তখন তাদের মধ্যে এসে দাঁড়ায় হানিফ।
কথা বলে সে উত্তেজনাকর মারাত্মক। ক্ষুব্ধ মানুষগুলিকে সে যেন ক্ষেপিয়ে দিতে চায়। বলতে বলতে নিজেও সে উত্তেজিত হয়ে পড়ে ভয়ানক রকম।
চল যাই সব। আজ হাঙ্গামা হবে ভীষণ। মোরা চুপ করে থাকব? চল যাই সবাই মিলে। বহুত আদমি জড়ো হবে। দোকানপাট ভেঙে সব চুরমার করে ফেলব। মোরা শুরু করে দিলে কাণ্ডটা যা বাঁধবে একচোট–
হানিফের সঙ্গে এসেছিল বুধুলাল, সে বলে ওঠে, শাবাশ! শাবাশ!
কয়েকটি অল্পবয়সী ছোকরা চঞ্চল হয়ে ওঠে কিন্তু অন্য সকলে আরো যেন শান্ত হয়ে গিয়েছে। মনে হয়। এমন কি যারা দতে দাঁত ঘষছিল তাদের চোয়াল টিল হয়ে যায়।
কি বলছ মিঞা? মাথা খারাপ নাকি? ওসমান বলে।
হানিফ ক্রুদ্ধ হয়ে বলে, কেন?
আমরা গিয়ে দোকানপাট ভাঙব, গুণ্ডাদের লুটপাটের সুবিধা হবে। ও কি একটা কথা হল? ওসমান জোর গলায় পেঁচিয়ে সবাইকে শুনিয়ে বলে, দোকানপাট ভাঙার কথা ওঠে কিসে? সভা কর, মিছিল কর, হরতাল কর। দোকান বন্ধ থাক। ব্য।
গুণ্ডা বলছ কাকে? সামনে এগিয়ে রুখে ওঠে হানিফ। হানিফ বাড়াবাড়ি করলে তাকে রুখবার জন্য উপস্থিত কয়েকজন ওসমানের কাছে ঘেঁষে আসে।
কাকে বলব? শহরে গুণ্ডা নেই? আমরা দোকানে হানা দিলে তাদের মজা, এ তো জানা কথা।
বড় বড় বেড়েছে তোমার। হানিফ শাসায়।
হাঙ্গামা কোরো না হানিফ।
সিদ্দিক বলে একপা আরো এগিয়ে হানিফের সামনে গিয়ে। আরো কয়েকজন ওসমানের কাছে ঘেঁষে আসে। সেদিকে চেয়ে একটু ইতস্তত করে হানিফ চলে যায় সঙ্গী কজনকে নিয়ে। বুধুলাল দুবার মুখ ফিরিয়ে ওসমানের দিকে তাকিয়ে যায়। সে দৃষ্টির অর্থ খুব পরিষ্কার, আচ্ছা দেখে নেব। বুধুলাল এ অঞ্চলের বিখ্যাত গুণ্ডা নেতা। হানিফের চেয়েও তার খ্যাতি ও প্রতিপত্তি বেশি।
আধঘণ্টার মধ্যে ওসমান পথে বেরিয়ে পড়ে। গণেশের সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতে আর একটু বেলা করেই হাসপাতালে যাবে, এত সকালে গিয়ে কোনো লাভ হবে না। আগে একবার রসুলের বাড়ি যাবে। রসুলের সঙ্গে দেখা করে কথাবার্তা বলার জন্য মনটা ছটফট করছিল ওসমানের। রসুল তার ছেলের মতো, সাহসে তেজে বুদ্ধি-বিবেচনায় ভুলভ্রান্তি বোকামিতে, সব দিক দিয়ে টান একটা বরাবর ছিল রসুলের দিকে তার, কিন্তু আজকের মতো সে টানে কখন টান পড়ে নি এত জোরে, আগে শুধু ছিল এই পর্যন্ত।
