দরকার তো অনেক কিছুই বাবা। সব দরকার কি মেটে! ক্ষোভের সঙ্গে বলে অনন্ত।
পাল ডাক্তারকে কতবার ডাকতে চেয়েছি, আপনিই বারণ করেন। অজয় মৃদুস্বরে বলে। অনন্তের মন্তব্যের বিরুদ্ধে অভিমানের নালিশ জানাতে নয়, বাপকে সান্ত্বনা দিতে। অনন্ত নিজেকে সংশোধন করে বলে, ডাকবার দরকার কি? আমি যেতে পারি না?
একখানা মাত্র সম্বল শাড়িখানা পরে এসে মাধু বলে নিরঞ্জনকে, ঘোষেদের বাড়িতে পরিচয় করিয়ে দেবে বলেছিলে, আজ নিয়ে চল। কাল থেকেই কাজ করব, চায় তো ওবেলা থেকেই। কিন্তু ভাবছি কি–মাধু মৃদু সংশয়ের হাসি হাসে, আমার রান্না কি কুচবে ওদের, এত বড়লোক মানুষ।
অনন্ত অপলক চোখে চেয়ে থাকেন। তার মত নেই, তিনি বারণ করেছেন, তবু তাকে একবার জিজ্ঞাসা পর্যন্ত না করে তারই সামনে দাঁড়িয়ে মেয়ে তার অনায়াসে লোকের বাড়ি রাধুনির কাজে ভর্তি করিয়ে দেবার জন্য অনুরোধ করছে দাদার বন্ধুকে। লজ্জা নেই, সঙ্কোচ নেই, অপমানবোধ নেই। অজয় চোখ পেতে রাখে মেঝেতে। লাল সিমেন্টের মেঝে দুবেলা মুছে মুছে তেল চকচকে করে তুলেছে মাধু। মাধু ঝি হোক বঁধুনি হোক এতে তার লজ্জা নেই। সে থাকতে ওকে রাঁধুনি হতে হয় এমন সে নিরুপায়, এই ক্ষোভে কান দুটি তার ঝাঁ ঝাঁ করে!
আজ তো হবে না মাধু।
রাধুনিদের কাজে যাওয়াও বারণ নাকি আজ?
নিরঞ্জন হাসে।–আমরা এখুনি বেরিয়ে যাব। আজ কি নিশ্বাস ফেলার সময় আছে? দশটায় এখানে একটা মিটিং আছে, তারপর বড় মিটিং, তাছাড়া আরো কত কাজ।
তোমরা মানে? দাদাও যাচ্ছ নাকি? চল তবে আমিও বেরোই তোমাদের সঙ্গে। একটু দেখেশুনে আসি।
মাধুর চোখ জ্বলজ্বল করে। বাড়িতে মন টিকছে না আজ। খালি মনে হচ্ছে কোথায় যাই, কি করি।
হাঙ্গামার ভাসা-ভাসা এলোেমলো খবর তারা শোনে গাড়িতেই। কাল থেকে গুলি চলছে। কলকাতায়, চারদিকে লড়াই শুরু হয়েছে সারা শহরে, ভীষণ কাণ্ড। কালকের ঘটনার বিবরণ বেরিয়েছে আজকের ভোরের কাগজে, তাদের গাড়িতেই পাঁচ-সাত জন বাংলা কাগজ কিনে পড়েছে এবং সকলকে পড়ে শুনিয়েছে। আজকের খবর সব ছড়িয়েছে মুখে মুখে। কলকাতার যত কাছে এগিয়ে এগিয়ে স্টেশনে গাড়ি থেমেছে উত ঘন আর ফলাও হয়েছে খবর।
শহরেও হাঙ্গামা, কলকাতা শহরে? গণেশের মা বিচলিত হয়ে বলেছে, গণশার যদি কিছু হয়?
যাদব বলেছে তাকে ভরসা দিয়ে, গণশার কি হবে? লাখো লাখো লোক কলকাতা শহরে, তার মধ্যে তোমার গণশারই কিছু হতে যাবে কি জন্য?
