ে উঠেছিল সমবেত মানুষগুলির বিক্ষুব্ধ গর্জনে, এখন শান্ত হয়ে কলরবে দাঁড়িয়েছে। ছাত্রদের শৃঙ্খলা ও শান্ত সংযত চালচলনের প্রভাব জনতার মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে, সংযম হারিয়ে তাদের ক্ষেপে উঠবার সম্ভাবনা আর নেই। উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলার অভাবটা অদ্ভুত লাগে রসুলের, সে গভীর উল্লাস বোধ করে। ক্রোধে ক্ষোভে উত্তেজনায় ভরে গেছে নিশ্চয় বুকগুলি, কিন্তু মাথাগুলি ঠাণ্ডা আছে। রসুলের মনে হয়, সে যেন কত যুগ-যুগান্ত ধরে এমনি গরম হৃদয়ে ঠাণ্ডা মাথার সমন্বয় প্রার্থনা করে আসছিল তার দেশের মানুষের কাছে, আজ এখানে দেখতে পাচ্ছে তার কামনা পূর্ণ হবার সূচনা।
নিখুঁত ছাঁটের দামি সুন্দর পোশাক পরা সার্জেন্টরা দাঁড়িয়ে আছে দল বেঁধে, ওদের হৃদয়ে কি ভাব ও মনে কি চিন্তা ঢাকা পড়ে আছে বাইরের রাজকীয় নিশ্চিন্ত ও অগ্রাহ্যের সর্বাঙ্গীণ উদ্ধত ভঙ্গিতে? ওদেরই জন্য সৃষ্টি করা চাকরির গৌরব ও গর্বই বেচারিদের সম্বল, তারই মধ্যে ওরা সাত হাজার মাইল দূরের দ্বীপটির সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করে জন্মভূমির মাটিতে হাঁটবার সময়। চিরবাগী গায়ের নুরুলের রাজহাঁস দুটির কথা মনে পড়ে যায় রসুলের।
পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে দেশী পুলিশেরা, নির্বাক নিশ্চল। হুকুম জারি হয় নি এখনো চার্জ করবার। পাশের রাস্তার ভিড়ের শেষ প্রান্ত যতদূর সম্ভব ভেদ করে গাড়ি এগিয়ে এনে, গাড়ি থেকে নেমে ভিড় ঠেলে পুলিশের এলাকায় এসেছেন ব্যস্তসমস্ত এক ভদ্রলোক, অত্যন্ত উত্তেজিত বিব্রত আর অসহায় মনে হয় তাঁকে। এই শীতে গায়ে তাঁর আদ্দির পাঞ্জাবি, ফিকে মহুয়া রঙের দামি শাল অবশ্য আছে কাঁধে জড়ানো। ওঁর আবির্ভাবের জন্যই হয়তো স্থগিত রাখা হয়েছে লাঠিচার্জের হুকুম।
হাত নেড়ে নেড়ে ভদ্রলোক কি বললেন সার্জেণ্টদের দলপতিকে বোঝা গেল না, তারপর অতি কষ্টে তিনি উঠে দাঁড়ালেন একটি পুলিশবাহী লরির উপর। কোনো নেতা নিশ্চয়, রসুল চেনে না।
উনি কে রে আবদুল? জানি না।
চেনা চেনা লাগছে—
লরির ওপর দাঁড়িয়ে একটু দম নিয়ে ভদ্ৰলোক প্ৰাণপণে চিৎকার করে ঘোষণা করলেন, স্বয়ং বসন্ত রায় নির্দেশ পাঠিয়েছেন, হাঙ্গামা না করে সবাই ঘরে ফিরে যাক।