সীতা বলে, মাসিমা, ছেলে আপনার কচি খোকা নেই!
আমার কথাটা তুমি বুঝলে না সীতা। আমার ভয় হচ্ছে, ও তো হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়ে নি? কিছু হয় নি তো ওর?
সীতা এবার না হেসে পারে না, যদিও সে হাসিতে দুঃখ ও জ্বালাই প্রকাশ পায় বেশি : হেমন্ত কোনো হাঙ্গামার ধারেকাছে যাবে!।
এটা তুমি কি কথা বললে? অনুরূপা বলেন আহত মাতৃগর্বের অভিমানে, ছমাস একবছর আগে বললে নয় কোনো মানে হত। হেমা যে কি ভাবে বদলে যাচ্ছে তুমিও তা লক্ষ কর নি বলতে চাও মা? আমার তো বিশ্বাস হয় না ও-কথা। ওর মধ্যে অদ্ভুত একটা অস্থিরতা এসেছে কিছুদিন থেকে। আমি জানি সেটা কিসের অস্থিরতা, ওর কি হয়েছে। তুমিও দায়ী এর জন্য।
আমি?
তুমি! তুমি দায়ী। তুমি কি বলতে চাও, তুমি টেরও পাও নি হেমা কি ভাবে ছটফট করছে, বদলে যাচ্ছে?
অনুরূপার অনুযোগে সত্যই খটকা লাগে সীতার মনে, মনে পড়ে আজ সে হেমন্তকে সভায় দেখেছিল। হয়তো নিছক খেয়ালের বশে সভায় যায় নি হেমন্ত। হয়তো নতুন চেতনা, নতুন অনুভূতির তাগিদেই সভায় যেতে হয়েছিল তাকে, নবজাগ্ৰত প্ৰশ্ন ও সংশয়গুলির নির্ভুল বাস্তব জবাব খুঁজে পাবার কামনায়। আত্মপ্রীতির জেলখানার প্রাচীরে হয়তো সত্যই চিড় খেয়েছে হেমন্তের। দু দণ্ড দাঁড়িয়ে থেকেই সে যে চলে গিয়েছিল সভা ছেড়ে বিরক্ত হয়ে তাও তো জানা নেই সীতার। শেষ পর্যন্ত চলে হয়তো যেতে পারে নি, শোভাযাত্রায়ও হয়তো যোগ দিয়েছিল। প্রাণ তুচ্ছ করা অভিযানে সে যে অংশগ্রহণ করে নি তাই বা কে জানে!
ভাবতেও এমন অদ্ভুত লাগে সীতার। নিজের মত সমর্থনের জন্য আজই হেমন্ত আরো বেশি রকম ভোঁতা, বেশি রকম সঙ্কীর্ণ হয়ে উঠেছিল, সেটা তবে তার কাছে নিজের দুর্বলতা আড়াল করবার চেষ্টা! ভেতরে লড়াই চলছে বলে, পুরোনো বিশ্বাস ভেঙে পড়েছে বলে, বাইরে এমন অন্ধ একগুঁয়েমির সঙ্গে হার মানার অপমান এড়িয়ে চলতে হবে। তার কাছে কি কোনোদিন নিজের ভুল স্বীকার করবে হেমন্ত? পারবে স্বীকার করতে? নিজের জন্য জয়ের লোভ নেই সীতার। তার কাছে শেষ পর্যন্ত হেমন্ত হার মানল এ সুখ সে চায় না। ভুল বুঝতে পেরে সেটা মেনে নেবার সাহস তার আছে, নতুন সত্যকে চিনতে পারলে সেটাকে গ্রহণ করার ছেলেমানুষি লজ্জা তার নেই, এটুকু জানলেই সে খুশি হবে।
অনুরূপাকে বসিয়ে সীতা নিজেই কয়েক জায়গায় টেলিফোন করে। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর সে হাসপাতালে সাড়া পায় শিবনাথের। শিবনাথ আহতদের সম্বন্ধে ব্যবস্থা করছিল।
কার কথা বলছঃ হেমন্ত? শিবনাথ বলে, া হেমন্ত এখানে আছে।
সীতা মনে মনে বলল, সর্বনাশ!
ওর খবর কি?
