হ্যাঁ।
আচমকা স্পষ্টতর প্রবলতর হয়ে রসুলকে জামাই করার সাধটা আছড়ে পড়ে ওসমানের মনে।–হাসপাতালে যাই একবার, দেখে আসি ওকে।
এখন ওসব কথা তোলার সময় নয়, আমিনা শুনে হয়তো কি ভাববেন, এ সব জেনেও ওসমান হৃদয়ের তাগিদটা রুখতে পারে না, বলে, এক আরজ আছে আপনার কাছে, জানিয়ে রাখি। মেয়েটা বড় হয়ে গেছে, পরীবানু। ওকে তো দেখেছেন আপনি?
কতবার দেখেছি।
পরীবানুর কথা কোথা আসে ভেবে আমিনা আশ্চর্য হয়ে যান।
ওর জন্য ছেলে খুঁজছি। তা আমার আরজ রইল আপনার কাছে, রসুল ফিরলে আমার মেয়েকে আপনার নিতে হবে। আমি মজুর বটে, লড়ি হকাই, আমার মেয়ে নিলে ঠকবেন না।
এ তো খুশির কথা। আমিনা বলেন আন্তরিকতার সঙ্গে, তবে কি জানেন, রসুলের মত থাকা চাই।
তা চাই না? রসুলের মত চাই আগে।
আপনার সাথে হাসপাতালে যাব? আমিনা যেন নিছক প্রশ্ন করেন তার ব্যাকুল আগ্ৰহ চেপে রেখে।
যাবেন? ওসমান চিন্তিতভাবে বলে, হেঁটে যেতে হবে। রাস্তায় হাঙ্গামা চলছে। পরে নয়। যাবেন। সেই ভালো। আমি দেখে আসি, ঘরে ফিরবার আগে আপনাকে জানিয়ে যাব কেমন আছে।
সেই ভালো তবে!
আমিনা জানেন ওসমানের ছেলে-হারানোর ইতিহাস, তারই রসুলের মতো জোয়ান ছেলে। দেশ-সেবার পথ নিয়ে কাদেরের সঙ্গে তার মতান্তর ছিল বরাবর। বড় তেজী ছিল ছেলেটা। মানত যা, করত তাই। খান বাহাদুরের শেষ বারের নির্দেশ মানতে তার নাকি দ্বিধা হয়েছিল, ওসমান নিজেই বলেছে আমিনাকে। তারপর হাসপাতালে মরবার তিন দিন আগে বাপের কাছে সে মাপ চেয়েছিল, বলেছিল, এস.ডি.ওর গাড়িতে চেপে আমাদের ফেলে খান বাহাদুর পালালেন, গাড়ির পেছনের চাকা আমার ডান পাটা পিষে দিয়ে গেল, সেজন্য দোষ দিই না। প্রজাদের মারতে আমাদের পাঠিয়েছিলেন তা কি জানতাম? আজ এসে প্রজাদের কজনের নাম করে বললেন কি, ওরা আমাদের মেরেছে বলতে হবে। তখন বুঝলাম ব্যাপারটা। প্রজারা কেউ আমাদের মারে নি। যাদের নাম করলেন, আমি জানি তারা ভিন্ গায়ে কিষাণসভা করছিলেন। তোমার কথাই ঠিক হল। এবার বেরিয়ে তোমার কথা, জিয়াউদ্দীন সাহেবের কথা শুনব, নিজে তলিয়ে বুঝব, তবে কিছু করব। মরবার তিন দিন আগে যে ভাষায় যেভাবে কথাগুলি সে বলেছিল, ওসমানের মুখে শুনে, হয়তো ছেলেহারা ওসমানের মুখে শোনার জন্যই, মনে আমিনার গাঁথা হয়ে আছে মুখস্থ করা ইস্তাহারের মতো। ছেলে বাঁচবে এটাই জানা ছিল ওসমানের। ছেলে মরবে, তিন দিনের মধ্যে। মরবে, জানা ছিল না তার। সমবেদনায় বুক ভরে গিয়ে আমিনার চোখের জল উপচে পড়তে চায়।
তারা কথা বলছে, ওসমান উঠি উঠি করছে, রসুলের খবর জানাতে সীতা আসে। সমস্ত রাস্তা সীতা ভাবতে ভাবতে এসেছে ঠিক কি ভাবে মার কাছে হাসপাতালে ছেলের অবস্থার কথা বলে মার মনে ছেলের সম্বন্ধে কতখানি আশা আর কতটুকু ভয় জাগানো চলে, যা সঠিক। রসুল মোটামুটি ভালো আছে, এবং ভালো সে দু-চার দিনের মধ্যে হয়ে উঠবে, এটাই হল প্রধান কথা।
