তোমার কথা শুনে একটু ভড়কে গেছি মা।
অনুরূপার ক্ষীণ ভীরু কণ্ঠ আশ্চর্য করে দেয় সীতাকে। ভড়কে যাবেন কেন?
অনুরূপ একটু ইতস্তত করে তেমনি শঙ্কিত সুরে অসহায় ভাবে বলেন, আমার ওপর রাগ করে হেমাকে হেঁটে দেবার কথা ভাবছ না তো তুমি? আমি না শেষকালে দায়ী হই।
এ কথায় অন্য সময় হাসি পেত সীতার, এখন এ আবেদনের করুণ দিকটাই তার মনে লাগে। তাকে ছেলের ভবিষ্যৎ বৌ হিসাবে ভাবতে ভাবতে কল্পনাটা অনুরূপার জোরালো বিশ্বাসে দাঁড়িয়ে গেছে যে, হেমন্ত আর সে পরস্পরকে ভালবাসে, সব ঠিক হয়ে আছে তাদের মধ্যে। এ বিষয়ে দ্বিধা-সংশয়ের লেশটুকু নেই অনুরূপার মনে। হেমন্তকে বিগড়ে দেবার জন্য মনে মনে তাকে স্থির নিশ্চিত ভাবে দায়ী করে ক্ষেপে উঠবার কারণ হয়তো তাই।
বিয়ে না হতেই শাশুড়ি-বৌয়ের লড়াই!
একটা ব্ৰতের কথা মনে পড়ে সীতার। ছেলেবেলা মামাবাড়ি গিয়ে মামাতো বোন আর পাড়ার কয়েকটি ছোট মেয়েকে এই ব্ৰত করতে দেখেছিল। যমপুকুরের ব্রত যুগ যুগ ধরে শাশুড়িরা ছেলের বৌদের যত যন্ত্রণা দিয়েছে তারই বিরুদ্ধে কচি কচি মেয়ের ব্রতের বিদ্রোহ! ব্রতের প্রচার কথাটা চমৎকার। বৌ চায় এ ব্রত করতে, শাশুড়ি বলে, না। কাজেই মরে শাশুড়ি নরকে যায়। নরকের কষ্ট সয় না–ছেলের বৌয়ের দয়ায় উদ্ধার পাওয়ার চেয়ে কোনোমতে নরকের কষ্টও অনেক ভালো মনে করে প্রাণপণে সহ্য করতে চেয়েও সয় না। অগত্যা স্বপ্নে ছেলেকে বলে দিতে হয় যে করে হোক বৌকে দিয়ে ব্ৰতটা করিয়ে আমায় উদ্ধার কর। বৌ কম চালাক নয়, বলে, শাশুড়ি নেই এ ব্রত করতে যাব কেন মিছামিছি কষ্ট সয়ে উপোস করে : এক গা গয়না দাও, দুধ ভাত খাওয়াও তবে করব ব্ৰত। ব্ৰত কথায় সে কি ঝাল ঝাড়া শাশুড়ির ওপর, আর তার মধ্যেই শাশুড়ির বৌ নির্যাতনের কি অকাট্য প্রমাণ! শাশুড়ি হল খুইদিয়া দাই।
আলো আলো খুইদিয়া দাই, ধানতলা দিলি না ঠাঁই।
আলো আলো খুইদিয়া দাই, মানতলা দিলি না ঠাঁই।
আলো আলো খুইদিয়া দাই, কলাতলা দিলি না ঠাঁই।
ছেলের সঙ্গে বিয়ের কথা পর্যন্ত হয় নি, তবু যেন অনুরূপা মরে না গিয়ে মোটাসোটা দেহটি নিয়ে জলজ্যান্ত বেঁচে থাকলেও নরক যন্ত্রণারই প্রতিকারে তাকে দিয়ে শাশুড়ি উদ্ধারের ব্ৰত পালন করিয়ে নিতে চান!
