সীতার চাউনিতে বোধহয় ঘূণাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
সব কিছু থেকে ওভাবে গা বাঁচিয়ে কারা লেখাপড়া শেখে জান ভালো ছেলে? দেশের প্রয়োজন, দেশের কথা যারা ভাবে তারা নয়, পাস করে পেশা নিয়ে নিজে আরামে থাকার কথা যারা ভাবে তারা। স্বদেশী মার্কা মালিকের পাপের ছুতো যেমন এই যুক্তি যে ইণ্ডাষ্ট্ৰিতেই দেশের উন্নতি, তোমাদের যুক্তিটাও তাই। ছাত্র আন্দোলন যারা করে তোমার চেয়ে তারা ভালো করে লেখাপড়ার দরকার বোঝে। তারাই জোর করে বলে ছাত্রদের, ডিসিপ্লিন বজায় রাখা প্রথম কর্তব্য। ছাত্রের, শিক্ষার যতটুকু সুযোগ আছে প্ৰাণপণে তা গ্রহণ করতে হবে প্রত্যেক ছাত্ৰকে, পরীক্ষায় পাস করাটা মোটেই অবহেলার বিষয় নয়। তাই বলে জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে তাদের কোনো যোগ থাকবে না? তারা প্রকাশ করবে না তাদের রাজনৈতিক মতামত, সংঘবদ্ধ হবে না তাদের দাবি, তাদের ক্ষোভ, তাদের দেশপ্রেমের প্রকাশকে জোরালো করে তুলতে?
তার ফল তো দেখতে পাচ্ছি ছাত্রজীবনে।
তার ফল? ছাত্রদের মধ্যে দলাদলি বেড়েছে, দুৰ্ম্মতি বেড়েছে? সেটা কিসের ফল হেমন্ত? দেশকে ভালবাসার, স্বাধীনতা দাবি করার, ছাত্রদের এক করার আন্দোলন চালানো, এ সবের ফল? তলিয়ে যা বোঝবার চেষ্টা পর্যন্ত কর না, কেন তা নিয়ে তর্ক কর? খারাপটাই দেখছ, অথচ তার কারণ কি বুঝতে চাও না, মনগড়া কারণ, মনগড়া দায়িক খাড়া করে তৃপ্তি পাও–আমার কথাই ঠিক! ভালো লক্ষণগুলি তো চোখেই পড়ে না।
সে আমার দোষ নয় সীতা। খারাপ লক্ষণগুলিই চোখে পড়ে, ভালোগুলি পড়ে না, তার সোজা মানে এই যে ভালো লক্ষণ বিশেষ নেই চোখে পড়বার মতো।
তুমি আজ এস হেমন্ত।
রাগে এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল হেমন্তের চিন্তা, জ্বালা ধরে গিয়েছিল বুকে। কিন্তু সে অল্পক্ষণের জন্য। সীতা তাকে শুধু সহ্যই করে এসেছে চিরকাল, আজ তার সেই ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল, এটা বিশ্বাস করা কঠিন হেমন্তের পক্ষে। সীতা চায়ও না চোখ-কান বুজে সে তার মতে সায় দিক, তার কথা মেনে নিক। মতের বিরোধ তাদের আজকের নয়, অনেকবার তাদের কথা কাটাকাটিতে যে উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছে তার তুলনায় আজকের তর্ক তাদের খুব ঠাণ্ডাই হয়েছে বলতে হবে। কেন তবে সে অসহ্য হয়ে উঠল আজ সীতার কাছে? এমন কোনো সিদ্ধান্তে কি সীতা এসে পৌঁছেছে তার সম্বন্ধে যার পর তার সঙ্গে ধৈর্য ধরে কথা বলা আর সম্ভব হয় না? বুদ্ধি দিয়ে কথাটা বোঝবার চেষ্টা করছিল হেমন্ত, কিছুই বুঝে উঠতে পারে নি। তখন হাল ছেড়ে দিয়ে ভেবেছিল, অত জটিলতার মধ্যে যাবার তার দরকার কি? মনটা হয়তো ভালো ছিল না সীতার কোনো কারণে। মেজাজটা হয়তো বিগড়েই ছিল আগে থেকে। মন কি ঠিক থাকে মানুষের সব সময়!