কিন্তু ভয়েরও কারণ একটু আছে সামান্য, কিন্তু সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার মতো নয়। আমিনাকে তা জানানো দরকার। তার কাছে অনায়াসে গোপন করে যাওয়ার মতো তুচ্ছ নয় আশঙ্কাটা। আমিনাকে আজ ভয়ের কিছুই নেই জানিয়ে যাবার পর আবার কাল যদি চরম দুঃসংবাদটা তাকে জানাতে হয়, সেটা তার সঙ্গে বীভৎস শত্ৰুতাই করা হবে শুধু।
পথে মনে মনে কথা সাজিয়েছিল সীতা, এখানে এসেই সেগুলি সে ঘেঁটে ফেলে। সহজ সরলভাবে কথা বলাই সে মনে করে উচিত।
রসুলের খবরটা জানাতে এলাম। রসুল ভালো আছে, ঘুমাচ্ছে।
তবে?
ভয় পাবেন না। অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে, তার ওপর রাত্রে আবার বাড়ি এসে ফিরে যাবার হাঙ্গামা করায় খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। ওকে রক্ত দেবার ব্যবস্থা হয়েছে। এতক্ষণে বোধহয় আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। অল্প সময়ে সুস্থ হয়ে উঠবে। তবে জানেন তো, খুব দুর্বল অবস্থায় একটু ভয়। থাকেই।
ও! দুজনে একসঙ্গে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সীতাকে চমকে দিয়ে বলে, ভয় তো আছেই।
সীতা নিজেও স্বস্তি বোধ করে বলে, তাই বলছিলাম। শুধু দুর্বল হতে রক্তক্ষয়ের জন্য, রক্ত দিলেই চাঙ্গা হয়ে উঠবে। শ-এর ভয়টুকু আছে। সেটা সব ক্ষেত্রেই থাকে, সাধারণ অপারেশন, ডেলিভারি–
সীতা যেন লজ্জা পেয়েই থমকে থেমে যায় আমিনার দিকে চেয়ে।
আমিনা সায় দিয়ে বলেন, তা ঠিক। ধর নবছর পরের এ জঞ্জালটা দু-তিন মাস পরে বিয়োতে হবে, মরেই যাব হয়তো! দু মাস আগে জেলে গেলেন, তিনখানা চিঠি পেয়েছি আজতক তার। প্রতি চিঠিতে শুধু জিজ্ঞেস করছেন, আমার কি হল, আমি কেমন আছি, কি হল যেন চটপট জানাই, কারণ এই ভয়ে উনি মরছেন। জান মেয়ে, ছেলের চেয়ে আমার জন্য তার ভয় বেশি। ছেলের যা মতামত জানতেন, তাতে কেউ খুন না করলে ছেলের কিছু হবে না ধরাই ছিল। তাছাড়া, উনি ভাবতেন, ছেলের বয়স হয়েছে, ছেলে মরদ। মরদ যদি মরদের মতো মরে–
এর ওর কাছে রসুলের মার কথা সীতা শুনেছিল, এমনটি ভাবতে পারে নি। রসুলকে বাদ দিলে এই অবস্থায় এখন তাঁর দশ বছরের একটি ছেলে মাত্র সম্বল! রসুলের জেল হলে কি করবেন। সে কথাটা কি ভাবছেন না উনি? ভাবছেন নিশ্চয়। ব্যবস্থা করে নিতে পারবেন এ আত্মবিশ্বাস আছে। যা হাবার হবে ভেবে হাল ছেড়ে স্রোতে গা ভাসিয়ে দেবার মানুষ তো ওকে মনে হয় না।
সীতা একটা খাপছাড়া প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে বসে হঠাৎ–