জয়ন্ত ঘুমিয়ে পড়ে আগে। পরে রমাও কয়েকবার হাই তুলে বিছানায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। খাওয়ার পাট চুকেছিল হেমন্ত বাড়ি ফেরার কিছু পরেই। তখন অনুরূপা কথা পাড়েন।
ঘুম পেয়েছে হেমা?
না মা। কি বলবে বল।
আমাকে বলতে হবে?
হবে না? নইলে তোমার মনের কথা বুঝব কি করে?
নতুন কথা শোনালি আজ। আমার মনের কথা বুঝি না তুই? কপাল আমার!
শুনে হেমন্ত ভয় পেয়ে যায়। বুঝতে পারে, অনুরূপার কাছে আজ সে সহজে রেহাই পাবে না। নইলে তিনি এ সুরে কথা শুরু করতেন না। রাগ দুঃখ অভিমান অনুযোগ অভিযোগ কদাকাটা সবকিছু অস্ত্ৰ সাজিয়ে মা প্রস্তুত হয়ে আছেন। আলোচনা গড়ে তুলে এগিয়ে যাবার ভার মার হাতে ছেড়ে দিলে আর রক্ষা থাকবে না, একেবারে মর্মান্তিক কাণ্ড করে ছাড়বেন তিনি। ভেবেচিন্তে হেমন্ত নিজেই কথা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
অনুরূপা কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, বাধা দিয়ে হেমন্ত বলে, শোন, শোন। তুমি রাগ করেছ, মনে কষ্ট পেয়েছ, তোমার ভয় হয়েছে, সব আমি জানি না। তোমার সঙ্গে আমি তর্ক করব না। তর্কও করব না, তোমার কথার অবাধ্যও হব না। তুমি যদি বারণ কর কোনো কাজ করতে, তোমার কথা আমি মেনে চলব। গোড়াতে এ কথাটা স্পষ্ট করে বলে রাখলাম। এবার আসল কথা বলে তোমার মত চাইব। তুমি হাঁ কি না বলে দিও, ব্যস, সেইখানে সব খতম হয়ে যাবে। আমরা আর ও নিয়ে মাথা ঘামাব না।
অনুরূপ একটু বিব্রত বোধ করেন। এ ভাবে কথা চালাবার জন্য তিনি মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি ভাবতেও পারেন নি হেমন্ত এতটুকু লড়াই করবে না, তাকে বুঝিয়ে দলে টানবার চেষ্টা পর্যন্ত বাতিল করে দেবে গোড়াতেই, সোজাসুজি তারই ওপর সব সিদ্ধান্তের দায়িত্ব চাপিয়ে দেবে। পছন্দ হোক, অপছন্দ হোক, চোখ-কান বুজে তাঁর কথা মেনে চলতে সে প্রস্তুত, হেমন্তের এ ঘোষণায় এক দিকে হৃদয় যেমন তার উল্লাসে ভেসে যাবার উপক্রম হয়, অন্য দিকে তেমনি মতামত দেবার দায়িত্বটা যে তার কতদূর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে অনুভব করে দুর্ভাবনারও তাঁর সীমা থাকে না। শুধু মা হিসাবে অন্যায় আবদার করা চলত, যুক্তিতর্ক শূন্যে উড়িয়ে দিলেও দোষ হত না। হেমন্ত যেন সে পথটা তার বন্ধ করেছে। মা বলে তাকে আকাশে তুলেছে বটে, আছাড় খেয়ে পড়বার সম্ভাবনাও সৃষ্টি করে দিয়েছে সেই সঙ্গে।
হেমন্ত শান্ত কণ্ঠে বলে, ঘটনা সব জান। কাল একটা প্রোটেস্ট মিটিং হবে, আমি তাতে যোগ দিতে চাই। মিটিঙের পর আর একটা প্রোসেশনও হয়তো বার হবে, তাতেও আমি থাকতে চাই।
এখন তুমি যা বল।
তুই কি লেখাপড়া করতে চাস না?
কেন? তার মানে কি?
এ সব করে বেড়ালে লেখাপড়া হবে কি করে?