সীতার তীব্র বিরাগের রহস্য যেন একটু স্বচ্ছ হয়েছে এখন। দুটো-একটা ইঙ্গিত জুটেছে রহস্যটা আয়ত্ত করার। কতকগুলি বিষয়ে বড় বেশি সে গোড়া হয়ে পড়েছিল সন্দেহ নেই। পৃথিবীটা সত্যই অনেক বদলে গেছে। কল্পনাতীত ঘটনা সত্য সত্যই আজ ঘটছে তারই চোখের সামনে; দেশের মানুষের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে, ছেলেদের মধ্যেও। নতুন ভাব, নতুন চিন্তা, নতুন আদৰ্শ, নতুন উদ্দীপনা এসেছে নতুন চেতনার লক্ষণ মোটই আর অস্পষ্ট নয়। তারই শুধু এসব চোখে পড়ে নি। নিজের পুরোনো ধারণা, পুরোনো বিশ্বাসের স্তরেই সে ধরে রেখেছিল দেশকে চোখ-কান বুজে, ভেবেছিল তার মন এগোয় নি বলে দেশটাও পিছনে পড়ে আছে তারই খাতিরে!
এই গোঁড়ামি সহ্য হয় নি সীতার। মতের অমিলকে সীতা গ্রহণ করতে পারে সহজ উদারতায়, অন্ধ গোঁড়ামি তার ধৈর্যে আঘাত করে।
০২. ঘোড়ার পায়ে পিষে ফেলবার চেষ্টা
ঘোড়ার পায়ে পিষে ফেলবার চেষ্টার পর ঘোড়সওয়ারেরা তখন ফিরে গেছে। পাশের ছেলেটি বলছিল : কি সুন্দর ঘোড়াগুলি! তালে তালে পা ফেলছে আর মাসেলগুলিতে যেন ঢেউ খেলছে। নেচে নেচে।
বয়স তার পনের-ষোল বছরের বেশি হবে না। রোগা চেহারা, ফর্সা রং, খুব ঢেঙ্গা। আলোয়ানটা এমন করে গায়ে জড়িয়েছে আরাম করার ভঙ্গিতে যেন আসরে বসেছে গান-বাজনা শুনে বা সিনেমা থিয়েটার দেখে উপভোগ করতে।
কত তোয়াজে থাকে। বলেছিল চশমাপরা যুবকটি গম্ভীরভাবে। তার উৎসুক দৃষ্টি ক্রমাগত সঞ্চালিত হচ্ছিল এদিক হতে ওদিক, মনে মনে সে যেন মাপছে ওজন করছে হিসাব কষছে যাচাই করছে ছোট-বড় ঘটনা ও পরিস্থিতির বিশেষ এক মূল্য।
এমন ইচ্ছে করছিল ঘোড়ার গা চাপড়ে দিতে! ঢেঙ্গা ছেলেটি বলেছিল নির্বিকারভাবে, মাথাটা বোধহয় ফাটিয়ে দিত তা হলে।
দিত কি? একটা কেমন খটকা লেগেছিল নারায়ণের মনে। তাদের কাছ দিয়ে যে ঘোড়াটি ঘুরে গেছে, ওর ছেলেমানুষি চোখ দেখেছে তার মসৃণ চামড়ার নিচে পরিপুষ্ট মাসেলের নাচ, নারায়ণের চোখ দেখেছে পাগড়ি-আঁটা বিশাল গোঁফওলা অতি জবরদস্ত চেহারার ভারতীয় সওয়ারটির ঘোড়া চালাবার কায়দার মধ্যে অনিচ্ছার সঙ্কেত, দ্বিধা, গোপন সতর্কতা। খেলার মাঠে এদের বেপরোয়া ঘোড়া চালানো দেখেছে নারায়ণ অনেকবার। আজকের চালানোটাই যেন অন্যরকম।
সত্যই কি দেখেছে, না সবটাই তার কল্পনা? অথবা এই রকম ওদের রাজপথের জনতা ছত্রভঙ্গ করার রীতি?
রীতি যাই হোক, জখম হয়েছে অনেক।
ইস্।
হাঁটুতে ভর দিয়ে মাথা উঁচু করে ঢেঙ্গা ছেলেটি বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে। নারায়ণও চেয়ে থাকে। রাস্তায় শুয়ে পড়ে মোচড়া-মুচড়ি দিচ্ছে একটি আহত ছেলে।