চিঠিটা ঠিক আছে তো? গণশার ঠিকানা লেখা চিঠি? একথা এর মধ্যে কম করে দশ-বার বার শুধিয়েছে গণেশের মা।
বললাম তো ঠিক আছে কত বার। হাঁ দ্যাখ–যাদব ঘেঁড়া কুর্তার পকেট থেকে সন্তৰ্পণে ভাঁজ করা পোস্টকার্ডটি বার করে নিজেও আর একবার দেখে নেয় নিঃসন্দেহ হবার জন্য, যদিও দশ জনকে দিয়ে পড়িয়ে পড়িয়ে ঠিকানাটা তার মুখস্থ হয়ে গেছে, চিঠিখানা হারিয়ে গেলেও বিশেষ কিছু ক্ষতি নেই।
স্টেশন ও স্টেশনের বাইরের অবস্থা দেখে যাদব একেবারে হকচকিয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। দু-চার বার সে কলকাতা এসেছে, প্রতিবার সে স্টেশনে নেমে মানুষের গমগমে ভিড় আর স্টেশনের বাইরে গাড়িঘোড়ার অবিরাম স্রোত দেখেই চকচকিয়ে গেছে ভয়ে বিস্ময়ে, তার তুলনায় ঘুমন্ত পুরীতে যেন পা দিয়েছে মনে হয় তার আজ। স্টেশনে লোক কিছু আছে, এতটুকু ব্যস্ততা কারো নেই, সবার মুখে যেন গুমোটে মেঘ! বাইরে গাড়িঘোড়ার স্রোতটি অদৃশ্য। যাদবের মনে হয়, একদিন ঘুম ভেঙে উঠে তাদের গায়ের পাশের নদীটা অদৃশ্য হয়ে গেছে দেখলেও বোধহয় এমন তাজ্জব লাগত না তার।
হেঁটেই যেতে হবে গণশার মা।
উপায় কি তবে আর? হবে তো যেতে, নাকি?
পথটা শুধধাও কাউকে? রাণী বলে।
পুল পেরোই আগে। তারপর শুখোব।
তবে সাথে চল যারা যাচ্ছে দেরি না করে, একলাটি পড়ে গেলে ভালো হবে শেষে?
মোটঘাট বিশেষ কিছু নেই, সেও রক্ষা। মেটে হাঁড়িতে দুমুঠো সিদ্ধ করার চাল জুটলে যে ভাগ্য বলে মানে তার আবার মোটঘাট। কাঁথা বালিশের বাণ্ডিলটা যাদব বা হাতের বগলে নেয়, গাড়ির আঁকানিতে ডান হাতের ব্যথা বেড়ে অবশ অবশ লাগছে। মনকে কাখে নিয়ে গণেশের মা কাপড়ে বাধা চালের পুঁটলিটা হাতে নেয়, সের চারেক চাল আর দুটো বেগুন আছে। কটা গেলাস বাটি আর জামাকাপড়ের বাঁশের ঝাঁপিটা নেয় রাণী, দুবছরের কালীর হাতটা ধরে। ঘুমকাতুরে খিদেকাতুরে মেয়েটা এত ঘুমিয়ে এত খেয়েও একটানা কেঁদে চলেছে।
কোথা যাবে তোমরা।
রাণী মুখ বাঁকায়। সেই বাবুটা, চশমা কোট পালিশ করা জুতোর সেই বদ মাৰ্কা। যে শুধু তাকাচ্ছিল, তাকাচ্ছিল, তাকাচ্ছিল। চোখ দিয়ে যেন কাপড়ের নিচে তার গা চাটছে।
যাদবের মুখে ঠিকানা শুনে ভদ্রলোক যেন চমকে যায়, সে যে অনেক দূর, যাবে কি করে? এমনি যদিবা যেতে পারতে অন্যদিন, আজ যে রাস্তাই বন্ধ ওদিকের। পুলিশ গুলি চালাচ্ছে। লোকেরা ইট ছুড়ছে, গাড়ি পোড়াচ্ছে, মারা পড়বে সবাই তোমরা।
ছেলে আছে ওই ঠিকানায়। ছেলের কাছে যাচ্ছি বারু।
আজ যেতে পারবে না, ভদ্রলোক বলে জোর দিয়ে, দ্যা দিকি গা থেকে শহরে এসে কি বিপদে পড়লে।
ভদ্রলোক গম্ভীরভাবে ভাবে, অনেক ইতস্তত করে, তারপর যেন নিরুপায়ের মতো অনিচ্ছার সঙ্গে বলে, আজ যেতে পারবে না। এক কাজ কর বরং আমার বাড়ি কাছে আছে, সেখানে আজ থেকে যাও। হাঙ্গামা কমলে কাল-পরশু যেও ছেলের কাছে, আমি না হয় ছেলেকে তোমার একটা খবর পাঠাবার চেষ্টা করব।