নীরবে কয়েক কদম হাঁটে ওসমান, রসুল বদলে গেছে। হাবিবের কাজ এটা। হাবিব থাকলে খুশি হত। এর মধ্যে হাবিব বেঁচে আছে মালুম হল। ছেলের মতো মনে হল ওকে।
০৫. সকলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায়
সকলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় এতটুকু আনমনা মনে হয় না অনুরূপাকে, তার কোমল ভীরু হাসিটি বার বার দেখা দেয় মুখে, কিন্তু ক্ষীণ একটা অস্বস্তি তিনি অনুভব করেন। এখনো ফিরল না কেন হেমন্ত? দুটো বাজল বড় ঘড়িটায়। কলেজ থেকে সে সোজা বাড়ি চলে আসে, কোনো কারণে ফিরতে দেরি হবার সম্ভাবনা থাকলে যাবার সময়েই বলে যায়, নয়তো বাড়ি ফিরে এসে আবার বার হয়। আজ তো কলেজও নাকি হয় নি। সরকারি কলেজ হেমন্তের, সেখানে ক্লাস যদিবা হয়েই থাকে পুরোপুরি, অনেক আগেই হেমন্তের ফিরে আসা উচিত ছিল আজ।
আধঘণ্টার মধ্যে তাকে বেরিয়ে যেতে হবে গান শেখাতে। তার আগে কি ফিরবে না হেমন্ত?
দোকান থেকে চা আনিয়ে দেন অভ্যাগতদের, অপরাধীর মতো বলেন, দোকানের চা-ই খেতে হবে, ঘরে চিনি নেই।
তাতে কি হয়েছে।
সবারই এক অবস্থা, বাড়িতে কেউ এলে আমিও দোকান থেকে চা আনিয়ে দিই, কি করব, নিজেদেরই কুলোয় না।
আমি কিন্তু বাড়তি চিনি পাই। এক টাকা সের নেয়, কিন্তু কি করব তাই কিনি, চিনি নইলে তো চলে না। একটা দোকান আছে, তেল আর চিনি দুই-ই পাওয়া যায়। সকলকে দেয় না, দোকানিরও তো ভয় আছে। জানা লোক গেলে দেয়।
আমিও পাই চিনি, মাসের গোড়ায় দু-তিন বার আধসের করে এনে জমিয়ে রাখি, একবারে বেশি দেয় না। এক টাকা সের পান আপনি? আমার কাছে পাঁচসিকে নেয়।
ওরকম তো পাওয়া যায়, অনুরূপা বলেন, আমি আনাই না। কেমন খারাপ লাগে! ব্ল্যাকমার্কেটকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় তো ওতে। তাছাড়া বড় ছেলে যদি টের পায়।
অনুরূপা ভাবে, দ্যাখ, ছেলের কথা ভাবতে ভাবতে কি খাপছাড়া কথা বলে ফেললেন। দুটি মুখ ভার হয়ে গেল তাঁর কথায়। খোঁচা দিয়ে ফেলার জন্য মৃদু আফসোসের সঙ্গে আরেকটা খুশির চিন্তাও মনে আসে অনুরূপার। বলেই যখন ফেলেছেন তখন আর উপায় কি, হেমন্ত শুনে মজা পাবে, খুশি হবে। হেমন্ত খেতে বসলে বেশ করে সাজিয়ে বলতে হবে গল্পটা তাকে।
কবে যে অবস্থা একটু ভালো হবে।
সত্যি, যুদ্ধ থামল কবে, ভাবলাম যাক, এবার নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে। অবস্থার উন্নতি হল ছাই, দিন দিন আরো যেন খারাপ হচ্ছে! দ্যাওরের চাকরিটা যাবে সামনের মাসে। আবার এসে ঘাড়ে চাপবে সবাইকে নিয়ে। তিন বছর ছিল না, অন্য সময় হলে কিছু পয়সা জমত হাতে, যুদ্ধের বাজারে তাও পারলাম না। উনি গুইগাই করছিলেন, আমি স্পষ্ট কথা লিখিয়ে দিয়েছি, যে দিনকাল, আমরা আর পারব না। পারা কি যায়, আপনারাই বলুন?
আমার তো মেজ সেজ দুটি ছেলেই নোটিশ পেয়েছে। মাথা ঘুরে গেছে ভাই। বড় জন তো একরকম ভিন্নই, দিল্লিতে থাকে, দশখানা চিঠি দিলে একখানারও জবাব দেয় কি দেয় না।
ভয় ও হতাশা উদ্যত হয়েই ছিল ভঁড়ানো কুয়াশার মতো, অতিমন্দ বাতাসের মতো অতিমৃদু এই আলোচনাকে আশ্রয় করে গড়িয়ে আসে ঘরে। অনুরূপা টোক গেলেন। গলাটা শুকনো মনে হয়, খুসখৃস করে। গলায় যদি কিছু হয় তার, গাইবার ক্ষমতা যদি নষ্ট হয়ে যায় কোনো কারণে–হেমন্ত লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়ে ওঠার আগে! কত গায়ক-গায়িকার অমন গিয়েছে। গান শেখানোও ঝকমারির কাজ। সকালে দুপুরে সন্ধ্যায় এমন অত্যাচার চলে গলার ওপর। গান শেখানোর কাজ ছেড়ে দেবেন একটা-দুটো বাড়ির? কিন্তু তাহলে কি চলবে তাঁর সংসার, হেমন্তের পড়ার খরচ?
