বোকামিকে প্রশ্রয় দিতে আজ রাত্রে অন্তত অক্ষয় একেবারেই রাজি নয়!
মাকে প্রণাম করার ঝেকটাও তার কেটে গেছে। এমন এক জায়গায় উঠে গিয়েছিল তার মনটা সেখানে কোনো মনেরই বাস্তব আশ্রয় নেই, সুধার কল্যাণে সেখান থেকে নেমে এসে সে এখন বুঝতে পারছে সে মদ খেয়ে আসে নি বলে রাতদুপুরে মাকে ঘুম থেকে তুলে প্রণাম করতে গেলে সে পাগলামিকে লোকে চেনা মাতালের মাতলামিই মনে করবে।
অনেক দিন পরে এমন সাদাসিধে সহজ কথা সাদাসিধে সহজভাবে ভাবতে বড় ভালো লাগে তার। যদিও রোগের অস্বস্তি, সবকিছু থেকে বঞ্চিত হবার, সবকিছু ফুরিয়ে যাবার উৎকট অনুভূতি, মনকে খিচে রাখা পুঞ্জ পুঞ্জ অন্ধ আতঙ্ক সে মাথা কপাল খুঁড়লেও আজ রাত্রে এক চুমুক পাওয়া যাবে না, এসব পুরোমাত্রায় বজায় আছে।
০৬. গাঢ় নীল বৈদ্যুতিক আলোয়
গাঢ় নীল বৈদ্যুতিক আলোয় লেখা বিদ্যুৎ লিমিটেড সাইনটা বহু দূর থেকে চোখে পড়ে। প্রকাণ্ড চওড়া নতুন রাজপথ, দুদিকে বিরাট অট্টালিকা, মোড় থেকে যত দূর চোখ যায় সিধা চলে গেছে। শহরের উন্নতির আধুনিক চিহ্ন। আঁকাবাকা নোংরা গলি আর বস্তিগুলিকে অট্টালিকার পিছনে আড়াল করে রেখে শহরে যে বড়লোকের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে তার এই সব প্রমাণ সৃষ্টির পরিকল্পনা যুদ্ধের কিছু আগে কার্যকরী হচ্ছিল। যুদ্ধ বাঁধলে অবশ্য সব স্থগিত হয়ে যায়। বিরাট বিরাট লোহার কঙ্কালগুলি আজো সাক্ষ্য দিচ্ছে কত অকস্মাৎ গঠনের প্রচেষ্টা স্থগিত হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধের সময় এ সব রাস্তাও ছিল অন্ধকার! যুদ্ধের পর এখন আবার অমাবস্যার রাতেও পূর্ণিমার জ্যোৎস্না বিতরণ করতে আরম্ভ করেছে অসংখ্য চোখ ঝলসানো আলো।
বিদ্যুৎ লিমিটেড তিনতলা বাড়িটার নিচের তলায় রাস্তার দিকে পাঁচটি বড় বড় দোকানের একটি। এন, দাশগুপ্তের প্রকাশ্য ব্যবসাকেন্দ্র এই বিদ্যুৎ লিমিটেড। তার আরো অনেক অপ্রকাশ্য ব্যবসা যুদ্ধের সময় ছিল, এখনো আছে কারণ, একথা সবাই জানে যে যুদ্ধ থামলেও অনেক চোরাগোপ্তা কারবারের সুদিনের জের মহাসমারোহে চলেছেই বেশ কিছুকাল চলবার ভরসা রেখে। উপরে উত্তরের দিকে দোতলার ফ্ল্যাটে সে বাস করে। ঠিক উপরের তেতলার ফ্ল্যাটটাও অন্য নামে সে ভাড়া করে রেখেছে। অনেকের উপকারের জন্য এখানে বেনামি ঘরোয়া হোটেল, নাইট ক্লাব ও বার চালু আছে। অনেক পদস্থ লোক সন্ধ্যার পর সঙ্গিনী নিয়ে আসে, কেউ থাকে, কেউ চলে যায়। অনেক পদস্থ লোক মাঝরাত্রে সঙ্গিনীকে নিয়ে কোথায় যাবে ভেবে না পেলে, অন্য পদস্থ লোকের কাছে আগে থেকে নির্দেশ পাওয়া থাকলে, নিৰ্ভয়ে এখানে এসে জোটে, খাদ্য, পানীয়, ঘর, শয্যা সব কিছু তার জোটে। কোনো কিছুর অভাব ঘটে না।
টেলিফোনের রিসিভার নামিয়ে রেখে বহুক্ষণ দাশগুপ্ত কুঞ্চিত করে শূন্যে তাকিয়ে থাকে। এসব ব্যবসায়ে এইগুলি হল আসল হাঙ্গামা সামান্য তুচ্ছ ব্যাপারের অভাবনীয় পরিণতি। দশ-বিশ-পনের হাজার টাকার কত বড় বড় ডিল কত সহজে আপনা থেকে হয়ে যায়, ভীষণ রিস্ক নিয়েও এক মুহূর্তের দুর্ভাবনা দরকার হয় না। আর সামান্য কয়েক শ টাকার ব্যাপারে এই রকম ফ্যাকড়া বাধে। গণেশ আগেও কতবার মাল পৌঁছে দিয়ে এসেছে ওই সায়েবের বাড়িতে। স্বপ্নেও কখনো সে ভাবতে পারে নি গণেশ রাস্তার হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়ে তাকে এ ভাবে হাঙ্গামায় ফেলবে!
