হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে তার দেখা হয় রসুল আর শিবনাথের সঙ্গে। রসুলের ডান হাতে ব্যাণ্ডেজ, রক্তক্ষরণের ফলে মুখ তার ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বসে বসে বোকার মতো, গোয়ারের মতো, রক্ত নষ্ট করার জন্য শিবনাথ এখনো তাকে অনুযোগ দিচ্ছিল।
ওসমান ওদের চিনতে পারে দেখামাত্র, কিন্তু নিজে যেচে কথা বলতে তার বাঁধ বাঁধ ঠেকে। ওরা তার ছেলের বন্ধু ছিল, হাবিবের বাপ বলে তাকেও চিনত, এই পর্যন্ত। ট্রামের কণ্ডাক্টর বলে। চিনত। ছেলে আজ নেই, তারও কারখানার মজুরের পোশাক। কথা বলতে গেলে হয়তোে দুটো এলোমেলো খাপছাড়া কথাই হবে, অর্থহীন অস্বস্তিকর সে আলাপে কাজ কি! ওসমানের নিজের কিছু আসে যায় না তাতে, কিন্তু ওদের অস্বস্তি সৃষ্টি করে লাভ নেই।
শিবনাথ চিনতে পেরে প্রথমে বলে, আপনি এখানে?
রসুল ক্ষীণকণ্ঠে বলে, এখন হাসপাতলে কি করছেন সাব? আপনার কেউ কি–?
একটি ছেলের সঙ্গে এসেছিলাম। মাথায় গুলি লেগেছিল, মারা গেছে। ওসমান একটু ইতস্তত করে যোগ দেয়, আমার কেউ নয়। পাশে দাঁড়িয়েছিল, হঠাৎ–
বাড়ি যেতে মুশকিল হবে।
পা আছে।
তা আছে বটে।
রসুলের হাতে কি হয়েছে সব যেন জানে ওসমান এমনিভাবে জিজ্ঞেস করে, হাতটা বাঁচবে তো?
কি জানি। সন্দেহ আছে।
ইস! ডান হাত।
কথা বলতে বলতে তিনজনে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। কত রোগ আঘাত যাতনা মৃত্যু শোক দুঃখ হতাশা ভরা হাসপাতালের এলাকা, হৃদয় ভারি তিন জনেরই। তবু তারা সহজভাবেই কথা কয়, জীবন্ত মানুষের যেন জীবনের অকারণ অর্থহীন, অভিশাপগুলির জন্য বিচলিত হতে নেই, ব্যথাও পেতে নেই।
রসুল এক রকম কথাই বলছিল না, হঠাৎ থেমে গিয়ে সে শিবনাথকে বলে, শরমের কথা ভাই, কিন্তু আর পারছি না। অজ্ঞান হয়ে পড়ার আগেই–
ওসমান ও শিবনাথ দুপাশ থেকে ধরে তাকে ধীরে ধীরে নামিয়ে বসিয়ে দেয়, নিজে বসে ওসমান তার মাথাটা বুকে টেনে এনে নিজের গায়ে তাকে হেলান দেওয়ায়।
তুই এক নম্বর আহম্মক রসুল।–শিবনাথ বলে গায়ের চাদরটা তার গায়ে জড়িয়ে দিতে দিতে।
ওসমান বলে, এরকম আহম্মক কম মেলে। ভেবেছিল কারো হাঙ্গামা না বাড়িয়ে কোনোমতে বাড়ি পৌঁছে যাবে। হাবিব বলত, নিজের অসুখ হলে রসুল লজ্জা পায়।
তাই তো ছোঁড়াকে সবাই এত ভালবাসে।
রসুল আফসোস করে বলে, এত রক্ত বেরিয়ে গেছে টের পাই নি। তাহলে কি এক লহমা দেরি করি হাসপাতালে আসতে, নিজেই আসতাম।
রসুল হাসপাতালেই থেকে যায়। ওসমান ও শিবনাথ যখন রাস্তায় নামে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে, জনহীন স্তব্ধতায় রাত্রিকে যেন ধরাছোঁয়া যেতে পারছে।
