গণেশকে খুঁজতে এসেছ?
যাদব বলে, আজ্ঞা হ্যাঁ। আছে না গণেশ?
এ প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে দাশগুপ্ত বলে, তুমি কে গণেশের?
গণেশ চুরি করে পালিয়েছে বলে ওদের ভড়কে দিলে চলবে না, অন্য কিছু বলতে হবে। লাগসই কি বলা যায় দাশগুপ্ত ভাবতে থাকে।
গণেশ আমার ছেলে বাবু। দেশ গাঁ থেকে আসছি আমরা।
ও! দাশগুপ্ত বলে উদাসভাবে, এখন তো গণেশ এখানে নেই।
কখন ফিরবে বাবু?
গণেশ কি জান, ছুটি নিয়ে গেছে কদিনের। কোথায় যেন যাবে বলল, নামটা মনে পড়ছে। না। কারা সব সঙ্গী জুটেছে, তাদের সঙ্গে গেছে। তিন-চার দিনের মধ্যেই ফিরবে।
হাসপাতালে অথবা মর্গে যার মৃতদেহটায় হয়তো এখন পচন ধরেছে, অনায়াসে দাশগুপ্ত তার বাপ-মা-ভাইবোনদের জানায় সে ফিরে আসবে তিন-চার দিনের মধ্যে, এতটুকু বাধে না। তার ভাবভঙ্গিটা শুধু রাণীর কাছে একটু কেমন কেমন লাগে।
তবে তো মুশকিল। আমরা এখন যাই কোথা! যাদব বলে হতাশ হয়ে।
কোনো খবর না দিয়ে কিছু ঠিক না করে এ ভাবে এলে কেন বোকার মতো?
দাশগুপ্ত বলে রাগ আর বিরক্তি দেখিয়ে, কয়েক মুহূর্ত ভাববার ভান করে, তারপর যেন অনিচ্ছার সঙ্গে বলে, এইখানেই থাক এখনকার মতো, কি আর করা যাবে!
বলে সংযম হারিয়ে রাণীর ওপর একবার নজর না দিয়ে পারে না।
রাণী বলে, বাবা বদ্যি মশায়ের ছেলে তো আছেন। তাঁর কাছে গেলে সব ব্যবস্থা করে দেবেন।
যাদব ইতস্তত করে। কেশব বদ্যির ছেলে থাকে হাওড়ায়, আবার সেখানে ছুটবে এত পথ হেঁটে! গিয়ে যদি তাকেও না পাওয়া যায়, কি উপায় হবে তখন।
দাশগুপ্ত বলে, কোথায় যাবে আবার, এখানেই থাক। একটা ঘর ছেড়ে দিচ্ছি তোমাদের।
রাণী বলে, বাবা, শোন।
যাদব কাছে এলে চুপিচুপি বলে, না বাবা, এখানে থাকা চলবে না। বারু লোক ভালো না। মোর ভরসা হচ্ছে না মোটে। শেষকালে গোলমাল হবে, চাকরিটা যাবে দাদার।
যাদব তখন বলে দাশগুপ্তকে, আজ্ঞে, দেশের এক ভদ্রলোক পত্র দিয়েছেন, আমরা তার ছেলের ওখানেই যাই। আপনার এখানে হাঙ্গামা করব না বাবু।
যা খুশি তোমাদের! দাশগুপ্ত বলে।
সময়টা তার খারাপ পড়েছে সত্যি দাশগুপ্ত ভাবে।
ধীরে ধীরে আবার তারা পথে নেমে যায়। আবার দীর্ঘ পথ হাঁটতে হবে। স্টেশন থেকে এতদূর হেঁটে এসেছে, এবার স্টেশন পার হয়ে অনেক দূরে যেতে হবে। যে পথে এসেছিল সেই পথেই আবার তারা লালদিঘির দিকে চলতে আরম্ভ করে।
গণেশের মা বলে, ছুটি নিয়ে কোথায় বেড়াতে গেল গণেশ? মোদের জানাল না কিছু চিঠিতে, কিছু বুঝি না বাবু ব্যপার স্যাপার।
শহরে এসে স্যাঙাৎ জুটেছে ছেলের। যাদব বলে ঝাঁঝের সঙ্গে।
অমন কথা বোলো না গণশার নামে। সে আমার তেমন ছেলে নয়।
লালদিঘির দিকে বাঁক ঘুরবার মোড়ের কাছাকাছি এলে দূরাগত জনতার কলরব তাদের কানে ভেসে আসে।
লালদিঘির সামনাসামনি পৌঁছে তাদের থামতে হয়। চারিদিক লোকারণ্য, ভিড় ঠেলে এগোন অসম্ভব। বিরাট এক শোভাযাত্রার মাথা লালদিঘির ওদিকের মোড় ঘুরছে, সামনে তিনটি তিন রকম বড় পতাকা উড়ুরে হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে। শোভাযাত্রার শেষ এখনো দেখা যায় না। ক্ষণে ক্ষণে ধ্বনি উঠছে হাজার কণ্ঠে। এবার যাদবের মনে হয়, বাঘ যেন ডাক দিচ্ছে মনের আনন্দে।
সামনে তারা দেখতে পায় অজয়কে।
মানুষ ঠেলে তারা অজয়ের কাছে যায়। যাদব ডাকে, বাবু!
অজয় ফিরে তাকায় না। যাদব শুনতে পায় সে নিজের মনে বলছে : আমরা এগিয়েছি। ঠেকাতে পারে নি, আমরা এগিয়েছি!
ঘাড় উঁচু হয়ে গেছে অজয়ের, দুটি চোখ জ্বলজ্বল করছে আনন্দে, উত্তেজনায়। যাদব চেয়ে দ্যাখে, সে হাসছে। মুখে যেন তার সূর্য উঠেছে মেঘ কেটে গিয়ে।