রাণী যুঁসে ওঠে। কতটা হাঁটতে হবে, দাঁড়িয়ে থেকো নি বাবা। যেতেই হবে তো দাদার। কাছে আজ। চল এগোই মোরা। চল।
যাদব তাকায় ভদ্রলোকের মুখের দিকে, মুখটা সত্যি সুবিধের নয়! আর তাও বটে, নজরটা বাবুর আটকে আছে রাণীর ওপর।
ছেলের কাছে যেতেই হবে বাবু, মরি আর বাঁচি।
চল না এগগাই? রাণী ধমকের সুরে বলে নিজে চলতে আরম্ভ করে দিয়ে, যাদবও চলতে শুরু করে। মুখ ফিরিয়ে দেখতে পায়, সিগারেট ধরিয়ে পুলের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বাবু গঙ্গার শোভা দেখছেন একমনে।
পুল পেরিয়ে যে দৃশ্য চোখে পড়ে তাতে রীতিমতো খটকা লাগে যাদবের যে, বাবুটি মিছে বলে ভাওতা দিতে চেয়েছিল তাদের, না সত্যি যা ঘটেছে তারই সুযোগ নিতে চেয়েছিল সত্যি কথা বলে। বড় একটা গাড়ি দাউ দাউ করে পুড়ছে মোড়ের মাথায়, এ পাশে পুড়ে কালো হয়ে কঙ্কাল পড়ে আছে দুটো ছোট গাড়ির। ইটপাটকেলে ভরে আছে রাস্তা। এ ধারে এক পাশে কয়েক জন মিলিটারি সায়েব আর একদল গুর্খা সেপাই দাঁড়িয়ে দেখছে, ওধারে মোড়ের মাথা থেকে রাস্তার ভেতরে অনেক দূর পর্যন্ত লোকারণ্য, এমন আওয়াজ তুলেছে তারা যেন অনেক গণ্ডা আহত বাঘ ফুঁসছে এক সাথে।
কি করে কোথা দিয়ে তারা যাবে?
আশপাশের লোকদের মধ্যে ছিটের শার্টের ওপর কমদামি পুরোনো আলোয়ান জড়ানো গরিব গগাছের একটি ভদ্রলোকের ছেলে দাঁড়িয়েছিল। কয়েকবার তার মুখটি খুর নজরে দেখে যাদব গণেশের পোস্টকার্ডখানা বার করে। কিন্তু কাছে গিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করবার আগেই ছেলেটি হটতে আরম্ভ করে দেয়। বায়ে যে দিকের রাস্তার মোড়ে ও ভেতরে ভিড় জমেছে সে দিকে নয়, ডাইনে যে দিকে প্রায় কঁকা রাস্তা মিলিটারি দখল করে আছে, সে দিকে।
হাসপাতালে আহত একটি ছেলের আত্মীয়ের আসবার কথা ছিল, অজয় স্টেশনে এসেছিল। তাকে ছেলেটির খবর জানিয়ে দিয়ে যাবার জন্য। ছেলেটির অবস্থা ভালো নয়। আত্মীয়টি আসেন নি, অথবা এসে থাকলেও চেহারার বর্ণনা শুনে চিনে উঠতে পারে নি। ফিরবার সময় পুল পার হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক অদ্ভুত অসহনীয় দৃশ্য দেখছিল অজয়। ভিড় সরে এসে জমা হয়েছে এপাশে, ওপাশের রাস্তা দিয়ে তোক চলেছে খুব কম–জরুরি দরকার না থাকলে ওপথে প্রাণ হাতে করে অকারণে কে চলতে চাইবে। ইটপাটকেলে ভর্তি হয়ে আছে রাস্তাটা, সেই রাস্তা সাফ করছে দশবারজন ভদ্রলোক। ওদের ধরে জোর করে রাস্তা সাফ করানো হচ্ছে। সাদা নীল স্ট্রাইপ কাটা শার্ট গায়ে এক ভদ্র যুবককে বেঁটে লালচে গোঁফওলা একজন অফিসার ফুটপাত থেকে টেনে নামিয়ে রাস্তা পরিষ্কারের কাজে লাগিয়ে দিল। ওরা কি জানে না মুখ বুজে এ জুলুম সহ্য করা পাপ? কি বলে ওরা হুকুম পেল আর ইটপাটকেল সরাবার কাজে লেগে গেল? অজয়ের মনে হয়, ওরা যে মুখ বুজে এ অপমান সইছে এ জন্য দায়ী সে। তারও তো এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া বিশেষ দরকার, কিন্তু হাঙ্গামার ভয়েই তো না এগিয়ে এতক্ষণ সে দাঁড়িয়ে আছে হ করে। লোক চলছে ও রাস্তায়, সবাইকে ধরে রাস্তা সাফের কাজে লাগাচ্ছে না। যদি তাকে ধরে, এই তো তার ভাবনা। সে তো কোনোমতেই হুকুম শুনে ইট-পাটকেল সাফ করার কাজে লেগে যেতে পারবে না ওই ভদ্রলোক কজনের মতো। তাহলেই তখন গোল বাঁধবে!