গান শোনাবেন একখানা?
গান? অনুরূপা তাঁর ক্ষীণ কোমল হাসি হাসেন, গান গেয়ে শোনাবার গলা কি আর আছে? গান শিখিয়ে শিখিয়েই গলা গেছে। গাইতে পারি না আর।
একটু ক্ষুণ্ণ হয়ে তারা বিদায় নেয়। অনুরূপা জানেন ওদের মনের ভাব : একটু গাইতে জানলে, একটু নাম হলে, এমনি অহঙ্কারই হয় মানুষের। গলাকে বাড়তি এতটুকু পরিশ্রম করাতে তার যে কত কষ্ট, কত ভয়, ওরা তার কি বুঝবে!
জয়ন্ত বলে, এবার যাব মা খেলতে?
এতক্ষণ যাও নি কেন?
জিজ্ঞাসা করা বৃথা, অনুরূপা জানেন। বাড়িতে লোক এলে এ ছেলে ঘর ছেড়ে নড়তে চায় না, বসে বসে বুড়িদের আলাপ শুনতে পর্যন্ত কি যে ভালো লাগে তের বছরের ছেলের
যাও! দূরে যেও না কিন্তু। শিগগির ফিরবে।
রমাও বাড়ি নেই, শান্তাদের ওখানে গেছে। সন্ধ্যার সময় ফিরে এসে নতুন গানটি সেধে। রাখবে বলেছে। অন্যের মেয়েকে নটা পর্যন্ত গান শিখিয়ে বাড়ি ফিরে তখন অনুরূপা নিজের মেয়ের গান কেমন তৈরি হল শুনতে পাবেন। তবে, গানের পেছনে বেশি সময় রমার না দিলেও চলে। মোটামুটি ও যা শিখবে তাই যথেষ্ট। ওকে খুব ভালো করে শেখালেও গানে ও বিশেষ কিছু করে উঠতে পারবে না, গানের ধাত নয় ও মেয়ের। অনুরূপ একটা নিশ্বাস ফেলেন। খালি বাড়িতে নিজেকে কেমন শ্ৰান্ত, অবসন্ন মনে হয়। সাড়ে ছটা বেজে গেছে কিন্তু গভীর আলস্যে উঠতে ইচ্ছা করছে না আজ। হেমন্ত ফিরে এলে হয়তো আলস্যটা কেটে যেত, জোর মিলত উঠে গিয়ে ছড়া বলার গলা বা সুরজ্ঞান পর্যন্ত নেই যে মেয়ের, নিজের গলার আওয়াজ শুনেই ভাব লেগে যে মেয়ের খেয়াল থাকে না সুর কোথা গেল, তাদের গান শিখিয়ে আসতে!
এই রকম সময়ে, ছেলে বা মেয়ে যখন কাছে থাকে না কেউ, কেমন আর কিসের অজানা সব শঙ্কার ছায়াপাতে হৃদয় মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে অনুরূপার। নিরাপত্তার জন্য নিজেকে একরকম ঘেঁটে ফেলেছেন, সহজ ও সীমাবদ্ধ করে এনেছেন জীবন ও জীবনের পরিধি, যেমন চেয়েছেন। তেমনি দিন চলছে শান্তিতে, ছেলেমেয়েরা মানুষ হয়ে উঠছে মনের মতো। কোথা থেকে তবে এত সংকেত আসে বিপর্যয়ের, বিভ্রাটের, বিপদের? কেন কেঁপে কেঁপে ওঠে অনুরূপার ভীরু বুক? পৃথিবী জোড়া যুদ্ধ তাকে বিচলিত করে নি। সে যুদ্ধের যত ধাক্কা এসে লাগুক তার ঘরে, সে অসুবিধা, শুধু টানাটানি, কষ্ট করার ব্যাপার বোমার ভয়ের দিনগুলিও তাকে এমন সচকিত করে তুলতে পারে নি। মনে হয়েছে ওসব দূরের বিপদ বহু দূরের। তাদের চারটি প্রাণীর ছোট নীড়টিতে ও বিপদের ছোঁয়া লাগবে না। কিন্তু এ বিপদ যেন বাতাসের গুমোটের মতো মাথার ওপরের আকাশে ঘন কালো মেঘের মতো ঘনিয়ে আসছে অনুভব করা যায়। খবরের কাগজ পড়তে গিয়ে মনে হয়, সব খবরের আড়ালে যেন দুরন্ত ক্ষোভ গুমরাচ্ছে মানুষের, পথেঘাটে, লোকের কথা শুনলে মনে হয় সব চিন্তা একদিকে গতি পেয়েছে মানুষের চারিদিকে সভা আর শোভাযাত্রায় সেই চিন্তা ফেটে পড়ছে হাজার কণ্ঠের গৰ্জনে। প্রতি মুহূর্তে ঘরে বাইরে চেতনায় যা ঘা দিচ্ছে, জীবনের খুঁটিনাটি সব কিছুর সঙ্গে যা জড়িয়ে গেছে, তা কি ঠেকিয়ে রাখা যাবে ঘরের নিরাপদ সুখশান্তি অব্যাহত রাখতে চেয়ে?