মা কি ঘুমিয়ে পড়েছেন সুধা?
কি জানি।
বোসো এখুনি আসছি।
কোথা যাবে? সুধা আর্তনাদ চেপে বলে।
মাকে প্রণাম করে আসি।
বলে অক্ষয় ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। বারান্দার কোণ ঘুরলেই মার শোবার ঘরের দরজা মা আর অক্ষয়ের বোন ললিতা শোয় ও-ঘরে। বারান্দার কোণটা ঘুরবার সময় সুধার দেহটা একেবারে পায়ের ওপর এসে পড়ায় অক্ষয়কে থামতে হয়।
পায়ে পড়ি তোমার, রাতদুপুরে কেলেঙ্কারি কোরো না। মা ঘুমুচ্ছেন।
অক্ষয় বলে, আরে! কি করছ তুমি! এত রাতে ফিরে মাকে প্রণাম করতে যাচ্ছি কেন বুঝতে পারছ না? আজ খেয়ে আসি নি। মা খুশি হবেন শুনে।
ঘুম ভাঙালে মার শরীর খারাপ হয়। কাল সকালে মাকে প্রণাম কোরো।
অক্ষয় আহত হয়, সুধা বিশ্বাস করে নি!
সত্যি খাই নি সুধা।
জানি। কিন্তু মাকে ঘুমাতে দাও। ঘরে চল। চল।
আগে তোমাকে বোঝাতে হবে দেখছি।
ঘরে গিয়া সুধা বলে, এক কাজ কর, কেমন। শুয়ে পড়ি এস। আমারও ঘুম পেয়েছে, দুজনে শুয়ে পড়ি।
খাব না?
খেয়ে আস নি? অন্য দিন তো–! এস তবে, বোলো।
সুধা তাড়াতাড়ি আসন এনে পেতে দেয়… ঘরের কোণে অন্ন-ব্যঞ্জন ঢাকা ছিল, আসন ভাজ। করা ছিল আলনায়! বাড়ি ফিরে কদাচিৎ খায়, কিন্তু আহার্য তার প্রস্তুত হয়ে থাকে প্রতিদিন। খাক বা না খাক!
অক্ষয় ধীরে ধীরে আসনে বসে। সাজিয়ে গুছিয়ে সব ঠিক করে সামনে দেবার পরও সে হাত গুটিয়ে বসে থাকে। সুধার গৃহিণীপনা দেখতে দেখতে চোখে তার পলক পড়ে না। সে আজ সত্যই গন্ধও সেঁকে নি মদের। কিন্তু সুধা জানে সে মাতাল হয়ে এসেছে। জেনেও সুধা হাল ছাড়ে নি, বিশ্বাস হারায় নি, আশা বাদ দেয় নি। মরে তো সুধা তবে যায় নি, আজ সে মদ খেয়ে এসেছে। জেনেও, যা সে ভাবছিল এতক্ষণ। তার প্রতিজ্ঞা-ভঙ্গের আঘাত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে আঘাত। সামলে নিয়ে সুধা তো আবার আশা করছে। আজ পারে নি, কাল হয়তো পারবে, কিংবা দুদিন-দশ দিন না পেরে ক্ৰমে ক্ৰমে একদিন হয়তো পারবে, ইতিমধ্যেই এই বিশ্বাস সৃষ্টি করে সুধা জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রচনা করছে বাঁচবার অপরাজেয় প্রেরণায়!
মরা সোজা, তাই সে ভেবেছিল আজ যদি সে মদ খায়, সুধা সোজাসুজি মরবে। সে কি জানত জীবনকে এত বেশি শ্রদ্ধা করে সুধা যে, মরা সহজ মনে হলেও বাঁচবার জন্য সে এমনভাবে লড়বে চরম হতাশায় আশা না ছেড়ে, ব্যর্থতার পরম প্রমাণকে শেষ বলে ধরে না নিয়ে? সাধারণ পতিপ্রাণা বৌ বলে সুধাকে জানত অক্ষয়। তাকে অসাধারণ সে ভাবতে পারে না এখনো। কিন্তু জীবনে আজ প্রথম জীবনযুদ্ধে সাধারণ একটি নারীর স্বাভাবিক সংগ্রাম শক্তির স্বরূপ আঁচ করে সে স্তম্ভিত, অভিভূত হয়ে যায়।
বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি তোমার?
