উচ্ছঙ্খলায় কি মিল হয়? কি মানে সে মিলের?
শীতের তাজা রোদে উজ্জ্বল দিন। কি তাজা দেখাচ্ছে এদের মুখগুলি, কত উজ্জ্বল সকলের দৃষ্টি! দুঃখ বোধ করেছিল হেমন্ত। অপচয়ে ক্ষয়ের চাপ পড়ে না, ভ্রান্ত আদর্শ কাবু করে না, এমন যে অফুরন্ত তরুণ প্রাণশক্তি আর বিশ্বাস, তার কি শোচনীয় অপব্যবহার! একবার ভেবেছিল হেমন্ত, চলে যায়। কি হবে এদের গরম গরম চিৎকার শুনে? আর যদি মতভেদ ঘটে, বাদানুবাদ হয়, হাতাহাতি মারামারি আরম্ভ হয়ে যায়, আরো তখন বেশি খারাপ হয়ে যাবে মনটা নিজের চোখে সব দেখে। তার চেয়ে কাল খবরের কাগজে পড়লেই হবে কি হল না হল সভায়।
কিন্তু চলে যেতে সে পারে নি।
প্রদীপ্ত মুখগুলি, নির্ভীক চোখগুলি আশপাশের ছাড়া-ছাড়া কথা ও আলোচনার টুকরোগুলি, সমস্বরে শ্লোগান উচ্চারণের ধ্বনিগুলি আর অনুভূতির এক অদ্ভুত দুরন্তপনা তাকে আটকে রেখেছে।
বক্তৃতা যারা দিয়েছে তাদের মধ্যে তিনজন হেমন্তের চেনা। বুকের মধ্যে তোলপাড় করেছে। তার, খানিক বক্তৃতা শুনে বাকিটা এই তিনজন চেনা ছাত্রের নতুন পরিচয় আবিষ্কার করার বিস্ময় ও উত্তেজনায়। চোখে দেখে কানে শুনেও অবিশ্বাস্য, অসম্ভব মনে হয় এখানে ওদের উপস্থিতি, আন্দোলনে অংশগ্রহণ! বিশেষভাবে শুদ্ধসত্ত্বের–যার সঙ্গে পাল্লা দিতে হওয়ায় গত পরীক্ষায় সে অনার্সে প্রথম স্থানটি পায় নি বলে আজো তার বুকে ক্ষোভ জমা হয়ে আছে। আনোয়ার ও শিবনাথের পরীক্ষার ফলও তো কত ভালো ছেলের বুকে ঈর্ষার আগুন জ্বলে দিয়েছে। ওরা রাজনীতিও করে আবার শান্তশিষ্ট ভদ্র হয়ে থাকে, ছাত্রজীবনে সাংস্কৃতিক সব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে, পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো করে কি করে?
মাকে মনে পড়ে হেমন্তের। সীতাকেও। এইখানে এভাবে তাকে পুলিশের লাঠি ও গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে বসে থাকতে দেখলে মার মুখের ভাব কিরকম হত ভাবতে গিয়ে কল্পনায় যেন কিছুতেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে চায় না মার মুখখানা, বড় বড় চোখের আতঙ্ক-বিহ্বলতার আড়ালে মুখের বাকি অংশ ঝাপসা হয়ে থাকে। আজ এত দিন পরে মার কাছে তার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হল–একেবারে চরমভাবে। রাজনীতি মাথায় ঢুকলে পড়াশোনায় তার অবহেলা আসবে, সে মানুষ হবে। না, হয়তো জেলেও যেতে হবে তাকে ছমাস এক বছরের জন্য, এই হল মার ভয়, দুর্ভাবনার সীমা। মরণের সামনে সে যে মুখোমুখি দাঁড়াবে কোনোদিন আজকের মতে, এ কথা মা বোধহয় স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি কোনোকালে। রাজনৈতিক সভায় পর্যন্ত কখনো যাবে না বলে যে ছেলে কথা দিয়েছে আর সে কথা পালন করে এসেছে এত দিন অক্ষরে অক্ষরে, তার হঠাৎ এমন মতিভ্ৰম হবে যে সভা থেকে শোভাযাত্রায় যোগ দিয়েও যথেষ্ট হয়েছে মনে না করে হাঙ্গামার মধ্যে খুন। হবার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে, এ কথা জানলে রক্ত বোধহয় হিম হয়ে যাবে মার।
সে সিগারেট খেতে আরম্ভ করবে এই ভয়ে মার বুক কঁপে!
