আদর খেতে এলাম, আমায় মোটে আদর করছ না মা!
তোর মা হওয়ার যা ঝকমারি, আদর করতে মোটে ইচ্ছে যায় না রসুল।
রসুলের মাথাটা আরো জোরে বুকে চেপে ধরে আমিনা বলেন, হাসপাতালে গেছিস জেনে নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। জানি তো এমনি ভাবে যাবি একদিন, দুদিন আগে আর পরে। আগে গেলেই বরং চুকে-বুকে যায় সব। লতাকে পুড়তে হয় না চব্বিশ ঘণ্টা মনে মনে, আমাকেও পুড়তে হয় না। চব্বিশ ঘণ্টা তোর কথা ভেবে ভেবে–
মা, জান? ফিসফিস করে রসুল বলে।
তেমনি ফিসফিস করে আমিনা বলেন, কি?
আমায় আটকে দিয়েছিল হাসপাতালে। তোমায় দেখতে কেমন করতে লাগল মনটা। চুপিচুপি পালিয়ে এসেছি।
আঁ? ডাক্তার বলেছিল শুয়ে থাকতে। চুপিচুপি তুই পালিয়ে এসেছিস এই রাতে এক মাইল পথ হেঁটে?
তোমার একটু আদর না পেলে কি এ যন্ত্ৰণা সয়?
রসুল বুঝতে পারে, মা নিঃশব্দে কাঁদছেন। বেশ রক্ত বেরিয়ে যাবার ফলে একদিকে যেমন দুর্বল অশক্ত মনে হচ্ছে শরীরটা, তেমনি আবার কেমন অদ্ভুত রকমের ভেঁাতা অবসন্নতা এসেছে। অনুভূতিতে। আমিনার কান্না যে অগাধ ও অসহনীয় বিষাদে হৃদয় ভরে দেয়, রসুল জানে সেটা সাময়িক ও কৃত্রিম। রক্তক্ষরণের ফলে শুধু এই প্রতিক্রিয়া এসেছে। নইলে এত রাত্রে এসে মাকে কাঁদাতে তার মোটে ভালো লাগত না, এলেও কাদাবার বদলে নিজেই সে হৈচৈ হাঙ্গামায় অস্থির করে ভুলিয়ে রাখত মাকে। কিন্তু আজ এমন দুর্বল হয়ে গেছে মনটা যে মাকে আরো বেশি কাদিয়ে দুঃখটা উপভোগ করতে ইচ্ছে হচ্ছে। ডাক্তার সত্যি বলেছিল যে, রক্তক্ষয়ের কতগুলি অদ্ভুত খাপছাড়া প্রতিক্রিয়া আছে নিজেকে হঠাৎ অতিরিক্ত সবল মনে করে সে যেন বিছানা ছেড়ে উঠবার চেষ্টা না করে। তাই সে করেছে শেষ পর্যন্ত! বেড ছেড়ে উঠে এক মাইল রাস্তা হেঁটে মাকে কঁদাতে এসেছে।
দাঁতে দাঁত ঘষে রসুল মনে মনে বলে, না, বিকারের ঝোঁকে মাকে সে কাঁদাতে আসে নি, ভেবেচিন্তে যা করেছে সে কাজকে ওই সস্তা দুর্বলতায় পরিণত হতে সে দেবে না, রক্ত ক্ষয় হবার জন্য তো নয় শুধু, গ্রেপ্তার হওয়ার জন্যও বটে। হাসপাতালে গ্রেপ্তার না হলে কি তার মাকে এ ভাবে দেখতে আসবার ঝোঁক চাপত! আবার কবে দেখা হয়, মার মনে একটু শান্তি ও শক্তি দেবার চেষ্টা করা তার উচিত, এ সব হিসাব করেই সে এসেছে মাকে দেখতে। মাকে কাঁদয়ে খুশি হয়ে যেতে নয়।
তবে তুমি কাঁদ, আমি যাই।
কাঁদছি কই?
এবার যে কথা বলব শুনে কিন্তু ভেউ-ভেউ করে কাঁদবে।
–ইস্!
