রমা ফিরে আসে প্রচুর উত্তেজনা নিয়ে।
বেরোও নি তো? বেশ করেছ। ট্রাম বন্ধ হয়ে গেছে। জান মা, ট্রাম চলছে না। ওদিকে খুব হাঙ্গামা চলছে, পুলিশ নাকি গুলি চালিয়েছে–কি ভাবছ মা?
কিছু না। হেমা ফেরে নি এখনো।
ও! দাদার জন্য ভাবছ? রমা হালকা সুরে বলে, দাদা কস্মিনকালে ওসবের মধ্যে যায় না, যাবেও না। কোথায় গেছে, এখুনি এসে পড়বে। দাদার জন্যে ভেব না।
রমার কথা আর কথার সুর আঁচড় কাটে অনুরূপার কানের পর্দায়। রমার গলায় তার দাদার সম্বন্ধে অবজ্ঞার সুর শোনা যাবে, এই বিপদের আশঙ্কাও বুঝি তার ছিল।
না, ভাবনার কি আছে। গানটা ভালো করে শিখবি রমা? কাপড় ছেড়ে আয়।
রমাকে বিপন্ন দেখায়। তার মুখে দারুণ অনিচ্ছা!
আজ থাক গে। গানটান শিখতে আজ ইচ্ছে করছে না মা।
তবে থাক।
জয়ন্ত ফিরে আসে আরো বেশি উত্তেজনা নিয়ে। যত কিছু সে শুনে এসেছে বাইরে থেকে সব অনুরূপাকে শোনায়। তারপর এক মারাত্মক প্রস্তাব করে।
একটু দেখে আসব মা? একটুখানিদূর থেকে একটু দেখেই চলে আসব।
না।
কি হয় গেলে? এসে পড়তে বসব।
আজ পড়তে হবে না। আজ তোর ছুটি। মুখ-হাত ধুয়ে আয়, গল্প বলব একটা।
বানানো গল্প ভালো লাগে না মা।
বানানো গল্প, ভালো লাগে না। এতটুকু ছেলে তার আজ সে রকম গল্প চাই, যা ধরাছোঁয়া দেখাশোনা যায়।
রাত বাড়ে, হেমন্ত আসে না। অনুরূপা উৎকর্ণ হয়ে থাকেন সদরের কড়া নাড়ার শব্দের জন্য। অস্বস্তি তাঁর উদ্বেগে দাঁড়িয়ে গেছে অনেকক্ষণ। রমার মনেও ভাবনা ঢুকেছে।
জয়ন্ত ঘুমিয়ে পড়লে অনুরূপা বলেন, আমি একটু খোঁজ করে আসি রমা।
কোথায় খোঁজ করবে এত রাত্রে?
সীতার কাছে যাই একবার। ওদের বাড়ি টেলিফোনও আছে।
সীতা সবে বাড়ি ফিরেছিল। হেমন্তকে বিদায় দিয়ে নেয়ে খেয়ে নিয়ে সেও বেরিয়ে গিয়েছিল। মনটা নাড়া খেলেও খাওয়ায় অরুচি জন্মানোর শখ তার নেই। তার বেশ খিদে পায় এবং
সে খায়। তারপর আর কিছু খাওয়ার অবসর পায় নি এ পর্যন্ত। খাওয়ার ইচ্ছাটা মরে গেছে। আজকের মতো। চেনা অচেনা প্রিয়জনের আঘাত ও মরণ নাড়া দিয়েছে মনটাকে, সে তো আর ব্যক্তিগত দুঃখের কাব্য নয়। ক্ষোভ ছাড়া কোনো অনুভূতিই তার নেই, যার আগুনে আরো শক্ত ও দৃঢ় হয়ে গেছে তার মন ও প্রতিজ্ঞা।
হেমন্ত? বাড়ি ফেরে নি?
সভায় একবার চোখে পড়েছিল হেমন্তকে। সেখানে তার উপস্থিতিকে বিশেষ মূল্য সে দিতে পারে নি। তার সঙ্গে তর্ক করার উপকরণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই হয়তো সে সভায় এসে দাঁড়িয়েছে মনে হয়েছিল সীতার। তারপর হেমন্তের কথা আর তার মনে পড়ে নি। আর অবসর হয় নি তার কথা মনে পড়ার, ভালো লাগে নি তার কথা ভাবতে। হেমন্তের সম্বন্ধে আশা-ভরসা কিছু আর রাখা চলে না এ সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া তার পক্ষে কষ্টকর। অন্য দিন জীবনের সাধারণ কাজ ও ঘটনার মধ্যে ভুলতে পারত না, দুঃখ ও ক্ষোভটা নেড়েচেড়ে খাপ খাইয়ে নিতে হত সচেতন প্রচেষ্টায়, আজ নিজের সুখ-দুঃখের কথা মনের কোনায় উঁকি দেবারও অবসর পায় নি। দুঃখ বেদনা হতাশার ওই স্তরটাই যেন তুচ্ছ হয়ে গেছে, দূরে সরে গেছে।
অনুরূপার জন্য সে মমতা বোধ করে না। তার মনে হয়, মাতৃস্নেহের এই বিকৃত অভিব্যক্তির সঙ্গে সহানুভূতি দেখালে অন্যায় করা হবে। অনুরূপার মুখে উদ্বেগের ছাপটা স্পষ্ট দেখতে না পেয়ে সে একটু আশ্চর্য হয়। কিন্তু অত বড় ছেলে সন্ধ্যারাতে বাড়ি ফেরেনি বলে পাগল হয়ে খোঁজ করতে বার হবার মধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে যথেষ্ট, মুখের ভাব যতই শান্ত থাক। গুলির মুখে ছেলে পাঠিয়ে কত মা বুক বেঁধে প্রতীক্ষা করছে ধৈর্য ধরে, ছেলের বেরিয়ে ফিরতে দেরি হলে এঁর। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এর জন্যই হয়তো এত বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে হেমন্ত, অতি আহ্লাদী ছেলেরা যা হয়।
কোথায় গেছে, আসবে। সীতা উদাসভাবে বলে।
তোমার সঙ্গে দেখা হয় নি?