কত ভাবে মনটা আজ তার নাড়া খাচ্ছে, তবু তারি মধ্যে ভেসে ভেসে আসছে পারিবারিক একটা ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার আবছা চিন্তা। পরীবানু সেয়ানা হয়ে উঠেছে অনেক দিন, এবার তার সাদির ভাবনাটা রীতিমতো গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। গা থেকে প্রতি পত্রে তাগিদ আসছে পরীবানুর মার। এদিক-ওদিক ছেলে খুঁজছে ওসমান, আত্মীয়-বন্ধুর কাছ থেকে সন্ধানও আসছে মাঝে মাঝে। কিন্তু পছন্দ যেন তার হচ্ছে না একজনকেও। হবু জামায়ের কতগুলি রকমারি বৈশিষ্ট্যের মাপকাঠি যেন আগে থেকে মনের মধ্যে তৈরি হয়ে আছে, সেই মাপে খাপ খাচ্ছিল না একজনও পুরোপুরি। যে ছেলে তার নেই, জামাই খুঁজছিল সে সেই ছেলের মতো যতদূর সম্ভব সেই ছেলের মতো। এ ধারণা তার কাছে পরিষ্কার নয়, মনের এই খামখেয়ালি আবদার। টের পেলে নিজেকে সে সংযত করে ফেলত সঙ্গে সঙ্গেই। আজো সে বুঝতে পারে নি কিসে কি ঘটেছে মনে। রসুলের সঙ্গে পরীবানুর সাদি হলে তো মন্দ হয় না, এই কথাটা মনে পড়ছে ঘুরেফিরে মনের গভীর তলানো ইচ্ছার ভাসা-ভাসা ইঙ্গিতের মতো।
রসুলের বাড়ি বেশি দূরে নয়। এইটুকু পথ যেতে অনেকটা সময় লাগে ওসমানের। ইতিমধ্যেই মানুষ জড়ো হতে আরম্ভ করে দিয়েছে রাস্তায়, বিক্ষোভ প্রকাশ করতে আরম্ভ করে দিয়েছে মৃদুভাবে। সমবেত কোলাহলের বিশিষ্ট সুরটাই বিক্ষোভের। উৎসব-পার্বণে আরো বড় জনতার কলরব ওসমান শুনেছে, তার সুর একেবারে অন্য রকম। কোনো রকম গাড়ি-ঘোড়াই এক রকম চলছে না রাস্তায়। মোড়ে ওসমানের সামনে একটি মোটর গাড়িকে আটকে জবরদস্তি ফিরিয়ে। দেওয়া হল। পরক্ষণে আর একটি গাড়িকে দাঁড় করানো হল, কিন্তু আরোহীর সঙ্গে দু-একটি কি কথা হবার পর সকলে সরে দাঁড়িয়ে পথ ছেড়ে দিল, দুজন যুবক দুপাশে হেঁটে মোড়ের ভিড়টা পার করে এগিয়ে দিয়ে এল গাড়িটাকে।
ডাক্তারের গাড়ি। একজন বলল ওসমানের জিজ্ঞাসার জবাবে!
শহরের অন্যান্য জায়গাতেও কি এই রকম শুরু হয়ে গেছে?–ওসমান ভাবে। রাইফেলধারী পুলিশ-বোঝাই গাড়ি চলে যায়। ধ্বনি ওঠে জয় হিন্দ! ইনক্লাব জিন্দাবাদ। সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক। ওসমান আবার ভাবে, কর্তারা যদি ফের বোকামি করে, লাঠি আর বন্দুক দিয়ে ঠেকাতে চেষ্টা করে এই রাগ-দুঃখের প্রকাশ, কি হবে তা হলে?
আমিনা নিজেই দরজা খুলে দেন। তাঁর রাতজাগা চোখ দেখেই ওসমান শঙ্কিত কণ্ঠে বলে, রসুল–?
সে তো হাসপাতালে ফিরে গেছে। আসুন বসুন।
ওসমানকে মোড়া দিয়ে আমি নিজে রসুল যে টুলে বসে কেরোসিন কাঠের টেবিলে পড়াশোনা করে সেটাতে বসেনমোড়ার পাড়ের সুতোয় কাজ-করা কাপড়ের ঢাকনিটি ভারি সুন্দর।
ফিরে গেল কেন?
আমিনার মুখে রসুলের বাড়ি আসা ও হাসপাতালে ফিরে যাবার বিবরণ ও কারণ শুনে ওসমান খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে।
অনেক খুন বেরিয়ে গেছে।
সেটাই ভাবনা এখন। আমিনা ধীরে ধীরে বলেন।
ওসমান বলে, খুন নাকি জমা থাকে বোতলে, গায়ে ঢুকিয়ে দেয়?
তাই দিত ওকে, ও নিজে নিতে চায় নি শুনলাম। বোতলের খুন কম ছিল, অনেকের দরকার ছিল জরুরি, তাইতে।