সামান্য লেগেছে, বিশেষ কিছু নয়। ড্রেস করে দিলেই বাড়ি যেতে পারবে।
হেমন্ত শোভাযাত্রায় ছিল?
ছিল।
গুলি চলবার সময় ছিল?
আগাগোড়া ছিল।
আমার ভারি আশ্চর্য লাগছে।
কেন? আশ্চর্য হবার কি আছে? ওর রক্ত কি গরম নয়?
তর্ক দিয়ে ছাড়া রক্ত গরম করার অত্যন্ত বিরুদ্ধে ছিল। ওকে বলবে তাড়াতাড়ি যেন বাড়ি চলে যায়। ওর মা খুব উতলা হয়ে আছেন।
অনুরূপা প্রায় আর্তকণ্ঠে বলে ওঠেন, না না, ওকথা বলতে বোলা না সীতা! বারণ করে দাও। আমার কথা কিছু বলতে হবে না।
শিবনাথ, ছেড়ে দাও নি তো? শোন, হেমন্তকে ওর মার কথা কিছু বোলো না। শুধু বোলো আমি টেলিফোন করেছিলাম, তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে বলেছি।
হেমন্ত জানুক, সীতা সব জেনেছে, বুঝতে পেরেছে। ওবেলার তর্কটা তাদের বাতিল হয়ে গেছে একেবারে।
অনুরূপা মোহগ্ৰস্তার মতো বসে থাকেন। ছেলে নিরাপদ আছে জানার পর এতক্ষণে তার মুখ থেকে রক্ত সরে যাবার কারণ খানিকটা অনুমান করতে পারে সীতা। দ্বিধা-সংশয়ের দিন পার হয়ে গেছে হেমন্তের। সব রকম হাঙ্গামা থেকে নিজেকে সযত্নে বঁচিয়ে বেঁচে থাকার স্বাৰ্থদুষ্ট হীনতাকে আর সে প্রশ্রয় দিতে পারবে না। সে শুধু মনে মনে এটা স্থির করে নি, একেবারে হাতেনাতে বিদ্রোহ করেছে। সুখের রঙিন স্বপ্ন মুছে যাবার সম্ভাবনায় মুখের চেহারাও তাই বিবর্ণ হয়ে গেছে অনুরূপার।
আপনি অত ভাবছেন কেন মাসিমা?
ভাবব না? তোমার নয় খুশির সীমা নেই, হেমন্ত এবার থেকে লেখাপড়া চুলোয় দিয়ে মিটিং করে বেড়াবে, জেলে যাবে, দেশোদ্ধার করবে। আমার অবস্থাটা বুঝে দেখেছ একবার? আমার কত আশা-ভরসা হেমন্তের ওপর। তুমি যে আমার কি ক্ষতি করলে শুধু ভগবান জানেন।
আমায় শেষে দায়ী করলেন মাসিমা? সীতা বলে আশ্চর্য ও আহত হয়ে, ছেলেমানুষি ভুল করলেন একটা। আমার সঙ্গে মেশার জন্য আপনার ছেলে বদলায় নি। অত বড় গৌরব দাবি করবার অধিকার আমার নেই। হেমন্ত নিজেই বদলেছে, স্বাভাবিক নিয়মে। দেশের এই অবস্থা, এটা বুঝতে পারেন না যে সবকিছুর মধ্যে এদেশের রাজনীতি জড়িয়ে আছে, ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলতে হলে তাকে তালাবদ্ধ করে রাখা দরকার? শত শত আঘাত এসে ওকে সচেতন করে তুলবে, সামলাবেন কি করে? স্বাধীনতার প্রেরণাই ওকে জাগিয়েছে, দেশপ্রেমের আলোই ওকে পথ দেখিয়েছে। আপনার কথা সত্যি, আমি পেরে থাকলে আমিই নিজেকে কৃতার্থ ভাবতাম মাসিমা। কিন্তু তা হয় নি। আমি তো তুচ্ছ, নেতাও কি মানুষকে জাগাতে পারেন? মানুষের মধ্যেই জাগরণ আসে, নেতা শুধু তার প্রতিনিধিত্ব করেন।
সীতা একটু চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে বলে, আপনার আফসোসের কারণটাও মাথায় ঢুকছে। না আমার। দেশের জন্য ছেলে দুঃখ পেলে মার কষ্ট হয়, কিন্তু গৌরবও কি হয় না?