কিন্তু তাই বলে কি দাঁড়িয়ে থাকা যায় ভীরু কাপুরুষের মতত? সে হাঙ্গামা করতে আসে নি, কাজে এসেছে। ও রাস্তায় লোক চলা নিষিদ্ধ হয় নি। তার হেঁটে যাবার অধিকার আছে ও রাস্তা দিয়ে। সে যদি অন্যায় না করতে, অধিকার বজায় রাখতে ভয় পায়, ওরা ইটপাটকেল সাফ করতে লেগে যাবে তাতে আর আশ্চর্য কি?
অজয় এগিয়ে যায়।
হই! বলে লালচে গোঁফওলা অফিসার, কাছে এসে সোজা সহজ হুকুম জারি করে, সাফ করো।
অজয় প্রশ্ন করে, এ রাস্তায় কি ট্রাফিক বন্ধ?
প্রশ্ন শুনেই বোধহয় রেগে যায় লালচে গোপ, আর রেগে যায় বলে ধৈর্য ধরে বলে, সাফ করো। সাফ করো। তুম ইটা ফিকা তুম সাফ করোগে।
ইউ আর ম্যাড। অজয় বলে।
তখন দুহাতে ধাক্কা দিয়ে অজয়কে সে ফেলে দেয় রাস্তায়। মাথায় সামান্য একটু চোট লাগে অজয়ের। ডান হাতের কাছে একটি ইট। মাটি পোড়ানো ইট নয়, শক্ত পাথুরে ইট, যা দিয়ে রাস্তা বাধায়। চোখে অন্ধকার দেখছে অজয়। কয়েক মুহূর্তের জন্য সে এখন উন্মাদ। হাতে তার জোর আছে। এই ইটটা ছুড়ে মেরে সে মাথার ঘিলু বার করে দিতে পারে লালচে গোপের। তারপর যা। হয় হবে।
না। দাতে দাঁত লাগিয়ে অজয় বলে, না। সে ভদ্রেলোকের ছেলে, কে একজন তাকে অপমান করেছে, এই ব্যক্তিগত আক্ৰোশে অন্ধ হয়ে কিছু তার করা চলবে না। হাসপাতালের আহত ছেলেদের মুখ তার মনে পড়ে। চোখের সামনে ভেসে উঠে রাস্তায় বসা একদল তরুণের মুখ। নরক থেকে শয়তান এসে তাকে বিগড়োবার চেষ্টা করলেও সে খাঁটি থাকবে। সে সংযত থাকবে।
সে শান্ত থাকবে।
ধীরে ধীরে অজয় উঠে দাঁড়ায়। বাঁ হাতটা কি ভেঙে গেছে? গেছে যদি যাক, এখন তা ভাববার সময় নয়, ভাঙা হাত জোড়া লাগবে।
লাল গোঁপ তাকিয়ে থাকে। সিমেন্টের শক্ত ইটটা সে দেখেছে, অজয় যখন ইটটা নামিয়ে রাখছে। তার মাথায় ছুড়ে মারবার জন্য ইটটা তুলেছিল। মারল না কেন? ও ইট মাথায় লাগলে সে বাচত না। কিন্তু মারল না কেন? লাল গোপ বোধহয় বুঝে উঠতে পারে না, তাই তাকিয়ে থাকে।
উঠে দাঁড়াবার পর অজয় টের পায় একটি গেঁয়ো পরিবারের মেয়েপুরুষ তাকে প্রায় ঘিরে ফেলেছে। ক্রমাগত প্রশ্ন হচ্ছে, লাগে নি তো? বেশি লাগে নি তো বাবু?