বল!
কিছুদিন তুমি আমার সঙ্গে মেলামেশা একেবারে কমিয়ে দাও।
কতদিন?
তোমায় আমি কেড়ে নিয়ে বশ করেছি এ ধারণাটা মাসিমার যদ্দিন না কাটে। শুধু মেলামেশা কমানো নয়, তোমার চালচলন থেকে মাসিমা যেন আবার ধারণা না করে বসেন, মিশতে না পেয়ে আমার জন্য তোমার বুক ফেটে যাচ্ছে। ওটাও তোমার খেয়াল রাখতে হবে। তাই বলে এমন ভাবও দেখিও না যেন সীতা বলে কেউ ছিল তুমি তা স্রেফ ভুলে গেছ মাসিমা তাহলে ভাববেন একটা খেলা করছি আমরা ওঁর সঙ্গে।
হেমন্ত সংশয় ভরে বলে, ওটা কি মার সঙ্গে ছলনা করা হবে না সীতা?
সীতা জোর দিয়ে বলে, না। কারণ, আমরা স্বাভাবিকভাবে মেলামেশা করলেও মাসিমা সেটাকে এখন বিকৃত দৃষ্টিতে বিচার করবেন, খুঁজে খুঁজে শুধু বার করবার চেষ্টা করবেন আমার জন্য ওঁকে কিসে তুমি অবহেলা করলে, কিসে তুচ্ছ করলে। ওঁর বিকারটাই তাতে জোরালো হবে। শান্ত মনে ভাববার বুঝবার সময় পেলে উনি এ দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেন। মা অসুস্থ, কিছুদিন তুমি তার চিকিৎসা করবে। এতে ছলনার কি আছে?
হেমন্ত চুপ করে ভাবে। তার মুখে মৃদু হতাশা ও অসহায়তার ভাব ফুটে উঠতে দেখে দুঃখের সঙ্গে সীতা ভাবে, তাকে ছেড়ে দূরে দূরে কি করে থাকবে তাই কল্পনা করতে আরম্ভ করেছে কি হেমন্ত নিজের মধ্যে গভীর বেদনা জাগাতে? হেমন্ত কথা কইতে সে স্বস্তি পায়। অত হাল্কা নয় হেমন্ত!
এই সময়টাতেই তোমাকে আমার বেশি দরকার ছিল।
না হেমন্ত, বিনা দ্বিধায় সীতা বলে, এটা তোমার ভুল। আমি সব সময় পেছনে লেগে না থাকলে যদি তুমি ভেস্তে যাও, তবে তাই যাওয়াই ভালো। কিন্তু তা সত্যি নয়, ভেব না। তোমার নতুন বিশ্বাস শিথিল হবে না, মনের জোরে ঘাটতি পড়বে না। এমন অনেককে পাবে, যারা বরং ওদিক দিয়ে আমার চেয়ে বেশি কাজে লাগবে তোমার এ সময়। তা ছাড়া, সীতা স্নিগ্ধ হাসি হাসে, আমাকে একেবারে ত্যাগ করতে তো বলি নি তোমায়।
০৮. সূর্য উঠেছে মেঘ কেটে গিয়ে
জয়ন্তের মনে শুধু এই ভয়, বাড়ি ফিরলে মা কবে। আর সব ভয়-ডর সে ভুলে গেছে। সে আর তার দশ-বারজন সঙ্গী আজ পৃথিবী জয় করতে পারে। পাড়ার এই ছেলেদের সঙ্গে কত রকম খেলা সে খেলেছে, কত অ্যাডভেঞ্চার করেছে রায় বাবুদের বাড়ির সামনের লোহার গেট ও প্রাচীরঘেরা ছোট্ট বাগানের ফুল চুরি করা থেকে বকলস খুলে ডিকসনের কুকুরটাকে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া পর্যন্ত, বার বছর বয়সের জীবনে আজকের মতো এমন উত্তেজনা এমন উন্মাদনা আর কোনোদিন সে পায় নি। এদিক-ওদিক একটু ঘুরে দেখে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাবে বলেই সে বেরিয়েছিল, শিশির, মনা, অশোকদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু বেলা দুপুর হয়ে এল, এখনো তারা ফিরতে পারে নি। বড় মোড়ে মিলিটারি লরিটাতে আগুন ধরামাত্র ওখানে ছুটে গিয়েছিল দল বেঁধে দেখতে, তারপর চারটে লরি পোড়ানো দেখে এতক্ষণে তারা পাড়ার গলির মোড়ে ফিরে এসেছে। তার আগে কি ফেরা যায়? বাড়িতে নয় একটু বকবেই। হাজার হাজার লোকে যখন রাস্তায় নেমে এসেছে, একটি গাড়ি পর্যন্ত চলতে দেবে না পণ করে, সে কি করে বাড়ি ফেরে।
শিশির জিজ্ঞেস করেছিল, কেন গাড়ি চলবে না ভাই?
