আগে আপনার পর্দা ছিল?
ছিল না? আমিনা বলেন জোর দিয়ে, বাঙালি মেয়ের পর্দা আজো ঘোচে নি–তার আর আগে ছিল কি বল?
ওসমান সায় দেয়, তা ঠিক।
হাসপাতালে বিশেষ করে ওসমানের জন্যই যেন চমকপ্রদ এক ধাঁধা তৈরি হয়েছিল।
মাল? মাল ছিল নাকি ওর সঙ্গে?
ছিল না? ওর সঙ্গে যে এল প্যাক করা মালটা?
দাঁড়াও দেখি খোঁজ করে।
আধঘণ্টা পরে—! কই, মাল তো নেই। কিসের মাল? কি ছিল?
তখনো বাঁধা লাগে না ওসমানের। জিনিসটা অবশ্যই সরিয়ে রাখা হয়েছে নিরাপদ জায়গায়, যেখানে সেখানে তো ফেলে রাখা যায় না।
কি ছিল কে জানে, প্যাক করা বাক্সের মতো। কাল টেলিফোন করা হল যদি খোঁজ মেলে কার কাছে মালটা নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কাল রাতে কিছু জানা যায় নি। কথা ছিল, আজ মালটা খুলে দেখা হবে ভেতরে নাম-ঠিকানার কোনো হদিস মেলে কিনা। কোথাও সরিয়ে রাখা হয়েছে হয়তো
না, না। ওর সঙ্গে মাল ছিল না। সকালে লিস্ট করা হয়েছে। এই তো নাম–গণেশ। বয়সে একুশ বাইশ
নাম-পরিচয় জানা গেছে? ওসমান সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করে।
শুধু নামটা–গণেশ। হাতে উল্কি দিয়ে লেখা ছিল। মালের কথা কিছু নেই।
কি হল মালটা?
ছিলই না মাল, কি হল মালটা! মানে? তোমার নামটা কি? ওসমান? ওর নাম তো গণেশ। তোমার এত মাথা ঘামানো কেন ওর জন্য?
ওসমান একটু চুপ করে থাকে।
কি জানি মাথাটা নিজে থেকে ঘামে।
ভদ্রলোকের মনে অপমানিত বোধ করার ভূকুটি ফুটে উঠতে দেখে ওসমান যেন খুশিই হয় একটু।
সকালে হেমন্ত জামা গায়ে দিচ্ছে বেরোবার জন্য, অনুরূপা সামনে এলেন মুখ ভার করে।
এত সকালে বেরোচ্ছিস যে?
সীতার কাছে যাব একবার।
অনুরূপার মুখ আর একটু লম্বা হয়ে যায়।
চা খাবি না?
সীতার ওখানে খাব।
এসব তোরা কি আরম্ভ করেছিস হেমা? অনুরূপা বলেন, দুরন্ত দুঃখের ভাষায়, খোকা কখন কোথায় চলে গেছে আমাকে কিছু না বলে। তুইও বেরিয়ে যাচ্ছিল। বলে কি যেতে নেই একবার আমাকে? এতই তুচ্ছ হয়ে গেছি আমি?
বেরিয়ে তো যাই নি মা এখনো? বলেই যেতাম তোমাকে।
ভুল-ঘরে লাগানো জামার বোতামটা খুলতে খুলতে হেমন্ত বলে অনুযোগের সুরে। সকালে আবার কি প্রতিক্রিয়া দেখা দিল মার মনে কে জানে। এত সকালেই সংযম হারিয়ে অনুরূপ মান-অভিমানের পালা গাইতে শুরু করবেন হেমন্তের বিশ্বাস হতে চায় না। এমন সোজাসুজি জ্বালা বা দুর্বলতা প্রকাশ করাও তো আর স্বভাব নয়!
আবার বলে হেমন্ত সহজ সুরে, সকালে বেরোব, তোমায় তো বলাই আছে। একটু তাড়াতাড়ি যাচ্ছি, সীতা হয়তো বেরিয়ে যাবে। তাই ভাবলাম, ওখানেই চা খেয়ে নেব। চায়ের জল চাপিয়েছ নাকি? তাহলে খেয়েই যাই।
একা আমি কত দিক সামলাব হেমা? কতকাল সামলাব? হেমন্তের কথা যেন কানেও যায় নি। এমনিভাবে অনুরূপা বলেন, রোজগার করে সংসার চালাব, তোমাদের কার মাথায় হরদম কি পাগলামি চাপবে তাও খেয়াল রাখব, অত আমি পারব না হেমা। এই তোমাকে আমি বলে রাখলাম। বড় হয়েছ, ভাইটার দিকে একটু তাকাতে পার না? না বলে কোন্ ফাঁকে খোকা কোথায় চলে গেছে। কিছু খায় নি পর্যন্ত। খুঁজে ডেকে এনে শাসন করতে পার না একটু ওকে?
