দাশগুপ্ত কিছু বলার আগেই সে শুরু করে নিরুত্তেজ কণ্ঠে, গণেশ ফেরে নি বাবু? ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না! মাল শুধু পৌঁছে দেবে, ওর হাতে টাকা দেবার তো কথা নয়। টাকা হাতে পেয়ে লোভের বশে পালাত সে বরং সম্ভব ছিল, মাল নিয়ে পালাবার ছোকরা তো ও নয়!
চন্দ্রের সঙ্গে পরামর্শ করবে? মনে মনে কথাটা নাড়াচাড়া করে দাশগুপ্ত। চন্দ্র তার মস্ত সহায়, মানুষ চিনতে ও ওস্তাদ, এমন কি গণেশের মতো তুচ্ছ লোককে যে শুধু একতলায় দোকানের কাজে রাখতে হবে, তেতলার ব্যাপার টের পেতে দেওয়া চলবে না, এ পরামর্শও সে-ই দিয়েছিল। সে নিজে অতটা গ্রাহ্য করে নি, বরং ভেবেছিল এ ধরনের গেঁয়ো বোকা ছোকরাকেই তেতলার কাজে লাগানো নিরাপদ। দরকারের সময় তেতলার খুঁটিনাটি কাজ সে গণেশকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছে কয়েকবার। ম্যাকারন টেলিফোনে যা বলেছে তাতে বোঝা যায় মরবার আগে গণেশ কিছু বলে যেতে পারে নি, তা হলে তার নাম-ঠিকানা-পরিচয় জানবার জন্য ম্যাকারনের কাছে খোঁজ নেওয়া হত না। কিন্তু গুলি লেগে যদি এভাবে মরে না যেত গণেশ, সজ্ঞানে যদি কথা বলে যেতে পারত, হয়তো তেতলার ব্যাপারও তা হলে ফঁস করে দিয়ে যেত। ভাবলেও শিউরে ওঠে দাশগুপ্ত।
গণেশের খবর পেয়েছি চন্দর। একটা মুশকিল হয়েছে। কে কে এসেছে আজ?
অনেকে আসে নি। হাঙ্গামাটা হল। দত্ত সায়েব, বিনয় বাবু, পিটার সায়েব, রায় বাবু, ঘোষ সায়েব–
ঘোষ সায়েব এসেছেন?
হ্যাঁ। একটা ছোট মেয়েকে এনেছেন, পনের হবে কিনা। এক চুমুক খেয়ে বমি করে দিল। চন্দ্রর মুখে অদ্ভুত একপেশে হাসি ফোটে, গণেশের ব্যাপারটা কি বাবু?
বোকা পাঁঠা তো, হাঙ্গামার মধ্যে গিয়েছিল। গুলি খেয়ে মরেছে। এখন মালটাসুদ্ধ হাসপাতালে আছে। নাম-ঠিকানা খুঁজছে, ম্যাকারনকে ফোন করেছিল। গণেশ দুবার গেছে ম্যাকারনের বাড়ি, স্লিপে ঠিকানা লিখে দেবার কি দরকার ছিল? সুধীর একটা গাধা।
চন্দ্র প্রায় নির্বিকারভাবেই সব জেনে নেয় এবং মেনে নেয়।
কি করবেন ঠিক করলেন বাবু?
ঘোষকে বলব ভাবছি। ঘোষ চেষ্টা করলে মালটা সরিয়ে ফেলে সামলে নিতে পারবে।
চন্দ্রকে চিন্তিত দেখায়।
তা নয় পারবেন, আজো কিন্তু উনি সেবারেরটা ভাঙিয়ে চালাচ্ছেন! এমন তুঘোড় লোক আর দেখি নি। সামান্য ব্যাপার, কি আর করতে হয়েছিল ওনার! তাই টানছেন আজ পর্যন্ত। মদের দামটা পর্যন্ত আদায় করা যায় না। ফের ওঁকে কিছু করতে বললে পেয়ে বসবেন একেবারে।
মাথা ঝুঁকিয়ে ঝুঁকিয়ে সায় দেয় দাশগুপ্ত, জ্বালার সঙ্গে বলে, কি করা যায় বল, এ সব লোকের কত ক্ষমতা, এদের হাতে না রাখলে কি ব্যবসা চলে! ঘোষের মতো বেহায়া আর কেউ নেই। আর সকলে কাজ করে দেয় সে জন্য টাকা নেয়, কিন্তু এখানে যা খরচা করে তা দেয়। ঘোষের সেটুকু চামড়াও নেই চোখে। ব্যাটা পেয়ে বসবে, কিন্তু বুঝতে পারছ তো, ওরা খোলবার আগে মালটা সরিয়ে আনা চাই। এমনি কোনো ভাবনা ছিল না। ছোঁড়া গুলি খেয়ে মরল কিনা, মুশকিল সেখানে।
চন্দ্রর মনটা তবু খুঁতখুঁত করে। ঘোষ সায়েব যে শুধু তেতলার ভোগ সুখ আরাম বিরামের জন্য খরচা পর্যন্ত দেয় না, তা নয়, চন্দ্রর ব্যক্তিগত পাওনাও তার কাছ থেকে জোটে যৎসামান্য, একটা সাধারণ বয়-এর বকশিশের মতো। এটা যেন তারই বাড়ি, সবাই তার মাইনে করা চাকর, এমনি ব্যবহার করে ঘোষ সায়েব।
এক কাজ করলে হয় না?
