আঁচল দিয়ে চোখের জলের সঙ্গে মুখের হাসিটুকুও যেন মা মুছে নিয়েছিলেন।
এখন আর ভাবনার কিছু নেই তো?
এমনি করেই কিন্তু হ্যাবিট জন্মায় হেমা, ইচ্ছা না থাকলেও।
মার কথা ভেবে মায়া বোধ করে হেমন্ত, কিন্তু কেমন এক বৈরাগ্য মিশে সে মায়াববাঁধের ব্যাকুলতা আর উদ্বেগকে নিরস্ত করেছে এখন। মাকে মনে হচ্ছে দূরে, বহু দূরে। এখান থেকে ট্রামে বাড়ি যেতে সময় লাগে মোটে মিনিট পনের, সেখানে মা হয়তো আকুল হয়ে আছেন। তার জন্য, কিন্তু বিরাট এক বাস্তব সত্য যেন দুস্তর ব্যবধান রচনা করে দিয়েছে রাজপথের এই শক্ত ফুটপাত আর মায়ের অগাধ স্নেহ, অসীম শুভ কামনা অনন্ত দুর্ভাবনা ভরা সেই নীড়ের মাঝখানে, শান্তি আর যুদ্ধের সময়কার জগতের মতো অতি ঘনিষ্ঠ অথচ অসীম দূরত্ব ও পার্থক্যের ব্যবধান।
এখন কি যেতে পারে না সে বাড়ি ফিরে? একেবারে প্রথম দিনের পক্ষে এই কি যথেষ্ট হয় নি, আজ আর নাইবা এগোল? নিজের মনেই মাথা নাড়ে হেমন্ত।
একা উঠে চলে যাওয়া যায় না একার প্রয়োজনে। না এলে ভিন্ন কথা ছিল, এখন আর ফিরে যাওয়া চলে না। তার না হয় মার জন্য অবিলম্বে বাড়ি ফেরা একান্ত দরকার, একা হলে আরও না হয় সে মেনে নিত সেজন্য নিজের কাছে অপমানে নিজে কালো হয়ে গিয়ে, কিন্তু এদের সকলকে হার মানাবার অধিকার তো তার নেই। সে উঠে গেলে আর একজন দুজনও যদি তার অনুসরণ করে?
সীতাকেও মনে পড়ে হেমন্তের।
মার মতোই তাকেও মনে হয় বহু দূর, কুয়াশাচ্ছন্ন। মার মতো বড় বড় চোখ নেই সীতার, তাই বোধহয় চোখ দুটি পর্যন্ত তার কল্পনার সীমান্তে সরে গেছে ধারণা হয়। সীতার মৃদু ও তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ, আচমকা ঘনিয়ে আসা গাম্ভীর্য, তিক্ত বিষাদ আর কটু অনুকম্পা ভরা কথা এবং কদাচিৎ হেমন্ত যে কোন শ্রেণীর জীব ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারছে না এমনি বিব্রত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা, এসব যেন প্রায় ভুলে যাওয়া অতীতের স্মৃতিতে পরিণত হয়ে গেছে, এসবের জন্য যে প্রতিক্রিয়া জাগত নিজের মধ্যে তাই যেন হেমন্তের অবলম্বন।
অথচ, আজকেই দেখা হয়েছিল সীতার সঙ্গে।
এস ভালো ছেলে বলে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল সীতা। বলেছিল, ক্লাস হল না বলে কষ্ট হচ্ছে? মন খারাপ? কি করব বল! সবাই তো বিদ্যালাভ করেই খুশি থাকতে পারে না, অন্যায়-টন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে চায়।
আজ যেন রীতিমতো ঝাজ ছিল সীতার কথায়, শুধু ব্যঙ্গাত্মক খোঁচা নয়। হেমন্তের মনে হয়েছিল, সে যেন শেষ পর্যন্ত সন্দিহান হয়ে উঠেছে তার মনুষ্যত্ব সম্বন্ধে। তার সঙ্গে মতে না মিলুক, তার নিরুত্তাপ রক্ষণশীল মতিগতিকে অবজ্ঞা করুক, তার একাগ্র নিষ্ঠা, নিরুপদ্রব সহনশীলতা, দুঃখী মায়ের জন্য তার ভালবাসা, এসবের জন্য খানিকটা শ্ৰদ্ধা তাকে সীতা বরাবর দিয়ে এসেছে। আজ যেন সে শ্ৰদ্ধাও সে রাখতে পারছে না মনে হয়েছিল হেমন্তের, তাকে যেন সহ্য করতে পারছে না সীতা।
অন্যায়ের প্রতিবাদ করা উচিত বৈকি।
তবে?
