অনুরূপা তখন ধৈর্য হারিয়ে ছেলের খোজে গলি দিয়ে এগিয়ে আসছিলেন।
সাড়ে আটটা বাজে, অজয় এখনো স্নান করতে গেল না। বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সেই যে কথা আরম্ভ করেছিল, সুধীর আর নিরঞ্জনের সঙ্গে বাজার থেকে ফিরে এখনো মশগুল হয়ে কথাই বলে চলেছে। যেন ভুলে গিয়েছে যে দশটায় ওর আপিস, বাড়ি থেকে বেরিয়ে আপিসে পৌঁছতে এক ঘণ্টার কম লাগে না। হাওড়া ব্রিজ পর্যন্ত হেঁটে না গিয়ে আজ ট্রামে বাসে যাবে যদি ভেবে থাকে, তা ও ভাবুক, কারো তাতে কিছু বলার নেই, মাঝে মাঝে দু-একদিন এইটুকু পথ হাঁটার বদলে শখ করে মিছিমিছি ট্রামে বাসে কটা পয়সা বাজে খরচ যদি করতে চায় কেউ তাতে কিছু মনে করে না। কিন্তু এখন স্নান করতে না গেলে ট্রামে বাসে পয়সা নষ্ট করেও যে আপিসে লেট হয়ে যাবে সেটা তো খেয়াল থাকা দরকার ওর।
মৃদু অস্বস্তি বোধ করে বাড়ির লোক, মাধু ছাড়া। ওদের সঙ্গে এত কথাই-বা কিসের সবাই ভাবে, মাধু ছাড়া। ক্লাসফ্ৰেণ্ড ছিল বটে, এখন তো আর নয়। ওরা কলেজে পড়ছে, অজয় চাকরি করছে। এত ভাব ওদের সঙ্গে এখন না রাখাই উচিত।
অনন্ত সইতে না পেরে মেয়েকে বলে, মাধু আরেকবার ডাক।
এই তো ডাকলাম।
আবার ডাক। কটা বাজল? আটটা পঁয়ত্রিশ। ডেকে বল পৌঁনে নটা হয়ে গেছে।
বলেছি তো একবার। দাদার কি হিসেব নেই ভাব? অত খোঁচানো ভালো নয়। মাধু শান্ত গলাতে বলে। আশ্চর্য রকম সে শান্ত হয়ে গেছে আজকাল। সে রকম এলোমেলো মেজাজ আর নেই, একের পর একটা বিয়ের চেষ্টা ফসকে যাবার কবছর যেমন ছিল। সে যেন ওদিকের সব আশা ভরসা মুচড়ে ফেলে হাল ছেড়ে দিয়ে সুস্থ হয়েছে।
কপালে চাপড় মেরে অনন্ত বলে, তুই আর আমাকে উপদেশ দিসনে মাধু, দিসনে। গলায় দড়ি জোটে না তোর?
দাও না জুটিয়ে? মাধু হেসে বলে, দড়ি কিনতেও পয়সা লাগে বাবা। এক ঘণ্টা ধরে চুল ঘষে দিলাম, দত্তবাড়ির বৌটা পয়সা দিলে চার আনা। চার আনায় গলায় দেবার দড়ি হয় না। রোজগার বাড়ুক, দড়িও জুটিয়ে নেব।
অনন্ত কুরিয়ে কুরিয়ে তাকায় মেয়ের দিকে।
তার তাক লেগে যায় নিজের ছেলেমেয়েগুলির রকম দেখে। এত যে তার দুঃখ দুর্দশার। সংসার, শুধু শুধু অশান্তি আর হতাশা, ওরা কেউ যেন তার অস্তিত্ব মানবে না প্রতিজ্ঞা করেছে। লড়াই থামতে না থামতে তাকে বুড়ো বয়সে খেদিয়ে দিল চাকরি থেকে পড়া ছেড়ে চাকরি নিয়ে দুটো পয়সা আনছে ছেলেটা তাই আপেটার হাড়িটা চড়ছে কোনোমতে, যে কাপড় পরে আছে মাধু ওর দিকে তাকানো যায় না, অজয় যে বেশে আপিস যায় যেন কুলি চাষীর ছেলে, আজ বাদে কাল কি হবে ভেবে বুকের রক্ত তার হিম হয়ে আছে, কিন্তু ওরা যেন গ্রাহ্যই করে না কোনো কিছু আগে যখন আরো সহজে সংসার চলত, অজয়ের