একটা কথা ভেবে সীতা স্বস্তি পায়। ছেলের দিকটা অনুরূপা বিবেচনা করবেন। এটা বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার ভাবেসাবে। যত অন্ধই হোক তার স্নেহ, ওই বিবেচনাটাও তার আছে। ছেলেকে নিজের খুশিমতো চালাতে চেয়ে উনি যে ভাবেই লড়াই করুন, হেমন্তকে অসুখী দেখলে, তার জীবনে অশান্তি এলে, নিজেই তিনি জিদ বিসর্জন দেবেন, সামঞ্জস্য খুঁজবেন। সে যা ভয়। করছিল, অনুরূপার দিক থেকে সে ভয়ের কারণ নেই।
অথবা আছে? কি করে সুনিশ্চিত হবে সীতা, কি করে বিশ্বাস করবে এরকম মা, ছেলে-প্ৰাণ। এরকম মা, ছেলেকে বিব্রত দুঃখিত অসুখী দেখলে নিজের খেয়ালখুশিকে সত্য সত্যই ছাঁটাই করে ছেলের সঙ্গে আপস করবে? বিশেষ করে, যে ছেলের জন্য এতকাল মেয়েমানুষ হয়েও টাকা রোজগার করেছেন এত কষ্টে, এত দুঃখে। একবার যদি খেয়াল হয় যে ছেলে অকৃতজ্ঞ আর কি তখন সহজ বুদ্ধিটি টিকবে, অনুরূপার আপস করার সংযম বজায় থাকবে? কে জানে! ভালোটা আশা করাই ভালো।
অনুরূপার অদ্ভুত কথাই যেন পুরোনো অন্তরঙ্গতা ফিরিয়ে আনে সীতার, সে হাসিমুখে শাসনের সুরে বলে, কি আবোল-তাবোল বকছেন মাসিমা? যেমন আবোল-তাবোল ভাবছেন, কথাও বলছেন তেমনি। মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনার। বাড়ি যান তো। দাঁড়ান, কাউকে সঙ্গে দিই, পৌঁছে দিয়ে আসুক।
থাক্ থাক্। আমি নিজেই যেতে পারব মা।
ভাগ্যি বৌমা বলে বসেন নি, সীতা ভাবে।
তা কি হয় মাসিমা? নকুল গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসুক।
অনুরূপা উতলা হয়ে পড়ছেন–এ খবরটা হাসপাতালে হেমন্তকে দেবার নামেই ব্যাকুল হয়ে অনুরূপা কেন বাধা দিয়েছিলেন বুঝতে পারলে, অনুরূপা সম্বন্ধে সীতা বোধহয় আরো নিশ্চিন্ত হতে পারত। ছেলে পাছে মনে করে তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে এ ভয়টা কত জোরালো অনুরূপার মনে, কত সাবধান তিনি এ বিষয়ে, সীতা সেটা টের পেত। অত বড় ছেলে সন্ধ্যারাত্রে বাড়ি না ফিরলে ব্যস্ত হওয়া সঙ্গত হয় না, সীতার মুখে এ কথা শুনেই তিনি ভড়কে গিয়েছিলেন। তিনি উতলা হয়ে উঠেছেন, অস্থির হয়ে ছুটে বেরিয়েছেন খোঁজ নিতে, এ কথা শুনে তাঁর বাড়াবাড়িতে যদি বিরক্ত হয় হেমন্ত। এক দিন একটু দেরি করে বাড়ি ফেরার অধিকারটুকু পর্যন্ত তার নেই ভেবে যদি ক্ষুণ্ণ হয়।
এত ভয়-ভাবনা নিয়েও কিন্তু এক বিষয়ে মনটা শক্ত করে রাখেন অনুরূপ। ছেলেমানুষি করে হেমন্ত নিজের সর্বনাশ করবে, এটা চুপচাপ বরদাস্ত করার কথা তিনি ভাবতেও পারেন না। বাধা তিনি দেবেন, সামলাবার চেষ্টা করবেন, যতটা তার সাধ্যে কুলোয়। সেজন্য যদি রাগ করে হেমন্ত, দুঃখ পায়, বিরক্ত হয়, উপায় কি!
মনের এই লড়াইয়ে ভাবটা আগেও ছিল, এখনো আছে উদ্যত হয়ে, তবে সীতার শাসনটা কাজ দিয়েছে। হেমন্ত ফেরামাত্র লড়াই শুরু করে দেবার ঝেকটা সংযত হয়েছে। এত বড় ছেলেকে বাগাতে হলে যে যুদ্ধটা ধীর স্থির শান্ত সংযতভাবে করতে হবে সীতার মতো, এ বিষয়ে মন সতর্ক হয়ে আছে। তাই, মায়ে-ব্যাটায় সংঘর্ষ বাঁধতে বাঁধতে রাত্রি গভীর হয়ে আসে। রমা ও জয়ন্ত যতক্ষণ জেগে থাকে, অনুরূপা সাধারণভাবে কথা বলে যান, হেমন্তের কাজে তার সমর্থন আছে কি নেই, সেই ইঙ্গিতও আসে না তার কাছ থেকে। হেমন্ত তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেয়, রমা ও জয়ন্ত হাঁ করে তার কথাগুলি গিলতে থাকে। অনুরূপাও নীরবে শুনে যান। মায়ের ভাবান্তর লক্ষ করেও হেমন্ত কিন্তু সে বিষয়ে কিছু বলে না। মার দিক থেকে কথা ওঠা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করাই সে ভালো মনে করে। আর চুপচাপ থাকার কোনো কারণ আছে নিশ্চয়। আলোচনা শুরু হবার আগে নিজের মনটাকেই হয়তো গুছিয়ে নিচ্ছেন মা, হৃদয়কে শান্ত ও আয়ত্তাধীনে রাখবার আয়োজন করছেন। তাড়াহুড়ো করে কথা পেড়ে কোনো লাভ হবে না।