এ জ্বালা আগেও দাশগুপ্ত মাঝে মাঝে অনুভব করেছে, তবে এমন তীব্রভাবে নয়। জীবনের একমাত্র বাহাদুরির ফানুস কয়েক মুহূর্তের জন্য ফেঁসে যাওয়া কয়েক মুহূর্তের আত্মহত্যার চেয়ে কম যাতনাদায়ক নয়।
তারপর অবশ্য সামলে নেয় দাশগুপ্ত, পুরোপুরি। সস্তা ফানুস ফুঁ দিলেই ফঁপে। কত আর করেছে চন্দ্ৰ? বিশ-পঁচিশ হাজার? তাই নিয়ে তার ক্ষোভ! এ যেন নায়েব গোমস্তা দারগার দুটো পয়সা হয়েছে দেখে রাজার হিংসা করা!
বাবু—
দাঁড়াও দাঁড়াও—। দাশগুপ্ত বলে সেনাপতির মতে, ওসব ভেবেছি। তোমার কথায় আর একটা কথা মনে পড়ল। কি জান, গণেশকে আমি আইডেটিফাই করতে চাই না, যদি না করে চলে। এখন মনে পড়ল। হাসপাতালে হট্টগোল চলছে, সুযোগ বুঝে মালটা সরিয়ে আনা চলতে পারে। যদি ফ্যাকড়া বাধে, পিটারের চিঠি দেখালেই হবে। বললেই হবে ফুট আছে, খারাপ হয়ে যাবে বলে সরিয়ে নিচ্ছি। তখন গণেশকে আইডেটিফাই করব। ফ্যাকড়া কিছু হবে না মনে হয়। দোকানের একটা চাকর, তার জন্য কে মাথা ঘামায়?
আপনার কি বুদ্ধি বাবু! চন্দ্ৰ সবিনয়ে বলে।
০৭. শিয়ালদার কাছে বস্তির ঘরে
শিয়ালদার কাছে বস্তির ঘরে ভোরে ঘুম ভাঙে ওসমানের। তার আগে অনেকে কারা জেগেছে, কথা বলছে। অনেকের কথার সমগ্র আওয়াজটাই কানে লাগে প্রথম, চেতনায় সে আওয়াজ শব্দ হয়ে ওঠে গণেশের সেই কথা : ওরা এগোবে না? শব্দিত চেতনা হয়েই যেন ছিল প্রশ্নটা তার মনেরও মধ্যে, জেগে উঠে মনে পড়ার বদলে যেন জাগরণটাই পরে এল।
শূন্য ঘরে ঘুম ভেঙে গণেশের ওই প্রশ্নটা মনের ধ্বনির মতো শোনার সঙ্গে যেন জড়িয়ে আছে। দেশের বাড়িতে বৌ ছেলেমেয়ের ভাবনা, তারা কেমন আছে এই জিজ্ঞাসা।
কাজে আজ সে যাবে না। যাওয়া উচিত হবে না। তারও নয়, কারো নয়। এক অফুরন্ত বিশ্বাস ও দৃঢ়তা অনুভব করে ওসমান, সবাই যখন এক হয়ে গেছে এগোবার প্রতিজ্ঞায়, নির্দেশ দিতে হয় নি নেতাদের, এমন অকারণ অর্থহীন অত্যাচারের প্রতিবাদও সবাই করবে এক হয়ে, কাউকে বলে দিতে হবে না। এ সিদ্ধান্তের একটা অদ্ভুত সমর্থন অনুভব করে ওসমান, শুধু তার ভিতরের বিশ্বাসে নয়, বাইরে থেকেও যেন বহু লোকের সমর্থন সে স্পষ্ট টের পাচ্ছে। প্রথমে বুঝে উঠতে পারে না। ঘরের বাইরে গিয়ে বস্তির বহু কণ্ঠের কলরব কানে এলে তখন সে বুঝতে পারে। রাত্রি শেষেই বস্তি প্রায় খালি করে যারা কাজে চলে যায়, তারা এখনো কেউ যায় নি। তার মানেই কাজে তারা আজ যাবে না, কাজে যেতে হলে ভোরের আলোয় বস্তিতে বসে উত্তেজিত আলোচনার বৈঠক বসানো চলে না। তার উঠতে দেরি হলে রহমান সিদ্দিক গোলামেরা কেউ বেরোবার সময় তাকে ডেকে দিয়ে যায়, আজ ভোর পর্যন্ত কেউ তাকে ডেকে তোলে নি কেন এতক্ষণে ওসমান বুঝতে পারে। নিজেরা যখন তারা কাজে যাবে না, ওসমান অবশ্যই যাবে না, এটা তারা নিজেরাই ধরে নিয়েছে। সুতরাং কাজ কি অনর্থক ঘুমন্ত মানুষটাকে ডেকে তুলে।