হচ্ছে বৈকি, বাঃ! খাও।
সত্যি বলছি, খাই নি আজ। তোমার কাছে কিছু গোপন করব না। খাই নি বটে, কিন্তু তাতে আমার বাহাদুরি নেই। খাব না বলেছিলাম বলে খাই নি, তা সত্যি নয়। খাবার জন্য হোটেলের। দরজা পর্যন্ত গিয়েছিলাম। অন্য দিনের চেয়ে বেশিই হয়তো আজ খেতাম সুধা। কিন্তু এমন ব্যাপার আজ দেখলাম, যাদের মেয়েৰ্শোকা ভাবপ্রবণ ফাজিল ছোকরা বলে জানতাম, তাদের এমন অদ্ভুত মনের জোর দেখলাম, আমি একেবারে থতমত খেয়ে গেলাম সুধা। বুঝলাম যে, আমি যা ভাবি সব ভুল। মদ খেতে হোটেলের দরজা পর্যন্ত গেলাম, কিন্তু তখনো ভাবছি, গুলি খেলে মরতে হবে জেনেও সাধারণ একটা ছেলে যে গুলি খাবার জন্য তৈরি, ওটা কিসের নেশা? মদ না খেয়েও যদি মানুষের ওরকম নেশা হতে পারে, আমি তবে কেন বোকার মতো গাঁটের পয়সা খরচ করে এই সস্তা বিশ্রী নেশা করি! ওই ছেলেগুলোর জন্য আজ খেতে পারলাম না। আমার মনের জোরের জন্য নয়।
বেশ তো, বেশ তো, সুধা বলে শ্ৰান্ত, ক্লান্ত ব্যাহত গলায়, শুনবখন সব কথা কাল। খেয়ে নাও।
অক্ষয় স্তম্ভিত হয়ে থাকে। সুধা এখনো বিশ্বাস করে নি! তার কথা আবোল-তাবোল ঠেকছে। সুধার কাছে। তার কথা শুনে সুধার বিশ্বাস শুধু আরো দৃঢ় হয়েছে যে আজ সে অন্য দিনের চেয়ে। বেশি মদ খেয়েছে, হৈচৈ করার স্তর পার হয়ে উঠে গিয়েছে দার্শনিকতার স্তরে।
মদ খেলে মুখে গন্ধ থাকবেই সুধা।
কেন ভাবছ। গন্ধ কেউ পাবে না। কাল সকালে সেই গার্গল আর–
গন্ধ পাচ্ছ?–অক্ষয় মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে সুধাকে নিশ্বাসের গন্ধ শোকায়! আগেই এ প্রমাণ তার দেওয়া উচিত ছিল সুধাকে। ভাবপ্রবণ, অভিমানী, বিকারগ্রস্ত মন তার, তাই না সে চেয়েছে বড় বড় কথার প্যাচে সুধাকে বিশ্বাস করাতে রাতদুপুরে যে ধরনের কথা বললে অজানা লোকেরও সন্দেহ হবে লোকটা মাতাল।
সত্যি খাও নি তো তুমি!
সত্যি খাই নি।
মুখের চেহারা বদলিয়ে সুধা তার দিকে চেয়ে থাকে। এতক্ষণে বিশ্বাস করেও সে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না তার এত বড় সৌভাগ্য কি করে সম্ভব।
একদিন না খেলে কি হয়?
তা ঠিক।
সহজভাবেই সায় দেয় অক্ষয়। তার অভিমানও হয় না, রাগও হয় না। একদিন প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করলে সুধা সেটা সহ্য করে এই জন্য যে, একদিন প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা চরম নয়, শেষ পর্যন্ত প্ৰতিজ্ঞাটা আসল কথা। এটা অক্ষয় আজ জেনেছিল খানিক আগে। তাই একদিন আজ সে মদ খায় নি এটা যে অসাধারণ ব্যাপার কিছু নয়, কাল পরশু তরশু যদি না খেয়ে থাকতে পারে তবেই জানা যাবে সে সত্যই সত্যই জয়ী হয়েছে, সুধার এই ইঙ্গিত তাকে ক্ষুণ্ণ করে না। সুধা ঠিক কথাই বলেছে। কেউ ঠিক কথা বললে খুশি না হওয়া বোকামি।