ও-বেলা একবার এসেছিল বারটা-একটার সময়।
তার কাছে অনুরূপা খোঁজ নিতে এসেছেন হারানো ছেলের। পৃথিবীতে এত লোক থাকতে তার কাছে! কথাটা এতক্ষণে খেয়াল হয় সীতার। সুখস্বাচ্ছন্দ্যভরা আগামী দিনের জীবনের পরিকল্পনায় তাকেও তবে ওরা মায়ে-ব্যাটায় হিসাবের মধ্যে ধরে রেখেছে? এমন হাসি পায় সীতার। কথাটা মনে করে। অনুরূপা জানেন, মনে মনে অন্তত এই ধারণা পোষণ করেন যে সীতা দুদিন পরে তার ছেলের বৌ হয়ে তার বাড়ি যাবে। ছেলের ভাব দেখে তিনি অনুমান করে নিতে পেরেছেন এই মেয়েটিকে তার পছন্দ হয়েছে, তাই থেকে একেবারে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বিলম্ব হয়। নি। তার এত ভালো ছেলে, এমন উজ্জ্বল তার ভবিষ্যৎ, সীতার পছন্দ-অপছন্দের প্রশ্নটা মনের মধ্যে ঠাঁইও পায় নি তাঁর।
এবার সীতা বুঝতে পারে অনুরূপার মুখে উদ্বেগের, দুর্ভাবনার চিহ্ন জোরালো হয়ে ফোটে নি কেন। ভাবী বৌয়ের সঙ্গে তিনি ভাবী শাশুড়ির মতো আচরণ করেছেন। ভয়ে-ভাবনায় সীতা কাতর হয়ে পড়বে, তাকে ভড়কে দেওয়া তার উচিত নয়। সীতাকে ভরসা দেবার, তার মনে সাহস জাগিয়ে রাখার দায়িত্ব তারই!
সীতার নির্লিপ্ত ভাব তাই তাকে রীতিমতো ক্ষুণ্ণ করেছে, আঘাতও করেছে।
গম্ভীরমুখে রীতিমতো অনুযোগর সুরে অনুরূপা বলেন—
না জানিয়ে কোনোদিন বাড়ি ফিরতে দেরি করে না সীতা বুঝে উঠতে পারছি না কি হল।
সীতার হাসি পাচ্ছিল কিন্তু হাসির রেখাও তার মুখে ফুটল না। সে নিজেও জানত না মনের এ ভাবটা এত ক্ষণস্থায়ী হবে। ক্ষণিকের একটু আমোদ বোধ করে মনটা তার খারাপ হয়ে যায়, নাড়া খায় গভীরভাবে। হেমন্তের অনেক অন্ধতা, অনেক কুসংস্কার, অনেক দুর্বলতার মানে তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। হেমন্তের দোষ নেই! এমন যার মা, আঁতুড় থেকে আজ এত বয়স পর্যন্ত যার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত এই মা নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে, তার হৃদয়-মনের গঠনের ত্রুটির জন্য সে নিজে কতটুকু দায়ী। এটুকু সীতা জানে যে শৈশবে মনের যে গঠন হয় জীবনে তার আর পরিবর্তন হয় না। সজ্ঞান সাধনায় পরবর্তী জীবনে চিন্তা ও অনুভূতির জগতে নতুন ধারা আনা যায় আপসহীন অবিশ্রাম কঠোর সংগ্রামের দ্বারা। নিজের সঙ্গে লড়াই করার মতো কষ্টকর, কঠিন ব্যাপার আর কি আছে জীবনে। বুদ্ধি দিয়ে যদি বা আদর্শ বেছে নেওয়া গেল, কর্তব্য ঠিক করা গেল, সে আদর্শ অনুসরণ করা, সে কর্তব্য পালন করা যেন ঝকমারি হয়ে দাঁড়ায় যদি তা বিরুদ্ধে যায় প্রকৃতির। ইন্টেলেকচুয়ালিজমের ব্যর্থতার কারণও তাই! বুদ্ধির আবিষ্কার, বুদ্ধির সিদ্ধান্ত কাজে লাগানোর চেয়ে অন্ধ অকেজো ভালোলাগা ও পছন্দকে মেনে চলা অনেক সহজ, অনেক মনোরম। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তাই অধঃপতন এত বেশি। এত বেশি হতাশা। কথার এত মারপ্যাচ। এত ফাঁকিবাজি। বিশ্বাসের এমন নিদারুণ অভাব।