কেন নয়? সীতা আশ্চর্য হয়ে যায় তার কথা শুনে, ভাববার যা আজ থেকে ভাবতে শুরু করলে দোষটা কি? ওই ভাবনায় মশগুল হয়ে তুমি তো আর সব ভুলে যাচ্ছ না? এক দিনে সব ভাবনা শেষ করে দেবার জন্য পাগল হয়ে উঠছ না? সেটা তাহলে ভাবা হবে না, কাব্য হবে। এক দিনে মানুষ বদলায় না। হঠাৎ বিবাগী হয়ে যে ঘর ছাড়ে, তারও ওই ঘর ছাড়াটাই ঘটে হঠাৎ, বৈরাগ্যটা নয়। আর তুমি তো সংসারে থেকে কাজ করবে। ভাব, মাথা গুলিয়ে ফেল না। একদিনে সব ভাবনা মিটিয়ে দিতে চেয়ো না। রোজকার ভাবনা রোজ ভাবলে, রোজকার কাজ রোজ করলে, দেখবে সব ঠিক ঠিক হয়ে যাচ্ছে।
অর্থাৎ ধীর স্থির শান্ত ভাবে–
নিশ্চয়! ওটা দরকার। বিশেষ করে তোমার পক্ষে। মনকে একটু বশে না আনলে কেউ ভাবতে পারে না, সে এলোমেলো ভাবনার শেষ আছে? রাগ কোরো না, নিজেকে তুমি একা বলে জান। তুমি ভাবতে শেখ নি সংসারে আরো দশ জন আছে, আরো দশ জনে ভাবে, আরো দশ জনে কাজ করে। নিজেকে দশ জনের এক জন বলে জানলে, দশ জনের সঙ্গে ভবতে আর কাজ করতে শিখলে, তোমার ভাবনা চিন্তার আসল গোলমালটা কেটে যাবে। ওটা হঠাৎ হয় না। মানুষ একদিনে বদলায় না হেমন্ত।
কিন্তু মার কি হবে?
সব ঠিক হয়ে যাবে। কেন ভাবছ? সৃষ্টিছাড়া উদ্ভট কিছু তুমি হতেও যাচ্ছ না, করতেও যাচ্ছ। না। যদিও তোমার হয়ত ওই রকম কিছু মনে হচ্ছে। তোমার যেমন নাট্যবোধ, জীবন-নাট্য তেমন নয় হেমন্ত। সীতা একটু থেমে বলে, উপদেশের মতো লাগছে?
হেমন্ত সায় দিয়ে বলে, তা লাগছে কিন্তু শুনতে ভালো লাগছে।
কথাগুলি কিন্তু আমার উপদেশ নয় হেমন্ত। সীতা জোর দিয়ে বলে, তোমারও কিছুদিন আগে থেকে আমার বেলা যা ঘটতে আরম্ভ করেছে, ঠিক সেই অভিজ্ঞতার কথা বলছি। এ শুধু পরামর্শ। আস্তে আস্তে আজকাল কি বুঝতে পারছি জান? দেশ কাকে বলে তাই আমি জানতাম না দু বছর আগে, এই ভীষণ সত্যটা। অথচ কি প্রচণ্ড অহঙ্কার ছিল দেশকে ভালবাসি বলে!
চায়ের কাপ মুখে তুলে চুমুক দিতে গিয়ে হেমন্ত চেয়ে থাকে সীতার দিকে। নিজের ভুল আবিষ্কার করতে পারার জন্য সীতা কৃতার্থ, কৃতজ্ঞ। যে বিশ্বাস মুখে এমন দীপ্তি, চোখে এমন উজ্জ্বল স্বচ্ছন্দ দৃষ্টি এনে দিতে পারে, সরল ও নম্রও বুঝি মানুষ হয় সেই বিশ্বাসের জোরেই। সীতাকে নিয়ে বহু দিনের বহু ঈর্ষা ক্ষোভ হতাশার অভিজ্ঞতা তো মুছে যায় নি হেমন্তের হৃদয় থেকে আজ এখানে আসবার সময়েও, এত ঘনিষ্ঠ হয়েও সীতাকে ভালো করে চিনতে না পারার জ্বালাটাই বুঝি তার ছিল বেশি সীতাই যেন নানা কলাকৌশলে ওই দুর্বোধ্যতার ব্যবধান সৃষ্টি করে নিজেকে তার নাগালের বাইরে রেখে দিয়েছিল, দূরে যে সরিয়ে রাখা হয়েছে এটুকু জানতে বুঝতে দেবার দয়াটুকুও দেখায় নি। হৃদয়ে অনেক কাটার অনেক ক্ষতে আজ যেন প্রলেপ পড়ে হেমন্তের। নিজেকে তার ছোট ভাবতে হয়, কিন্তু সেজন্য তার খুব বেশি দুঃখ বা ক্ষোভ হয় না। বরং তৃপ্তির সঙ্গে কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই সে এ জ্ঞানকে মেনে নেয় যে নিজের