কি বলছ?
ওসমান ঝুঁকে গণেশের মুখের যত কাছে সম্ভব মুখ নিয়ে যায়। শুনতে পায় শুধু গলার ঘর্ঘর ধ্বনি। সামনের লোকেরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে, জমাট বাঁধা জনতাকেও চাপ দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে। হাতখানেক জায়গা দিয়েছে গণেশকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবার।
রক্তমাখা জামাটা দুহাতে একেবারেই ছিঁড়ে ফেলে ওসমান। বুকে কোথাও ক্ষতের চিহ্ন নেই, একটাও ফুটো নেই। এক ফোঁটা রক্ত বেরোয় নি বুক থেকে ছেলেটার। জামাটা তবে ভিজল কি করে রক্তে?
না, বা গালটাতেও রক্তের চাপড়া পড়েছে বটে ছেলেটার। ঝাঁকড়া চুলের ভেতর থেকে রক্তস্রাব হচ্ছে। একরাশি ঘন রুক্ষ চুলের আড়ালে আঘাতটা লুকিয়ে আছে।
একে বাঁচানো উচিত, ওসমান ভাবে।
তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়তো বাঁচতে পারে। হয়তো। ওসমান কি করে জানবে কিরকম আঘাত ওর লেগেছে। হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বাঁচবে কিনা শেষ পর্যন্ত ঠিক জানে না বটে ওসমান, কিন্তু এটা সে ভালো করেই জানে, হাসপাতালে পৌঁছতে দেরি হলে নিশ্চয় বাঁচবে না।
বাঁচাবার চেষ্টা করতে হবে ওকে। তাকেই করতে হবে। খুন যখন বেরিয়ে আসছে গলগল করে, তাকেই ছোকরা বার বার জিজ্ঞেস করেছে, এরা এগোবে না বাবু? শহীদ হবার আগে এই একটা জবাব শুধু চেয়েছে ছেলেটা তার কাছে। ওকে বাঁচাবার চেষ্টা না করলে চলে?
অ্যাম্বুলেন্স? মোড়ের মাথায় অ্যাম্বুলেন্স আছে, কজনে ধরাধরি করে তাড়াতাড়ি ওকে নিয়েও যাওয়া যায় ওখানে, জমাট বাঁধা ভিড় ফাঁক হয়ে গিয়ে তাদের পথ দেবে, ওসমান জানে। কিন্তু ওই অ্যাম্বুলেন্সের ব্যাপারও সে জানে। বিশেষত এ ছোকরা কুলির ছেলে। অ্যাম্বুলেন্সে চাকা ঘুরতে আরম্ভ করতে করতে এ খতম হয়ে যাবে। না, ও অ্যাম্বুলেন্সের ভরসা নেই ওসমানের।
রাস্তার ধারে দাঁড় করানো পুরোনো খোলা লরিটা আটকা পড়ে গিয়েছিল শোভাযাত্রায়। ওসমান উঠে দাঁড়িয়ে হাকে, লরি কার?
জিওনলাল বলে, আমার আছে।
ইস্কো জানের দায়িক তুমি, খোদা কম। জোরসে লে চল হাসপাতাল।
এক মুহূর্তেই ইতস্তত করে জিওনলাল বলে, লে আও।
ইঞ্জিনে স্টার্ট দিয়ে স্টিয়ারিং ধরে বসে ততক্ষণে কয়েকজনের সাহায্যে ওসমান লরিতে উঠে গণেশকে কোলে নিয়ে বসেছে।
মানুষের মধ্যে আটকা পড়েছিল লরিটা, দেখতে দেখতে এবার পথ সৃষ্টি হয়ে যায় তার জন্য, হুস করে লরি ঢুকে যায় পাশের গুলিতে।
সভায় যাবার ইচ্ছা আমার ছিল না, শোভাযাত্রায় যোগ দিতে আমি চাই নি। এটা তবে কি রকম ব্যাপার হল? হেমন্ত ভাবে।
নিজের ব্যবহার বড় আশ্চর্য মনে হয় হেমন্তের নিজেরই কাছে, বিশেষত নিজের মনের চালচলন। সভায় গিয়ে দাঁড়াবার খানিক পরেই মন যেন বিনা দ্বিধায় বিনা তর্কে কোনো বিচার বিবেচনা হিসাব নিকাশ না করেই বাতিল করে দিলে এতদিনকার কঠোরভাবে মেনে চলা রীতিনীতি। এত দিন ধরে যা সে যেভাবে ভেবেছে আজ যেন ওভাবে ওসব ভাববার দরকারটাই শেষ হয়ে গেছে একেবারে। একান্ত পালনীয় বলে যা সে কঠোর নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে এসেছে এতদিন, আজ তার বিরুদ্ধ আচরণে প্রবৃত্ত হয়েছে বলে বিচলিত হবার কিছু নেই, ক্ষোভের কারণ নেই।