কোথায় গেছে, এখুনি আসবে। এতে আবার শাসন কিসের?
তুই কিছু বুঝিস না হেমা। এমনি না বলে একটু এদিক-ওদিক যায়, সে আলাদা কথা। ছোট ছেলে অমন করেই। কাল হৈচৈ করতে যেতে চাইছিল, আমি যেতে দিই নি। সকাল হতে না হতে তাই ইচ্ছে করে কিছু না জানিয়ে চুপিচুপি পালিয়েছে।
বেশি আটকালে এ রকম হয়। পাড়ার সব ছেলে রাস্তায় বেরিয়েছে, খোকা বন্দি হয়ে থাকবে?
বলে যেতে পারত।
কেন বলে নি জান? যদি মানা কর এই ভয়ে। তাহলে তো তুমি আরো বেশি রাগ করতে, মানা করলাম, তবু চলে গেল। তোমার মনে কষ্ট দিতে চায় নি খোকা, বুঝতে পারছ না? আমারও
তো ভয় হচ্ছিল কাল, তুমি যদি বারণ কর, কি করে তোমার মনে কষ্ট দেব।
বুঝেছি। কোনো কথা শুনবে না ঠিক করাই থাকে তোমাদের, আমার সঙ্গে শুধু একটু ভদ্রতা কর।
মার সঙ্গে অভদ্রতা করতে হয় নাকি?
হেমন্ত হাসে। অনুরূপাও এতক্ষণে খানিকটা ধাতস্থ হয়েছেন মনে হয়।
যাকগে, যা খুশি কর। আমি তো এবার পেনশন নেব সংসার থেকে। তোমাদের ঘাড়েই চাপবে ভাইবোনের ভার।
তোমাদের? তোমাদের কে কে মা? ও। আমি আর তোমার ছেলের বৌ। তুমি এত হিসেব জান মা?
কত দিন এভাবে এড়িয়ে যাওয়া চলবে, ঠেকিয়ে রাখা যাবে? হেমন্ত ভাবে পথে নেমে। এই তো সবে সূচনা, শেষ পর্যন্ত কোথায় গড়াবে এই মায়ার লড়াই কে জানে! অথবা ক্ৰমে ক্ৰমে ঠিক হয়ে যাবে সব, সময় পেলে সম্ভব হবে মানিয়ে নেওয়া, শান্তি পাওয়া মার পক্ষে তার পক্ষেও? বুঝে উঠতে পারে না হেমন্ত। পরিবেশ গড়ে মানুষকে, পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলাই সহজ মানুষের পক্ষে, অতি দরকারি লড়াইও এড়িয়ে চলতে মানুষ তাই এত ব্যাকুল, পলাতক মনোভাব। তাই এত প্রবল। পালিয়ে পালিয়ে এড়িয়ে চলার দিন তার পক্ষে ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু কি করতে হবে তাকে আগামী দিনগুলিতে, ঠিকমতো তার জানা নেই। বিশেষ অবস্থায় আজকের দু-চার-দশ দিনের বিশেষ কর্তব্য হয়তো তার জানা আছে, কিন্তু তারপর যখন দৈনন্দিন জীবনকে গড়তে হবে নতুন করে তার নিজের, মার, রমা ও খোকনের, চেনা ও অচেনা সব মানুষের জীবন গঠনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, খাপ খাইয়ে, সম্মুখের দিকে গতি বজায় রেখে, শত শত গ্ৰহণ বৰ্জন নিয়ন্ত্রণ পরিমার্জনের মধ্যে ভীরুতা ও দুর্বলতা, হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, মান-অভিমানের খেলা ও লড়াইয়ে, বাঁচা ও বাঁচানোর সংগ্রামে, তখন কিভাবে কি করবে ভেবেও পাচ্ছে না সে। আজ অবশ্য ভাবার সময় নয় ও সব।