আগুনের হকা যেন বেরোয় নারায়ণের দুচোখ দিয়ে, অসহ্য জ্বালা যেন কথার রূপ নেয়, ওই টুপিওলাটার কাজ, টেনে নামিয়ে ছিঁড়ে খণ্ড খণ্ড করে ফেললে তবে ঠিক হয়। বসে আছে সব হাত গুটিয়ে। সবাই মিলে টেনে নামিয়ে ছিঁড়ে খণ্ড খণ্ড করে ফেললে—
গলা বুজে যায় নারায়ণের।
কি যে বলেন? ছেলেটি ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে বড় বড় টানা চোখে তাকিয়ে থাকে। আশ্চর্ষ সুন্দর ওর চোখ দুটি।
তোমার ইচ্ছে করে না খোকা—
আমার নাম রজত।
রজতঃ রজত নাম তোমার? তোমার ইচ্ছে করে না রজত, ওটাকে টেনে নামিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে?
করে তো, সবারই ইচ্ছে করে। কিন্তু শুধু ইচ্ছে করলেই তো হয় না? যা ইচ্ছে তাই করলে চলে নাকি!
এতটুকু ছেলের মুখে বুড়োর মতো কথা শুনে নারায়ণ একটু থতমত খেয়ে যায়। বুঝতে সে পারে যে যা-ই সে বলুক এরকম বুড়োর মতোই জবাব দেবে ছেলেটা, তবু সে বলে, সবাই মিলে তেড়ে গিয়ে ওদের কটাকে পিষে তেলে দিলে এরকম করতে সাহস পায় ওরা?
পায় না? কিছু বোঝেন না আপনি। গভীর দুঃখের সঙ্গে রজত বলে, তার সেই গুরুমশায়ী আফসোসের সঙ্গে কথা বলা এমন অদ্ভুত ঠেকে নারায়ণের কানে!—আমরা মারামারি করতে গেলেই তো ওদের মজা। তাই তো ওরা চায়। আমরা তো আর আমরা নই আর, এখন হলাম সারা দেশের লোক। ওরা জানে, বাড়াবাড়ি করলে চাদ্দিকে কি কাণ্ড বাবে। দেখছেন না রাগ চেপে শুধু খুখুচ্ ঘা মারছে? আমরা যাতে ক্ষেপে যাইঃ ইচ্ছে করলে তো দু মিনিটে আমাদের তুলোধুনো করে দিতে পারে, দিচ্ছে না কেন? আমরা যেই মারামারি করতে যাব, ব্যস্, আমরা আর দেশের সবাই থাকব না, শুধু আমরা হয়ে যাব। লোকে বলবে আমরা দাঙ্গা করে মরেছি। ঠোঁট গোল করে একটা অদ্ভুত আওয়াজ করে রজত, আপনাদের মতো রগচটা লোক নিয়ে হয়েছে মুশকিল। কিছু বোঝেন না, তিড়িং তিড়িং শুধু লাফাতে জানেন।
মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করে নারায়ণের! কিশোর ঠিক নয়, বালকত্ব ছাড়িয়ে সবে বুঝি কৈশোরে পা দিয়েছে। সে যেন আয়ত্ত করে ফেলেছে নবযুগের বেদ-বেদান্ত-উপনিষদ–সেকালের ঋষিবালকদের মতে, পুরাণেই যাদের নাম মেলে। এইটুকু ছেলে যদি এমন করে বলতে পারে এসব কথা, শক্তিপুত্র পরাশর যে মায়ের গর্ভে থেকেই বেদধ্বনি করে পিতামহ বশিষ্ঠের আত্মহত্যা নিবারণ করবে সে আর এমন কি আশ্চর্য কাহিনী।
তুমি কোন ক্লাসে পড় রজত? যে ক্লাসেই পড়ি না।
রাগ করলে? নারায়ণ অনুনয় করে বলে, যে ক্লাসেই পড়, সে কথা বলিনি। আমি অন্যকথা বলছিলাম।
কি বলছিলেন?
বলছিলাম কি, স্কুলে তো এসব শেখায় না, তুমি যে এসব কথা এমন আশ্চর্য রকম বোঝ, এসব তোমায় শেখাল কে?
