না। লাগে নি।
তখন যাদব আবার পোস্টকার্ডটি বার করে সামনে ধরে বলে, বাবু এ ঠিকানায় কোন্ দিকে যাব?
দাঁড়াও বাবু একটু, অজয় বলে তার দিকে বা ঠিকানার দিকে না তাকিয়েই।
খানিক পরে নিজে চলতে আরম্ভ করে অজয় থেমে যায়। যাদবকে বলে, কি বলছিলে তুমি?
ঠিকানা পড়ে বলে, ডালহাউসী স্কোয়ার চেনো? লালদিঘি?
লালদিঘি? চিনি বাবু।
বাঃ, তবে আর ভাবনা কি? লালদিঘি চারকোনা তো, পুবে দুটো কোণ আছে। পুব-উত্তর কোণে একটা, পুব-দক্ষিণ কোণে একটা। যে কোনো কোণ থেকে পুবের রাস্তা ধরে এগোবে বুঝলে?
যাদব মাথা নাড়ে।
কেন, বুঝলে না কেন? দুকোণ থেকে দুটো রাস্তাই পুবে গেছে, দশটা নয়। লালবাজারের সামনে দিয়ে গেলে বৌবাজারের মোড় হয়ে ডাইনে বাকবে–মিশন রোড হয়ে গেলে ট্রামরাস্তা পার হবে, তারপর একজন কাউকে জিজ্ঞেস করলেই
যাদব নীরবে পোস্টকার্ডটি ফিরিয়ে নেয়।
অজয় এবার গম্ভীর মুখে বলে, তবে আমার সঙ্গে এস। আমিও লালদিঘি যাচ্ছি। কিন্তু এই রাস্তা দিয়ে যাব আমি। অন্য রাস্তা নেই। সঙ্গে এসে ছেলেমেয়ে নিয়ে মুশকিলে পড়তে পার। বুঝে দ্যাখ।
রাণী বলে, চলুন যাই।
জোরে জোরে হেঁটে সে এগিয়ে যায়। লাল গোপের কাছ দিয়েই হাঁটতে থাকে। এবার কিন্তু লাল গোপ তাকিয়েই থাকে শুধু। খানিক দূরে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল হওয়ায় যাদবদের জন্য অজয় থেমে দাঁড়ায়। আবার এগোয়, আবার থামে। তার বিরক্তিভরা মুখ দেখে যাদব অস্বস্তি বোধ করে। তবে জাল পেতে বোকা হাবা গেঁয়ো লোক ধরা শহুরে বেদে এ ছোকরা নয়, এটা সে বিশ্বাস করে অনায়াসে।
একবার বলে যাদব কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষায়, মোদের তরে মিছিমিছি হাঁটতে হল বাবু আপনাকে।
না বাপু হাঁটতে আমাকে হতই, একটু বেশি হাঁটা হচ্ছে। কি করি বল, তোমরা তো নাছোড়বান্দা।
জেটি শেড ডাইনে রেখে তারা সোজা এগোতে থাকে। চারিদিকে কর্মহীন স্তব্ধতা উগ্র প্রতীক্ষার মতো। শেডের ফাঁক দিয়ে রাণী মস্ত চোঙালা বিদেশী জাহাজের দিকে তাকায় মুখ ফিরিয়ে ফিরিয়ে, ভালো করে না দেখতে দেখতে আড়াল হয়ে যায় সেগুলি।
বিদ্যুৎ লিমিটেড খুঁজে পাওয়া যায় সহজেই এতখানি রাস্তা হেঁটে গিয়ে খুঁজে বার করার কষ্টটা ছাড়া। কিন্তু দোকান বন্ধ দেখে তারা হতভম্ব হয়ে যায়। যাদব বলে, কি সৰ্বনাশ!
