তুমি বুঝবে না সীতা, অনুরূপা জ্বালার সঙ্গে বলেন, আমার মতো কষ্ট করে ছেলেকে যদি পড়িয়ে মানুষ করতে হত, তবে বুঝতে লেখাপড়ার ক্ষতি করে ছেলে ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে বসলে কেমন লাগে।
আপনি হেমন্তের ওপর অবিচার করছেন মাসিমা। ভুল করছেন।
কেন?
হেমন্ত লেখাপড়ার ক্ষতি করবেই, ভবিষ্যৎ নষ্ট করবেই, এটা আপনি ধরে নিলেন কেন? লেখাপড়ায় ভালো করা ওর কর্তব্য, তাতেই যদি অবহেলা করে, তবে তো ধরে নিতে হবে ওর অধঃপতন হল। দেশের কথা ভাবলে কি লেখাপড়া বাদ দিতে হয় মাসিমা? কোথাও কিছু নেই, জেলেই বা হেমন্ত যাবে কেন শখ করে? জেলে গেলেই কি কাজ হয় দেশের, দরকার থাক বা না থাক? হেমন্তেরও ঠিক এই রকম ধারণা ছিল, পড়লে শুধু পড়তেই হবে চোখ-কান বুজে, আর নয়তো সব ছেড়ে দিয়ে নামতে হবে রাজনীতিতে। মুক্তি সগ্রামে ছাত্রদেরও যে একটা অংশ আছে, সাধারণ অবস্থায় সে অংশ গ্রহণ করা যে পড়াশোনার এতটুকু বিরুদ্ধে যায় না, বরং চরিত্র গঠনে আর মানসিক শক্তির বিকাশে সাহায্যই করে, এই সহজ কথাটা মাথায় আসে না কেন আপনাদের মাসিমা?
তোমাদের মতো মাথা নেই বলে বোধহয়।
মন শান্ত হলে আপনার রাগ কমে যাবে।
আমি না লড়েই হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকব ভেবেছ বুঝি?
অনুরূপার কথার উগ্রতায় সীতা একটু আশ্চর্য হয়ে যায়, গভীর তীব্র বিদ্বেষে মুখখানা বিকৃত হয়ে গেছে অনুরূপার। নিরুপায়ের অন্ধ আক্ৰোশে তিনি যেন কাকে আঘাত করতে উদ্যত হয়েছেন। হেমন্তকে সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য, তাকে সুমতি দেবার জন্য তিনি কি লড়াই করবেন? ছেলেকে ভালো ছেলে করে রাখতে এতদিন যে লড়াই করে এসেছেন, তার চেয়েও জোরালো লড়াই? কিন্তু সে কথাটা বলতে গিয়েও এত বিদ্বেষ, এত আক্রোশ ফুঠে উঠবে কেন তার। কথায়, মুখের ভঙ্গিতে?
সংশয়ের সঙ্গে সীতা জিজ্ঞেস করে, আপনার কথা বুঝতে পারলাম না মাসিমা। কিসের লড়াই? কি নিয়ে লড়বেন? কার সঙ্গে?