বিদ্যালাভে অবহেলা করাও অন্যায়, অন্যায় সহ্য করাও অন্যায়।
তবে?
তখন হেমন্ত বুঝেছিল সীতার জ্বালার মর্ম। কিছু না বলেও সীতা তাকে প্রশ্ন করেছে, আজো তুমি নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকবে তোমার আদর্শবাদী সুবিধাবাদের আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতার অজুহাতে? আজো তুমি এটুকু স্বীকার করবে না যে শিক্ষার্থীকেও আজ অন্তত ভাষায় ঘোষণা করতে হবে এ অন্যায়ের দেশব্যাপী প্রতিবাদকে সে সমর্থন করে, সেটা রাজনীতিচর্চা হোক বা না হোক?
জবাব দিতেই হবে সীতার এই অনুচ্চারিত প্রশ্নের। গভীর বিষাদ অনুভব করেছিল হেমন্ত। সীতা কি বুঝবে তার কথা?
আমার কি মুশকিল জান সীতা? হেমন্ত ভূমিকা করেছিল, আমি সিরিয়াসলি কথা বললেও তুমি সিরিয়াসলি নিতে পার না।
কথা! তোমার শুধু কথা!
তা ছাড়া কি করার আছে? প্রতিবাদ যে জানানো হবে, তাও তো কথাতেই?
তখন কি হেমন্ত জানত মৰ্মে মর্মে উপলব্ধি করা কথা কত সহজে কি অনিবার্যভাবে কাজে রূপান্তরিত হতে পারে? কণ্ঠের প্রতিবাদ পরিণত হতে পারে জীবনপণ ক্রিয়ায়!
সীতা চুপ করে থাকায় আবার সে বলেছিল, কথাকে অত তুচ্ছ কোরো না সীতা। মানুষ বোবা হলে পৃথিবীটা অন্য রকম হত। ও সব বড় দার্শনিক কথায় যাব না। আমার কথাটা মন দিয়ে। শুনবে কি শান্ত হয়ে? তুমি তো জান, আমি যা বলি তাই করি। কথার প্যাচও কষি না, ফঁকিবাজি কথাও বলি না।
শুনি তোমার কথা।
তুমি কি বুঝবে আমার কথা?
পারবে বুঝিয়ে দিতে?
অতি বিশ্ৰী, অতি নীরস নীরবতা এসেছিল কিছুক্ষণের।
সাহস সঞ্চয় করে হেমন্ত বলেছিল তারপর, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে নিশ্চয়, কিন্তু তারও তো নিয়ম আছে, যুক্তি আছে? ধর তুমি আমার সঙ্গে আছ, কেউ তোমায় অপমান
করল। তখন সোজাসুজি ঘুসি মেরেই আমি সে অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাব।
সে এক পুরোনো ঘটনা। আজকের বক্তব্য বুঝিয়ে দেবার জন্য তার সেই বীরত্বের ইঙ্গিত সে কেন করেছিল হেমন্ত জানে না। এই উদাহরণ দিয়ে তার বক্তব্য খুব সহজে স্পষ্ট ও পরিষ্কার করে। বলা যেত বটে কিন্তু সেটা অন্য ভাবেও বলা যেত।
আমি ভুলি নি ভালো ছেলে। কৃতজ্ঞ আছি।
সেজন্য তুলি নি কথাটা হেমন্তকে বলতে হয়েছিল চাবুকের জ্বালা হজম করে, আমার কথা শুনলেই বুঝতে পারবে। এ ক্ষেত্রে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা কর্তব্য ছিল, করেছিলাম। পরাধীন। দেশে হাজার হাজার অন্যায় চলে, তার প্রতিবাদ করতে গেলে আমি দাঁড়াই কোথায়? দেশে চল্লিশ কোটি লোক, তার মধ্যে আমরা কজন লেখাপড়া শিখছি তুমি জান। এ ক্ষেত্রে আমাদের ভালো করে লেখাপড়া শেখাটাই কার্যকরী প্রতিবাদ, লড়াই করা। শিক্ষিত লোকের কত দরকার দেশে, আমরা সামান্য যে কজন সুযোগ পেয়েছি, তারা নাই-বা গেলাম হৈচৈয়ের মধ্যে?