ভাবলেও গা জ্বালা করে দাশগুপ্তের। যে দিক থেকে কোনো বিপদের আশঙ্কা করে নি, ঠিক সেই দিক থেকে এই বিপদ এল! দুৰ্ভাগ্য ছাড়া কি বলা যায় একে। জ্বালা বেড়ে গেল এই ভেবে যে গেয়ো ছেলেটা বোধহয় নিছক কৌতূহলের বশেই রাস্তার হাঙ্গামা হৈচৈ দেখতে দাঁড়িয়েছিল, গুলি লেগে যে বজ্জাত ছোকরাগুলো নিছক বজ্ঞাতি করার কেঁকে গুলির সামনে বাহাদুরি করছে তাদের বদলে সেই গেল মরে! ওর নাম-ঠিকানা আবিষ্কার করতে গিয়ে এখন বেরিয়ে পড়বে তারা চোরা মাল চালান। হাসপাতালে কে তাকে খাতির করে? কে অনুভব করবে যে ব্যাপারটা চাপা দেওয়া দরকার? হয়তো হৈচৈ পড়ে যাবে। হয়তো কোনো উপায় থাকবে না তাকে টানাটানি না করে। নিজেদের বাঁচাবার জন্য বাধ্য হয়ে হয়তো তাকেই বলি দেবে বড় কর্তারা, যাদের হাতে নোট পাবার হাত চুলকানি শান্ত করতে তার প্রাণান্ত।
কিছু হয়তো হবে না তার শেষ পর্যন্ত, সামলে নিতে পারবে। কিন্তু দাশগুপ্তের বিদ্যুৎ লিমিটেড থেকে রেডিওর বাক্সে চোরাই বিলাতি মদ চালান যায় এটা প্রকাশ পেলে অপদস্থ হতে হবে তো তাকে! কিছু কি করা যায় না? সামলানো যায় না আগেই? এত গণ্যমান্য ক্ষমতাবান লোকের সঙ্গে তার খাতির, আগে থেকে চাপা দিয়ে দেওয়া যায় না ব্যাপারটা?
দাশগুপ্ত ডাকে, চন্দর!
চন্দ্র ওপরে বাবু।
ডেকে দে। শিগগির।
দাশগুপ্তের পরম বিশ্বাসী ধূৰ্তশ্রেষ্ঠ চন্দ্ৰ এসে দাঁড়ায়। মাঝবয়সী ঈষৎ স্থূলকায় মানুষটা, মুখখানা গোলাকার। আইএ পর্যন্ত পড়েছিল, বুদ্ধিটা তাতে শাণিত হয়েছে। তিনতলা একরকম সেই চালায়, বড়লোক, মাঝারি লোক সবাইকে খুশি রাখে এবং যার কাছে যত বেশি সম্ভব খসিয়ে নেয়। হিসাব রাখে, অন্য চাকরদের হুকুম দেয়, সম্ভ্ৰান্ত ঘরের যে মেয়েরা শিকার খুঁজতে আসে, তাদের প্রয়োজন মতো সবিনয়ে ও সসম্মানে অলঙনীয় নির্দেশ দেয়, আবার দরকার হলে প্যাট্রনের সোডার বোতল নিজ হাতে খুলে দেওয়া থেকে পা-ও চাটে।