পড়া চালানো, মাধুর বিয়ে দেওয়া, এসব ব্যবস্থা একরকম করে করা যাবে মরে-বেঁচে এ ভরসা করা চলত, তখন যেন কেমন হতাশ, মনমরা ছিল সকলে, রাগারাগি চুলেচুলি কাদাকাটা অশান্তি লেগেই ছিল ঘরে এখন আরো শোচনীয় অবস্থায় এসে ভবিষ্যতের সব আশা ভরসা হারিয়ে আপেটা খেয়ে ঘেঁড়া কাপড় জামায় দিন চালিয়ে গিয়েও সবাই যেন জীয়ন্ত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ভয় নেই ভাবনা নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে, আমরা সব ঠিক করে নেব, এই ভাব সকলের। মায়ের গঞ্জনায় মাধু একদিন মরতে গিয়েছিল ক্ষুর দিয়ে নিজের গলা কেটে, অজয় গিয়ে সময়মতো না ধরলে সর্বনাশ হয়ে যেত। এখনো গলায় সে দাগ আছে মাধুর। আজকাল গালাগাল গঞ্জনা উপহাস কিছুই সে গায়ে মাখে না। রাগ তো করেই না, হেসে উড়িয়ে দেয়।
অথচ আজ ওর গায়ে আঁটা আছে এই সত্যটা যে কাপড় ও পরে আছে, ওর দিকে তাকানো যায় না।
অনন্ত ঝিমোয়। তার সাধ যায় ছেলেমেয়ের কাছে হার মেনে মাপ চেয়ে বলতে যে এই ভালো! এই ভালো!
কিন্তু সে চমকে উঠে গর্জেই বলে, অজয়! আপিস যেতে হবে না আজ? আড দিলেই চলবে সারাদিন?
অজয় ভেতরে এসে বলে, আজ আপিস যাব না বাবা। আজ সব আপিস কারখানায় হরতাল। ট্রাম বাস বন্ধ হয়ে গেছে।
অনন্ত সোজা হয়ে বসে উদ্বেগে, আতঙ্কে, উত্তেজনায়। জোর দিয়ে বলে, শিগগির যা, না খেয়ে চলে যা আপিসে। কিনে খাস কিছু খিদে পেলে। হেঁটে চলে যা, দেরি হলে কিছু হবে না। অন্য দিন কামাই করিস যায় আসে না, আজ আপিসে যেতেই হবে। গিয়ে ম্যানেজার সায়েবকে বলবি, ট্রাম বাস বন্ধ, হেঁটে আসতে হল বলে দেরি হয়েছে। বলবি, কয়েকজন জোর করে তোকে আটকে রাখতে চেষ্টা করেছিল, তুই অনেক কষ্টে কারো কথা না শুনে আপিসে এসেছিস
অনন্ত কাশতে শুরু করে। কাশতে কাশতে বেদম হয়ে পড়ে। তবু তারই মধ্যে কোনোমতে বলে, সায়েব খুশি হবে, মাইনে বাড়বে, উন্নতি হবে, আপিস যা।
কাশি থামলে গুটলি মুটলি পাকিয়ে মরার মতো পড়ে থাকে অনন্ত। মাধু হাওয়া করে, অজয় বুকে পিঠে হাত ঘষে দেয়। গোলমাল শুনে নিরঞ্জন ভেতরে এসেছিল, মাথা হেঁট করে সে দাঁড়িয়ে থাকে, চোখ তোলে না। ঘেঁড়া কাপড়ে অনেক যত্নে মাধু যখন নিজেকে মোটামুটি ঢেকে রাখে,
তখনো তার দিকে চাওয়া যায় না। এখন সে ব্যাকুল হয়ে নিজের কথা ভুলেই গেছে।
আধঘণ্টা পরে একটু সুস্থ হয়ে অনন্ত ডাকে, অজয়।
বাবা?
আজ আপিস যে না। সবাই যখন আপিস যাচ্ছে না, তোমার যাওয়া উচিত হবে না। সবাই যা করে, তাই করাই ভালো।
নিরুদা, যেও না। কথা আছে। মাধু তার বাইরে বেরোবার আস্ত শাড়িখানা পরে আসতে যায়।
আপনার একটা ওষুধ খাওয়া দরকার কাশির জন্য। নিরঞ্জন বলে।