রজত সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, আমিই শিখেছি, খানিকটা দিদি শিখিয়েছে। মুখ কাছে এনে অতি বড় গোপন কথা বলার মতো নিচু গলায় রজত বলে, ওইখানে দিদি বসে আছে তাকাবেন না। আমি এখানে আছি টের পায় নি।
নারায়ণ গম্ভীর হয়ে বলে, উনি কিন্তু টের পেয়েছেন রজত।
শুনে রজত ভড়কে যাবে ভেবেছিল নারায়ণ, কিন্তু রজত জিভে ঠোঁটে তার সেই অদ্ভুত আওয়াজটাই শুধু করে একবার।–টের পেয়েছে? আপনি কি করে জানলেন?
দু-তিনবার তোমায় ডাকলেন নাম ধরে। শুনতে পাও নি?
কোনো বিষয়ে এক মুহূর্তের জন্য ইতস্তত করা যেন স্বভাব নয় রজতের। ঘাড় উঁচু করে দিদির দিকে মুখ করে সে চেঁচিয়ে ডাকে, দিদি! ডাকছিলেন নাকি আমায়?
শান্তি বলে, এদিকে আয়। কথা শুনে যা।
কি করে যাব? রজত প্রতিবাদ জানায়, জায়গা বেদখল হয়ে যাবে আমার। আরো গলা চড়িয়ে বলে, যা বলবার বাড়িতে গিয়ে বোলো, কেমন?
অনেক দিন পরে নারায়ণ কেমন একটা স্বস্তি বোধ করে, নিদারুণ হতাশার জ্বালা যেন তার নেই অর। আশ্চর্যরকম শক্ত আর সমর্থ মনে হয় নিজেকে। তারই দুঃসহ আক্ৰোশের যে চাপ তাকেই ভেঙে চুরমার করে দেবে, সেটা যেন কার্যকরী শক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে সে অনুভব করে। পুঞ্জ পুঞ্জ সঞ্চিত যে ঘৃণা, জীবন্ত মর্মান্তিক ঘৃণা, অস্থির চঞ্চল করে রাখে তাকে সব সময়, নতুন করে নাড়া লাগলে যেন উন্মাদ করে তোলে, নিজে বয়লারের মতো শক্ত হয়ে সেই প্রচণ্ড ঘূণার বাষ্পকে সে যেন আয়ত্ত করেছে এখন, চাকা ঘুরবে এগিয়ে যাবার। তারই মতো এদের সবার বুকে ঘৃণা, এতটুকু ছেলেটার পর্যন্ত। কিন্তু সে আর পরাজিতের, পদদলিতের নিষ্ফল আক্ৰোশে জ্বলেপুড়ে মরার ঘূণা নেই, তা এখন জয়লাভের প্রেরণার উৎস।
রাস্তায় শুয়ে পড়ে যে ছেলেটি মোচড়া-মুচড়ি দিচ্ছিল তাকে সরিয়ে নিয়ে যাবার পরেও সেই স্থানটির দিকে কেমন এক জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে থেকে কি যেন ভাবে রজত। এতক্ষণ পাশে বসে আছে, এমন চিন্তিত তাকে নারায়ণ দেখে নি।
দিদি বকবে নাকি বাড়ি গেলে?
কেন? বকবে কেন?
কি তবে ভাবছ এত একমনে?
কি ভাবছি? বেশ একটু বিনয়ী, লাজুক ছেলের মতো কথা কয় রজত, ভাবছি কি, ওকে নিয়ে কবিতা লিখতে চাইলে কি করে লেখা যায়?
কাকে নিয়ে?
ওই যে মোচড়া-মুচড়ি দিচ্ছিল ছেলেটা।
তুমি কবিতা লেখ?
লিখি। ছাপতে দিই না, পরে দেব। দিদি বলে, লিখে লিখে হাত না পাকলে ছাপতে দিতে নেই। আচ্ছা, এরকম করে যদি আরম্ভ করা যায়? সাদা সওয়ারের প্রকাণ্ড ঘোড়া নাচে, বুক পেতে দেয় ছেলেরা খুরের নিচে। নাঃ, এ হল না। বুক পেতে দেবে কেন? অত সুখে কাজ নেই। কিন্তু–
রজত ভাবতে থাকে।
আয়োজন দেখে রসুল ভাবে, এবার লাঠিচার্জ হবে।
কপালের ডান দিকে পুরোনো ক্ষতের চিহ্নটা চিনচিন করে ওঠে তার। ক্ষতের এ দাগ মিলাবে না কোনোদিন, স্মৃতিও নয়। স্মৃতি মিলিয়ে যাবে হয়তো চোখ বোজবার আগেই, ক্ষতের দাগ মিলাবে না যত দিন পর্যন্ত কবরে সে মাটিতে পরিণত হয়ে না যায়।