ও! এই কথা। হেমন্ত এবার হাসে, রোজ এসব করে বেড়াব নাকি? এ সব করা মানে তো শুধু এই যে, একটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছি। ওটুকু না করলে কি মনুষ্যত্ব থাকে? লেখাপড়ার অজুহাতে মনুষ্যত্ব ঘেঁটে ফেলতে পারি না মা, তুমি যাই বল। হাঙ্গামা যে হচ্ছে, সে দোষ আমাদের নয়।
কিন্তু হচ্ছে তো। আজ সামান্য চোট লেগেছে, কাল তো মারা যেতে পারিস। সোজাসুজি মৃত্যুর কথাটা বলে যান অনুরূপা, গলায় আটকায় না, কিন্তু তার মুখ দেখে হেমন্ত বুঝতে পারে যে, কথাটা বলতে কি উগ্র আতঙ্কে মড়মড় করে উঠেছে তার দেহ-মন।
হেমন্ত মৃদুস্বরে বলে, হয়তো সম্ভব। তোমায় মিথ্যে ভরসা দেব না।
তবে?
শোন তবে বলি তোমায়, হেমন্ত যেন দম বন্ধ করে কথা বলে, এই ভাবের ভয়ভাবনার জবাবটা আজ পেয়েছি মা, এত দিন পরে। লেখাপড়ার জন্য কি সব ছাড়া যায়? তোমাকে কিংবা রমাকে যদি একটা গুণ্ডা আক্রমণ করে, আমি যদি স্পষ্ট বুঝতে পারি তোমাদের বাঁচাতে গেলে লাঠির ঘায়ে মাথা ফেটে যাবে, ব্রেনটা খারাপ হয়ে যাবে, জীবনে লেখাপড়া কিছু আর হবে না। আমার তাই ভেবে কি তখন চুপ করে থাকব? কি হবে সে লেখাপড়া দিয়ে আমার। তবে এটাও ঠিক যে, ও হল বিশেষ অবস্থা। অবস্থাবিশেষে লেখাপড়ার কথা ভাবারও মানে হয় না। লেখাপড়া করাই যার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য তাই বলে সাধারণ অবস্থায় লেখাপড়া করব না কেন? তাই তো কাজ আমার।
অনুরূপা গুম খেয়ে থাকেন।
যাগে, হেমন্ত স্বাভাবিক গলায় বলে, বলেছি তো তোমার সঙ্গে তর্ক করব না। তুমি যা বল–হ্যাঁ কিংবা না।
মরতে পারিস জেনেও হা বলতে পারি আমিঃ অনুরূপা আৰ্তকণ্ঠে প্রায় চিৎকার করে ওঠেন।
সেটা কঠিন বটে তোমার পক্ষে বলা, হেমন্ত স্বীকার করে নেয়, এক কাজ কর তবে। হাঁ না কিছুই তুমি বোলো না। আমার ওপরে সব ছেড়ে দাও, আমি যা ভালো বুঝব করব। তাই কর মা।
অনুরূপা নিশ্বাস ফেলেন।–এ আমি আগেই জানতাম হেমা, তোর সঙ্গে পারব না।
এই ভাবে একটা বোঝাপড়ার মধ্যে মা ও ছেলের সংঘর্ষটা বেঁচে রইল। মার অনুমতি মানেই আশীৰ্বাদ। সেটা জুটল না হেমন্তের। তবে নিষেধের অভিশাপ যে এল না, অনুরূপার মতো ভদ্ৰ স্নেহাতুরা মায়ের এ পরিবর্তন কে অস্বীকার করবে? কে বুঝতে পারবে না যে, অনুরূপার পক্ষেই সম্প্ৰতি সন্তানকে আশীর্বাদ দেওয়া সম্ভব হবে, আচ্ছা মরবে যাও, এর চেয়ে মহান মৃত্যু মা হয়ে কি করে কামনা করি তোমার জন্য?
হাতটা গেছে? জীবনে আর সারবে না? আমিনার আর্তনাদ যেন চিরে দেয় ঠাণ্ডা মাঝরাত্রি।
একটা হাত তো আছে। রসুল বলে জোর দিয়ে।
তা আছে।
আমিনা আত্মসংবরণ করেন আর্তচিৎকারে ফেটে পড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। মাঝরাত্রে এভাবে। হঠাৎ ব্যাণ্ডেজ বাঁধা গলায় ঝুলানো নষ্ট হাত নিয়ে রক্তমাখা জামাকাপড় পরা ছেলে হাজির হলে কোন মা আত্মহারা না হয়ে পারে? তবে নিজেকে সামলাবার ক্ষমতা আমিনার অদ্ভুত। ছেলেটা আজাদির জন্য অনায়াসে মরতে পারে, মরবার জন্য তৈরি হয়ে আছে, টের পাবার পর থেকে আমিনার মনের এই জোরটা হু হু করে বেড়ে গেছে।