বল কি করব! দাশগুপ্ত খুশি হয়, দেখি আমাদের চন্দরের বুদ্ধির দৌড়।
আপনি নিজে গিয়ে যদি গণশাকে চিনে দেন আর মালটা দাবি করে নিয়ে আসেন? মালটা সরিয়ে আনার পর ওতে কি ছিল কে জানবে, আপনি যা বলবেন তাই।
দাশগুপ্ত সত্যই আশ্চর্য হয়ে যায়, মনে মনে তারিফ করে চন্দ্রের বুদ্ধির। নিজেকে কূটবুদ্ধি খাটাতে হয় দিবারাত্রি, জীবনে একমাত্র অবলম্বন এই বুদ্ধি খাঁটিয়ে সাফল্য লাভের মাদক গর্ব, অন্যের কাছে সামান্য একটু ধূর্ততার পরিচয় পেলেই তাই আশ্চর্য মনে হয় দাশগুপ্তের।
আমিও তা ভেবেছি চন্দর। ওই যে বললাম, খুনের ব্যাপার, মালের গায়ে কোনো ছাপ নেই। দাবি করলেই কি ছাড়বে? চেনা অফিসার কেউ থাকলে বরং–
পিটার সায়েবের একখানা চিঠি নিয়ে যান না?
ওকে জানাতে চাই না। হাজার টাকা চেয়ে বসবে।
জানাবেন কেন। মাল আপনাকে দিয়ে দেবার জন্য চিঠি তো চাইবেন না। কি দরকার? শুধু আপনি অমুক লোক, আপনাকে ও চেনে এই বলে একটা চিঠি দেবে। ব্যস্। বলবেন, যদি দরকার। লাগে তাই দুলাইন সার্টিফিকেটটা রাখছেন। এক বোতল স্কচ দিলেই খুশি হয়ে লিখে দেবে।
চন্দ্রের বুদ্ধিতে এবার এত বেশি আশ্চর্য হয়ে যায় দাশগুপ্ত যে, ঈর্ষায় জ্বলে যায় তার বুকটা। সত্যই যায়। চন্দ্ৰ তার চাকর, সে তাকে বাবু বলে, তবু। কয়েক মুহূর্তের জন্য তার মনে হয়, আসলে চন্দ্রই চালাচ্ছে তার সমস্ত কারবার নিজে আড়ালে থেকে তাকে সামনে খাড়া করে রেখে, চন্দ্ৰ তার চেয়ে ঢের বেশি বুদ্ধিমান। আয়ের মোটা ভাগটাই তার বটে, কিন্তু সেটাও এক হিসাবে চন্দ্রের বুদ্ধিরই পরিচয়। তার যেমন আয় বেশি তেমনি সমস্ত দায়িত্ব তার ঘাড়ে, সমস্ত বিপদ তার, নিজেকে সবদিক দিয়ে বাঁচিয়ে রেখে চন্দ্ৰ তো কম রোজগার করছে না। যুদ্ধের আগে তার ও চন্দ্রের অবস্থা যা ছিল তার সঙ্গে তুলনা করে হিসাবে ধরলে তার চেয়ে চন্দ্রের সাফল্য আর উন্নতি কি শতগুণ বেশি হবে না? তার মতো একজনকে অবলম্বন না করে চন্দ্রের পক্ষে এত বড় স্কেলে। কারবার চালানো সম্ভব ছিল না। সম্ভ্ৰান্ত ঘরের শিক্ষিত ফ্যাশন-কায়দাদুরস্ত মোটামুটি অবস্থাপন্ন বড় বড় লোকের সঙ্গে অন্ততপক্ষে মৌখিক পরিচয়যুক্ত তার মতো একজনকে না পেলে এত কাও করতে পারত না চন্দ্র। তার মোটা প্রতিপত্তি, তার মোটা দায়িত্ব তাকে মোটা আয় দিয়ে নিজের স্বপ্ন সফল করতে আপত্তি হবে কেন চন্দ্রের! তার স্বপ্ন সফল হয় নি। অনেক সে পেয়েছে কিন্তু দুহাতে দিতেও হয়েছে অনেক। চন্দ্ৰ যে এত টাকা মারছে, তার দশ হাজার উপাৰ্জন হলে চন্দ্রের যেখানে দশ টাকা হওয়া উচিত সেখানে সে যে হাজার টাকা গাপ করছে, চোখ-কান। বুজে তার সেটা সহ্য করে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। চন্দ্রকে ছাড়া তার চলবে না, চন্দ্ৰই যেন সব চালাচ্ছে।