এত সহজে কি করে মত বদলায় মানুষের, তার? এমন আচমকা কি করে নতুন মত মেনে চলা এমন স্বাভাবিক মনে হয় মানুষের, তার? অথবা আজকের এ ব্যাপারে মতামতের প্রশ্ন নেই, প্রতিদিনকার সাধারণ জীবনে যে মতামত নিয়মকানুন খাড়া করে চলা যায়, এই বিশেষ অবস্থায় সেসব বর্জন করে চলাই কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়? বাঁধা লেগে যায় হেমন্তের এসব চিন্তায়।
না, রাজনীতি বাজে নয়, তুচ্ছ নয় হেমন্তের কাছে। অত অন্ধকার নয় তার মন। বিশেষত এদেশের রাজনীতি স্বাধীনতার সংগ্রাম, বংশানুক্রমিক সুদীর্ঘ সগ্রাম। কিন্তু সবকিছুরই যেমন সময় আছে, বয়স আছে মানুষের জীবনে, রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় আছে, বয়স আছে। অতি ভালো কাজও অসময়ে করতে চাইলে অকাজ হয়ে দাঁড়ায়, ফল হয় খারাপ। নিজের যা কর্তব্য। সেটুকু ভালোভাবে পালন করতে পারাই সার্থকতার রীতিনীতি, নিয়ম।
সভার একপাশে জায়গা নিয়ে দাঁড়াবার সময়ও বিশ্বাস তার দৃঢ় ছিল–রাজনৈতিক সভায় যোগ দেওয়া কোনো ছাত্রের উচিত নয়। ছাত্রজীবনে রাজনীতির স্থান নেই। লেখাপড়া শিখে মানুষ হবার সময় হাতে-কলমে রাজনীতি চর্চা করা তাস পিটে আড্ডা দিয়ে হৈচৈ করে সময় আর এনার্জি নষ্ট করার মতোই অন্যায়। ছাত্রের কাছে রাজনীতি শুধু অধ্যয়নের বিষয়, কোলাহলমত্ততা, দলাদলি, সংঘাত থেকে দূরে থেকে শান্ত সমাহিত চিত্তে তাপসের সংযত শোভন জীবনযাপন করবে ছাত্র।
সভায় তবে সে কেন থাকে, কি করে থাকে? শোভাযাত্রায় যোগ দেয়, ফুটপাতে বসে পড়ে যতক্ষণ দরকার বসে থাকার সঙ্কল্প নিয়ে? মত তার বদলায় নি, বিশ্বাস শিথিল হয় নি। জোরের সঙ্গে স্পষ্টভাবে শুধু মনে হয়েছে আজ এই বিশেষ অবস্থায় তার মত বা বিশ্বাসের কোনো প্রশ্ন আসে না, ওসব বিষয় বিবেচনা করার সময় এটা নয়। অন্য সময় যত খুশি নিষ্ঠার সঙ্গে ওসবের মর্যাদা রেখে চললেই হবে, এখন নয়। এখন যা করা উচিত, তার মতো হাজার হাজার সাধারণ মানুষ মিলে যা করছে, তাকেও তাই করতে হবে। তাতে সংশয়ের কিছু নেই, তর্ক নেই।
একটু কৌতূহলের বশে হেমন্ত সভায় দাঁড়িয়ে ছিল। এত সীমাহীন দলাদলি, এমন কুৎসিত আত্মকলহ যাদের মধ্যে, তারা কি করে এক সাথে মিশে সভা করে একটু দেখবে। ছেলেদের বড় একটা অংশ গোল্লায় গেছে। শুধু হৈচৈ, গুণ্ডামি, সিগারেট টানা, মেয়েদের পেছনে লাগা, শেষে পরীক্ষার হলে চুরি-চামারি, গার্ডের সঙ্গে মারামারি, গার্ডকে খুন করা। এ অধঃপতনের কারণ সে জানে। রাজনৈতিক মত্ততা এই নৈতিক অধঃপতনের জন্য দায়ী। তার মতকেই সমর্থন করে ছেলেদের মধ্যে এই মারাত্মক দুর্নীতির প্রসার নিজের কাজকে অবহেলা করে অকাজ নিয়ে মেতে থাকলে এরকম শৈথিল্য আসতে বাধ্য, ছাত্রই হোক আর যাই হোক তাদের মধ্যে। নিয়মানুবর্তিতাকে চুলোয় পাঠিয়ে, লেখাপড়া তাকে তুলে হৈচৈ-হাঙ্গামা নিয়ে মেতে থাকার জন্য রাজনীতি চর্চার চেয়ে ভালো ছুতো আর কি হতে পারে?