খুকি বুঝিও না সীতা আমায়। পনের বছর হল স্বামীর আশ্রয় হারিয়েছি, সেই থেকে নিজের। পায়ে দাঁড়িয়ে সংসার চালিয়ে এসেছি, ছেলেমেয়ে মানুষ করছি। তুমি আমাকে যত বোকা ভাব অত বোকা আমি নই।
এবার সীতা বুঝতে পারে। জোরে এমন নাড়া খায় তার মনটা! খানিকক্ষণ সে পলকহীন চোখে চেয়ে থাকে অনুরূপার মুখের দিকে! অনুরূপাকে তুচ্ছ না ভাবা সত্যই অসম্ভব মনে হয় তার।
বোকা আপনাকে কখনো ভাবি নি মাসিমা, আজ বোকা মনে হচ্ছে। আমার সঙ্গে লড়বেন বলছেন নাকি? আপনার বুদ্ধি সত্যি লোপ পেয়েছে। আমায় অপমান করুন তার মানে হয়, ও-কথা বলে নিজের ছেলেকে কত বড় অপমান করছেন বুঝতে পারছেন না? ছেলের আপনার নীতি নেই আদর্শ নেই জীবনে, একটা মেয়ের খাতিরে নিজেকে সে চালাচ্ছে? আমায় খুশি করার জন্য আপনার বিরোধিতা করতে যাচ্ছে, তার ব্যবহারের আর কোনো মানে নেই? নিজের ছেলেকে এমন অপদার্থ কি করে ভাবলেন? তাও যদি এতটুকু সত্যি হত কথাটা। আপনার মনের কথা আন্দাজ করলে হেমন্তেরই ঘেন্না ধরে যাবে জীবনে। একটা ভুল ধারণার বশে আমাকে হিংসা করে অশান্তি সৃষ্টি করবেন না মাসিমা। নিজেই জ্বলেপুড়ে মরবেন।
স্পষ্ট রুঢ়তার সঙ্গেই সীতা কথাগুলি বলে যায়, অনুরূপাকে রেয়াৎ করার কোনো প্রয়োজন বোধ করে না। কড়া ভাষায় খোলাখুলি সোজাসুজি না বললে তার কথার মর্ম অনুরূপা গ্রহণ করতে পারবেন কিনা, এ সন্দেহও তার ছিল। স্নেহের বাড়াবাড়ি মাকেও কোথায় নিয়ে যায় ভেবে বড় আক্ষেপ হচ্ছিল সীতার। এই সব মায়েরাই ছেলের বৌ-প্রীতির জ্বালায় পুড়ে মরে, সব দিক দিয়ে গ্রাস করে রাখতে চায় ছেলেকে চিরকাল। স্নেহ যায় চুলোয়, বড় হয়ে থাকে শুধু বিকারটা। মায়ের স্নেহও যদি এমন সর্বনেশে হয়, সে কত বড় অভিশাপ মানুষের! তাও এমন মার, অন্তঃপুরের বন্দি জীবনে অন্ধ মমতা বিলিয়ে যাওয়াই শুধু যার কাজ নয়, একা নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যে বাইরের জগতের সঙ্গে লড়াই করে আসছে পনের বছর ধরে, বাঁচবার জন্য, ছেলেমেয়ে মানুষ করার জন্য। এমন বাস্তব যার জীবন, মা বলেই কি তার এতটুকু বাস্তববোধ জন্মায় নি ছেলেমেয়েদের বিষয়ে? এই জন্যেই নিজেকে ছোট করে মায়ের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না সন্তানের। তাই কি করতে হবে হেমন্তকে? নইলে যে সমস্যা সৃষ্টি করবেন অনুরূপা, তার সমাধান করা কি সম্ভব হবে হেমন্তের পক্ষে।
কিন্তু অনুরূপা কি সত্যই ওরকম অশান্তি সৃষ্টি করবেন? হেমন্ত পাস করে মোটা মাইনের চাকরি করবে, এ আশা তো ফুরিয়ে যায় নি একেবারে। অনিশ্চিত আশঙ্কাই শুধু পীড়ন করছে। তাকে। শান্ত মনে সব কথা বিবেচনা করে দেখবার পরেও কি ছেলের দিকটা খেয়াল হবে না অনুরূপার, মনে হবে না অত বড় উপযুক্ত ছেলেকে চলাফেরা মতামতের এতটুকু স্বাধীনতা না। দেওয়া পাগলামির শামিল? স্নেহের শিকলে জোর করে হেমন্তকে হয়তো বেঁধে রাখা যাবে কিন্তু ফলটা তার ভালো হবে না মোটেই?
অনুরূপার নিজের মুখে লড়াইয়ের উদ্ভট ঘোষণা শোনার পর এখনো যেন বিশ্বাস হতে চায় না সীতার যে, ব্যাপারটা তিনি সত্য সত্যই ওরকম কুৎসিত করে তুলবার জন্য কোমর বেঁধে উঠেপড়ে লাগতে পারবেন।
অসহায়ের মতোই চুপচাপ বসে ছিলেন অনুরূপা তার ধমকানির মতো কথাগুলি শুনে। তার নীরবতা বা বসে থাকা কোনোটার মানেই ধরতে না পেরে সীতা সংশয়ভরা চোখে তার দিকে তাকায়। নিজের শ্রান্তিও সে আবার অনুভব করে নতুন করে।