ছোটমি দিয়েই সে পার্থক্য রচনা করেছিল তাদের মধ্যে, সীতা তাকে ঠেকিয়ে রাখে নি। কৃত্রিম আকর্ষণও সীতা সৃষ্টি করে নি। তার জন্য, কৃত্রিম রহস্যের আব্রণেও নিজেকে ঘিরে রাখে নি। সে-ই তার ছোট মাপকাঠিতে সীতাকে মাপতে গিয়ে, তার গরিবের মূল্য বিচার দিয়ে দাম ঠিক করতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে গেছে, দুঃখ পেয়েছে। সীতার যে একটা সহজ স্বাভাবিক সরলতার গুণ আছে, তার পুরো দাম দিতে পর্যন্ত সে তো কোনোদিন রাজি হয় নি। সীতার যা আছে সে তা মেনে নিতে পারে নি, কেটেছেটে কমিয়ে নিয়েছে নিজের প্রয়োজনে, তার নিজের অল্পতার সঙ্গে, সৈন্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে। যতই হোক, সীতা তো মেয়ে।
কি ভাবছ? চা-টা খেয়ে নাও। একটু ইতস্তত করে সীতা, যেচে সহজ সরল হতে গিয়ে সেটা অনর্থক হলে বড় বিশ্রী লাগে। নিজের চা সে শেষ করে। ভূমিকা যা করবে ভেবেছিল সেটা বাদ দিয়ে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করে, মাসিমা কিভাবে নিলেন?
কাল রাত্রে ভালোভাবেই নিয়েছিলেন। সকালে যেন কেমন দেখলাম। মার মনে একটা খটকা লেগেছে–খটকা কেন বলি, মার খুব হিংসা হয়েছে।
জানি। সীতা চোখ তোলে, কাল তোমায় খুঁজতে এসেছিলেন, বলেই ফেলেছেন আমার কাছে। তোমায় নাকি পুতুল করে ফেলেছি আমি, খুশিমতো নাচাচ্ছি। একেবারে বিশ্বাস জন্মে গেছে।
হেমন্তের কথায় নিরুপায়ের আফসোস ফুটে ওঠে, আমরা কি করব! কাল রাত্রে মার সঙ্গে কথা কয়ে কত খুশি হয়েছিলাম। সকালে পাঁচ মিনিটে মনটা বিগড়ে দিলেন। ঠিক কথাই বলেছ তুমি, মানুষ একদিনে বদলায় না।
না হেমন্ত, সীতা মাথা নাড়ে, আমরা কি করব বলে উড়িয়ে দিলে চলবে না। মাসিমাকে সময় দিতে হবে।
মানে?
মানে মাসিমাকে বুঝে উঠতে, সয়ে নিতে সময় দিতে হবে। কাল আমিও চটে গিয়েছিলাম মনে মনে, ছেলেমেয়েদের পঙ্গু করে রাখতে চায় এ কেমন অন্ধ স্নেহ! কিন্তু চটলেও মনটা খচখচ করছিল, কি যেন ভুল হচ্ছে। ভেবে দেখলাম, মাসিমার স্নেহ অন্ধ হোক, মোহগ্ৰস্ত হোক, তুমি তা উড়িয়ে দিতে পার না হেমন্ত। আমিও পারি না। অবশ্য বিশেষ অবস্থায় বড় দরকারে এসব মেহমমতার ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামালে চলবে না আমাদের। সে আলাদা কথা। সে কারণ ভিন্ন। বড় ব্যাপারে ঘরোয়া লাভক্ষতির হিসাব বাদ দিতেই হয়। কিন্তু এখানে তো কথাটা ঠিক তা নয়। তোমার আমার বন্ধুত্ব নিয়ে যত গণ্ডগোল। কাজেই, মাসিমা অন্যায় করলেও তার স্নেহকে অবজ্ঞা করা যায় না, তাকে শাস্তি দেওয়া যায় না। বিশেষ করে আমরা যখন জানি, মাসিমাকে একটু প্রশ্রয়। দিলে, একটু সময় দিলে উনি সামলে উঠতে পারবেন। মাসিমা স্বার্থপর নন, তোমাদের নিয়েই ওঁর স্বার্থ। আমাকে নিয়ে ওঁর হয়েছে মুশকিল। এটা ওঁর দুর্বলতা, অন্যায়, তা বলব। কিন্তু দুর্বলতাটা জয় করার সময় আর সুযোগ ওঁকে না দিলে সেটা আমাদের অন্যায় হবে। তোমাকে তাই একটা কথা বলতে চাই।