না সত্যি। হাঙ্গামার কথা। সেই জন্য তো রাতদুপুরে পালিয়ে পালিয়ে এলাম তোমায় দেখতে।
সুতরাং তখন মনটা শক্ত করতে হল আমিনার। চোখের জল চলে গেল আড়ালে, অন্য সময়ের জন্য। ছেলে যদি মুশকিলে পড়েই থাকে, তাকে এখন সাহস যোগানো দরকার, নিজের দুর্বলতা দিয়ে তাকে কাবু করে আনা সঙ্গত হবে না। রসুলও জানত, তার বিপদের খবর শুনে মার পক্ষে আত্মসংবরণ করা সহজ হবে। হাতে গুলি লেগেই সব শেষ হয় নি, এখনো হাঙ্গামা সঞ্চিত আছে। তার জন্য, এ কথা শুনলেই মার কান্না স্থগিত হয়ে যাবে।
আমাকে গ্রেপ্তার করেছে।
গ্রেপ্তার? কেন?
হাঙ্গামায় ছিলাম বলে।
তোর হাতে গুলি লাগল, তোকেই গ্রেপ্তার করল কি রকম?
ওই তো খাঁটি প্রমাণ যে আমি হাঙ্গামায় ছিলাম। নইলে আহত হব কেন?
–বাঃ, বেশ!
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে রসুল। শরীরটা সত্যই বড় দুর্বল লাগছে। মনে কোনো কষ্ট নেই কিন্তু শান্ত গভীর সেই করুণ বিষাদের ভাবটা কাটছে না।
আনমনা ছেলের চুলের ভেতরে আঙুল দিয়ে আমিনা তার মাথাটা তোকিয়ে দেন ধীরে ধীরে। মনে অসংখ্য প্রশ্ন এসে ভিড় করেছে। তার মধ্যে কয়েকটি মাত্র জিজ্ঞাসা করা যায়, বাকিগুলি চিরকাল অবোধ আকুল মনের প্রশ্ন হয়েই থাকবে।
গ্রেপ্তার করে হাসপাতালে পাঠিয়েছিল?
না, হাসপাতালে গ্রেপ্তার করেছে।
জামিন দিল?
না, জামিন দেয় নি।
তবে?
পালিয়ে এসেছি, তোমার জন্যে। ভোরে আবার ফিরে যেতে হবে।
কেন? ফিরে যাবি কেন?
যাব না? আরো তো কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছে; তারা কেউ পালায় নি। ফিরে না গেলে লোকে বলবে না তোমার ছেলে গ্রেপ্তার হয়ে একা পালিয়েছে?
তবে এখন ঘুমো, আর কথা নয়।
আমিনাও কিছু কিছু বুঝতে পারেন যে আঘাতের ও রক্তপাতের ফলে এমন কোনো একটা প্রক্রিয়া ঘটে গেছে রসুলের মধ্যে যার ফলে হঠাৎ মাকে কাছে পাবার ঝোঁক জাগায় নিজেকে সামলে রাখতে অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু পেরে ওঠে নি। শিশুর মতো কেন রসুল এমন পাগল হয়ে উঠল মায়ের জন্য? আর দশটি শান্তশিষ্ট ভালো ছেলের মতো হয়ে না থেকে এইসব বিপজ্জনক আজাদির ব্যাপারে যোগ দিয়ে দুঃখিনী মাকে আরো দুঃখ দিচ্ছে, এ রকম কোনো কাটা কি আছে ওর মনে, তিনি তো কোনোদিন সমালোচনা করেন নি, আফসোস জানান নি। ওরকম নিরীহ গোবেচারা ছেলেই বা কজন আছে দেশে যে, তাদের সঙ্গে তুলনায় দেশের ও দশের জন্য নিজের মাকে কষ্ট দেবার চেতনা ওর লেগেছে। আমিনার তো মনে হয় দেশের সব ছেলেই তার রসুলের মতো অন্য কোনো পথ তাদের নেই। আচ্ছন্ন অভিভূতের মতো রসুল ঘুমিয়ে থাকে, মাঝে মাঝে তার মুখ দিয়ে অস্ফুট কাতর শব্দ বার হয়। আমিনা জেগে বসে চুপ করে চেয়ে থাকেন তার রক্তহীন বিবর্ণ মুখের দিকে। তার অশ্রুহীন দুটি আরক্তিম চোখে শুধু ইঙ্গিত ফুটে থাকে হৃদয় তাঁর কি ভাবে রক্তাক্ত হয়ে আছে।
শেষরাত্রে আবদুল ঘরে ঢোকে।