জয়ন্ত–তের বছরের জয়ন্ত, ন বছরের ছেলের প্রশ্নে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল, জানিস না? গুলি করবে কেন? এটা আমাদের দেশ, আমরা যা খুশি করব। ওরা গুলি করবে কেন?
অশোক বলেছিল, তাছাড়া, আমাদের স্বাধীনতা চাই তো। পরাধীন হয়ে থাকব কেন শুনি?
মনা সায় দিয়েছিল, বাবা বলে, আমরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করি, তাই স্বাধীনতা পাই না। আমরা তাই এক হয়েছি। দেখছি না? এই দ্যাখ।
বিক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করার জন্য শান্তি বাহিনীর একটি গাড়ি তিন দলের পতাকা উড়িয়ে মোড়ের মাথায় থেমেছিল, লাউডস্পিকার থেকে ভেসে এসেছিল : সংযম হারালে, দু-চার খানা গাড়ি পোড়ালে, অন্যায়ের প্রতিকার হবে না, স্বাধীনতা আসবে না। শান্ত হয়ে সকলে বাড়ি ফিরে যান, কিংবা প্রতিবাদ সভায় যোগ দিন। সংঘবদ্ধ আন্দোলনে দাবি আদায় করুন।
জয়ন্ত বলেছিল, তোকে বলি নি চিল ছুডিস না মনা? শুনলি তো?
তারপর তারা ফিরে এসেছে এই গলির মোড়ে। গলা শুকিয়ে গেছে তাদের ইনক্লাব, জয় হিন্দ, বন্দেমাতরম্ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে। বড়দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা চেঁচিয়েছে, তারা তো তুচ্ছ নয়। খিদেয় অবসন্ন হয়ে এসেছে শরীর। তবু গলির ভেতরে ঢুকে যে যার বাড়ি চলে যাবে সে ক্ষমতা যেন পাচ্ছে না তারা। তাদের শিশুমনের স্বপ্ন, আর রূপকথা যেন বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে। আজ তাদের সামনে শহরের রাজপথে, অফুরন্ত সুযোগ জুটেছে রাজপুত্রের মতো বীরত্ব দেখাবার।
এ মোড়ের অল্প দূরে একটা লরি পুড়ছিল। তাই দেখার জন্য তারা দাঁড়িয়ে থাকে। সৈন্য বোঝাই একটি লরি আসছে দেখা যায়, শব্দও পৌঁছায় এখানে।
জয়ন্ত বলে দৃঢ়স্বরে, সৈন্যবাহিনীর কমাণ্ডারের মতে, এই শেষবার। এদের শুনিয়ে দিয়ে আমরা বাড়ি ফিরব। আমি যা বলব, তোমরা ঠিক তাই বলবে। দু-তিন পা এগিয়ে দাঁড়াই চল। রেডি! ইনক্লাব জিন্দাবাদ। জয় হিন্দ। বন্দেমাতরম। ইনক্লাব–
মনার গায়ে ঢলে জয়ন্ত রাস্তায় আছড়ে পড়ে। উঠবার যেন চেষ্টা করছে এমনি করে নড়েচড়ে কয়েক বার। দুবার কাশে রক্ত তুলে। তারপর নিস্পন্দ হয়ে যায়। তেরটি শিশু তাকে ধরাধরি করে গলির ভেতরে নিয়ে গিয়ে বাড়ির সামনের প্রথম যে বারান্দা মেলে তাতে শুইয়ে দেয়।