অজয় রাগ করে বলে, তোমার ঠিকানা ভুল হয়েছে। যা খুশি কর তোমরা, আমি চললাম।
সে অবশ্য যায় না। শোভাযাত্রায় যোগ দিতে মনটা যতই ছটফট করুক, এ বেচারিদের একটা হিল্লে না করে ফেলে যাওয়া যায় কেমন করে। যাদবের কাছ থেকে গণেশের চিঠিখানা চেয়ে। নিয়ে আরেকবার সে ঠিকানা মিলিয়ে দ্যাখে। ঠিকানা ঠিক আছে। এই দোকানেই গণেশ কাজ করে। এখন দোকানের মালিকের বাড়ির ঠিকানা খুঁজে বার করতে হবে। তার কাছে যদি গণেশের খোঁজ মেলে।
অত বড় আঁকাবাঁকা হরফে লেখা চিঠিখানা পড়ে অজানা গণেশকে ভালো লেগেছিল অজয়ের। চিঠির প্রতি ছত্রে অশুদ্ধ গ্ৰাম্য কথাগুলিতে ফুটে উঠেছে মা-বাপ-ভাই-বোনের জন্য গণেশের মমতা, ওদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য শহরে তার প্রাণপণ লড়াইয়ের ইঙ্গিত, কত যে ভরসা দেওয়া আছে চিঠিতে আর তাতেই ধরা পড়ছে অতি কঠিন অবস্থাতেও গণেশের তেজ আর আত্মবিশ্বাস। কিন্তু গণেশের বুদ্ধি বড় কম। যে দোকানে কাজ করে সেখানকার ঠিকানাটা শুধু না দিয়ে, যেখানে
সে থাকে সে ঠিকানাটা তার দেওয়া উচিত ছিল।
বাড়ির দারোয়ানকে প্রশ্ন করে তার জবাব শুনে অজয় স্বস্তি বোধ করে। গণেশের বুদ্ধির ক্ৰটিটাও মাফ করে ফেলে। বিদ্যুৎ লিমিটেডের মালিক এই বাড়িরই ওপরে থাকে এবং গণেশও তার কাছেই থাকে এ খবর জেনে যাদবেরাও নিশ্চিত হয়।
রাণী বলে খুশি হয়ে, মা গো! ভড়কে গিয়েছিলাম একেবারে। বাঁচা গেল।
অজয় বলে, আমি তবে যাই এবার?
যাদব গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বলে, হ্যাঁ, বাবু, আপনি এবার আসুন। অনেক করলেন মোদের জন্য।
সায় দেবার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে তার কৃতজ্ঞতাকে গ্রহণ করে অজয় নীরবে বিদায় হয়ে যায়।
যাদব আবেদন জানায় দারোয়ানকে, গণেশকে একবার ডেকে দেবেন দারোয়ানজি?
দারোয়ানজি উদাসভাবে বলে, ও হ্যায় কি বাহার গিয়া মালুম নেই। যাও না, উপর চলা যাও না?
গণেশের বাড়ির লোক তার খোঁজ করতে এসেছে শুনে দাশগুপ্ত বিরক্ত হয়ে নিজেই উঠে আসে। গণেশের কথা কি বলবে মনে মনে তার ঠিক করাই আছে। দোকানের জিনিস নিয়ে গণেশ পালিয়েছে, সে চোর। পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে, গণেশকে একবার ধরতে পারলে জেল খাঁটিয়ে ছাড়বে। এসব বলে ভড়কে দিতে হবে ওদের, যাতে কোনোরকম হাঙ্গামা করতে সাহস না পায়। দাশগুপ্তের অবশ্য ভয়-ভাবনার কিছু আর নেই, তবু সামান্য হাঙ্গামাও সে পোহাতে চায় না গণেশের বোকার মতো গুলি খেয়ে মরার ব্যাপার নিয়ে। এমনিতেই সর্বদা তাকে কত ঝঞাট নিয়ে থাকতে হয়। তার ওপর আবার গণেশের সম্বন্ধে খোঁজখবর-তদন্তের জন্য দশটা মিনিট সময় দিতে হবে ভাবলেও তার বিরক্তি বোধ হয়।
ফ্ল্যাটের সদর দরজার ঠিক সামনে ঘেঁষাৰ্ঘেষি করে তারা দাঁড়িয়ে ছিল। ভাইকে কাখে নিয়ে রাণী দাঁড়িয়েছে বাকা ও পরিস্ফুট হয়ে। তার দিকে নজর পড়তেই দাশগুপ্তের চোখ পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকে কয়েকবার দেখে নেয়, রাণীর মুখে যে মৃদু বিরক্তির চিহ্ন ফুটে ওঠে তাও তার চোখে ধরা পড়ে। চিন্তাধারা সঙ্গে সঙ্গে বদলাতে শুরু করে দাশগুপ্তের। তাই, গোড়াতেই প্ৰেষ্টিজ হারাতে না চেয়ে সে ইচ্ছে করে মস্ত হাই তুলে মুখ-চোখের ভাব বদলে নির্বিকার গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তোলে।