কাল জোর করে তার হাতে একটা সিগারেট খুঁজে দিয়েছিল পঙ্কজ, বলেছিল, ওগো ভালো ছেলে, একটু ধোঁয়া দাও বুদ্ধির গোড়ায়, বুদ্ধি সাফ হবে। সীতা তাকে ভালো ছেলে বলে ডাকে, বন্ধুরা ডাকটা লুফে নিয়েছে। সিগারেট হেমন্ত খায় না, পান-সুপারির নেশাটুকু পর্যন্ত তার নেই। সিগারেটটা সে পকেটে রেখে দিয়েছিল। ভাত খেয়ে জামা পরে বেরোবার সময় পকেটের সিগারেটটা হাতে লাগায় কেন, কি খেয়াল জেগেছিল তার সে নিজেই জানে না, দেশলাই খুঁজে এনে সিগারেটটা ধরিয়েছিল কাঠের চেয়ারে আরাম করে বসে। পঙ্কজের অনুকরণে টান দিয়েই কাশতে কাশতে সিগারেটটা সে ছুড়ে দিয়েছিল ঘরের কোনায়, সেখানে সেটা পুড়ছিল। মাথা ঘুরে ওঠায় একটু সামলে নেবার জন্য চেয়ারেই বসেছিল হেমন্ত।
ঘরে ঢুকে সিগারেটের গন্ধ নাকে যেতেই মা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিলেন। শূন্য ঘর দেখেও তিনি। যে ব্যাকুল দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক খুঁজছিলেন, হেমন্ত টের পেয়েছিল। অন্য যে কোনো একজন লোক ঘরে থাকলে মা সঙ্গে সঙ্গে স্বস্তি পেতেন, নিশ্চিন্ত হতেন।
বেরোস নি?
কত চেষ্টায় মা গলা কাঁপতে দেন নি, সহজভাবে কথা বলেছেন, বুঝতে পেরেছিল হেমন্ত।
এই বেরোব এবার। জল দাও তো একটু।
হেমন্ত জল খেয়ে গেলাস নামিয়ে রাখার পরও মা সোজাসুজি সিগারেটের কথা তুলতে পারেন। নি। জিজ্ঞেস করার অদম্য ইচ্ছা জোর করে চেপে রেখেছিলেন হেমন্ত কি জবাব দেবে এই ভয়ে। যদি সে বলে বসে, হ্যাঁ, সিগারেট সে ধরেছে। যদি সে রাগ করে সামান্য সিগারেট খাওয়া নিয়ে পর্যন্ত তাঁর চেচোনিতে তার বয়সের কোন্ ছেলেটা না সিগারেট খায়? আর ভীরু করুণ দৃষ্টি শুধু বার বার গিয়ে পড়ছিল ঘরের কোনায় জ্বলন্ত সিগারেটটার দিকে, হেমন্তের মুখে বুলিয়ে নিয়েই চোখ নত করছিলেন।
তারপর হঠাৎ সেই চোখ ভরে গিয়েছিল জলে। হেমন্ত তখন ব্যস্ত হয়ে বলেছিল, কাঁদতে আরম্ভ করে দিলে মা? সিগারেট আমি খাই না, তোমার ভাবনা নেই। পঙ্কজ একটা সিগারেট দিয়েছিল, হঠাৎ কি শখ হল, ধরিয়েছিলাম। খেতে পারি নি, তাই ফেলে দিয়েছি।
ও! বলে মা নিশ্চিন্ত হয়ে মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন, বলেছিলেন, কেন কেঁদেছি শুনবি হেমা? তুই সিগারেট খাস ভেবে নয়, আমায় লুকিয়ে খাস ভেবে, খাওয়া অন্যায় জেনে খাস ভেবে। আমি মনে করলাম, আমায় আসতে দেখে তুই তাড়াতাড়ি সিগারেটটা ফেলে দিয়েছিল। নইলে সিগারেট খাওয়া দোষের নয় বুঝে তুই যদি খাস হেমা, খেতে ইচ্ছা হলে—