তার কারখানার লোকেদের একতা গড়ে উঠতে উঠতে বার বার ভেঙে যাচ্ছে নানা শয়তানি কারসাজিতে। ট্রামের কাজে ইস্তফা দিয়ে এখানে কাজ নিতে হওয়ায় মনে তার একটা অভাববোধ জেগেছিল। সব সময় মনের মধ্যে সে গভীর ঔৎসুক্য অনুভব করে ভেদহীন বৃহৎ এক সংগঠনের একজন হয়ে থাকতে। এই কারখানায় সে সাধ তার যেন কিছুতেই মিটছে না।
এদিকে সেদিন ট্রামকর্মীদের পরিপূর্ণ একতার পরম প্রমাণ দেখা গেল। সেই থেকে নিজেকে তার যেন বঞ্চিত মনে হয়েছে। অহরহ মনে হয়েছে ট্রামের কাজে থাকলে আজ তো সে নিজেকে ওদেরই একজন ভাবতে পারত, চব্বিশ ঘণ্টা আপনা থেকে অনুভব করত হাতে হাত মেলানো হাজার হাজার মানুষের মধ্যে সে স্থান পেয়েছে। কালও এ অভাববোধ তাকে পীড়ন করেছে। কাল কেমন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল সব! আজ সকালে বস্তিতে ঘুম ভেঙে উঠে শুধু যে সে অভাববোধ মিটে গেছে তা নয়, আশা পূর্ণ হয়েও অনেক বেশিই যেন সে পেয়েছে। ঘরের কোণে শুধু তার একার মনে সঙ্কল্প জেগেছিল, আজ সে কাজে যাবে না। ঘরের বাইরে এসে সে দেখেছে। শুধু একার নয়, সকলের মনেই আপনা থেকে সেই সঙ্কল্প দেখা দিয়েছে। তাই যদি হয়ে থাকে তবে আর হাজার হাজার কেন, সংখ্যাহীন কত মনের সঙ্গে তার মন হাত মিলিয়েছে কে বলতে পারে।
খলিল বলে, দাদা, কাণ্ড হল। ট্রাম বাস সব বন্ধ।
ওসমান সায় দেয়, তা হবে না? ও তো জানা কথা।
রেজ্জাক উত্তেজিত হয়ে বলে, রেলগাড়ি আটকে দিলে হয় না? লাইনের ওপর গিয়ে শুয়ে পড়ে? ইঞ্জিন খালি সিটি দিয়ে যাবে এক ধার থেকে এগোতে পারবে না?
ওসমান বলে, না না, রেলগাড়ি আটকানো ঠিক হবে না।
লাল ইটের লম্বা প্রাচীরের পাশে নোংরা ফাঁকা স্থানটিতে একে একে বহু লোক এসে জড়ো হয়। গায়ে মাথায় দুফেঁটা জল ঢেলে তার টিনের পাত্রটি ভরে একটু জল আনতে কলতলায় গিয়ে ধন্না দেবার জন্য গুটি গুটি চলতে চলতে বয়সের ভারে বাকা নানিও খানিক দাঁড়িয়ে যায়। মেয়েরা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করে, খুঁটিনাটি আরো বিবরণ জানতে চায়, ঝাঝালো গলায় ঘটনার বিরুদ্ধে তীব্র মন্তব্য প্রকাশ করে। অদম্য ক্রোধ ও ক্ষোভের চাপে অপূর্ব গাম্ভীর্য ও ধৈর্যের ছাপ পড়ে মুখগুলি যেন বদলে গিয়েছে মেয়ে-পুরুষের। প্রতিটি কথা, প্রতিটি সেঁক গেলা, প্রতিটি নিশ্বাস, প্রতিটি দৃষ্টিপাত শুধু প্রতিবাদ। কালকের ঘটনায় আছে যুগ-যুগান্তরের অমানুষিকতা, যুগ-যুগান্তরের সঞ্চিত ক্ষোভ তাদের করে দিয়েছে প্রতিবাদের বিস্ফোরণ। এতে আশ্চর্য কি যে, শান্ত শীতল শীতের সকালে কাপড়ের সামান্য আবরণে ঠাণ্ডায় কেঁপেও কেউ কেউ ভেতরের তাপে পাঁতে দাঁত ঘষবে।