শিবনাথ চিরকাল বাইরে ধীর শান্ত ছেলে, সহজ ও সাধারণ। কখনো কোনো বিষয়ে কেউ তাকে আত্মহারা হতে দ্যাখে নি, যা কিছু ঘটছে বর্তমানে চোখের পলকে তার ভবিষ্যৎ অনুমান করে। নিয়ে সে যেন তদনুসারেই যা করা উচিত তাই করে যায় সব রকম সহজ বা কঠিন সামান্য বা গুরুতর কাজ। কোনো কাজেই তার পরোয়া নেই, সভায় বক্তৃতা করা থেকে চিঠি পৌঁছে দিয়ে। আসার কাজ পর্যন্ত আহত রসুলকে হাসপাতালে পৌঁছে দেবার কাজও। যে কাজ দেওয়া হোক। সে করবে প্ৰাণ দিয়ে, কিন্তু এক রকমের এক ধরনের কাজে তার মন ওঠে না। ওখানে ওই গুরুতর। পরিস্থিতিতে সে অনায়াসে নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করেছে, তারপর আর দরকার না থাকায় কাজ পাল্টে দায়িত্ব নিয়েছে রসুলকে হাসপাতালে পৌঁছে দেবার। ফিরে গিয়ে হয়তো চা এনে দেবার ব্যবস্থা করবে শীতে যারা রাস্তা কামড়ে বসে আছে খোলা আকাশের নিচে তাদের জন্য।
না, চায়ের ব্যবস্থা করবে না, ওসমান ভাবে লজ্জিত হয়ে। ওরকম উদ্ভট কাজ শিবনাথ করে না। সহজ স্বাভাবিক কাজই সে করে। ফিরে গিয়ে সে কি করবে ওসমান জানে না।
শিবনাথের কথা সে শুনেছে রসুলের কাছে। সব জায়গায় সব অবস্থায় নিজেকে মানিয়ে নেবার ওর নাকি অদ্ভুত ক্ষমতা, কেবল বাইরে নয়, বাড়িতে পর্যন্ত। বাইরের এসব কাজ ওর। বাপ-দাদা পছন্দ করে না, কিন্তু সংসারে সব বিষয়ে ওর পরামর্শ নিয়েই নাকি চলে তারা, বিয়ের ব্যাপার থেকে অসুখবিসুখে চিকিৎসার কি ব্যবস্থা করা যায় সে ব্যাপারে পর্যন্ত।
শিবনাথের কথা শুনে ওসমানের মনে হয়, ঠিক কথা, ছেলেটা ওই রকমই সন্দেহ নেই। ঘটন-অঘটনে ভরপুর গভীর রাত, স্তব্ধ বিষণ্ণ পথে চুপচাপ পথ চলাই ছিল খাপসুরৎ। ছেড়া। কিছু জড়িয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে পুঁটলির মতো ফুটপাতে শুয়ে আছে মানুষ, মাংসের বন্ধ দোকানটার সামনে তেমনি কুণ্ডলী পাকিয়ে চুপচাপ পড়ে আছে ঘেয়ো কুকুর। কোনো কি দরকার ছিল। শিবনাথের কথা বলার। কিন্তু কথা যখন সে বলল, ওসমানের মনে হল, এরকম কথা না বলে মুখ বুজে তার সঙ্গে পথ চললে ভারি অন্যায় হত শিবনাথের।
রসুলের মতো ছেলে পাওয়া ভার। ডান হাতটা গেল, আফসোস নেই। সঙ্গে সঙ্গে ভাবতে শুরু করেছে ডান হাতটা গেলেও বা হাত দিয়ে কি করে সব কাজ চালিয়ে নেওয়া চলবে। রসুল আমার ভায়ের মতো।
কি লাগসই কথাটাই বলল শিবনাথ তার মনের কথার সঙ্গে মানিয়ে। এই রকম কথা বলার জন্যই যে উন্মুখ হয়ে ছিল ওসমান, তা কি জেনেছে শিবনাথ?
ওসমান বলে, রসুল আমার ছেলের মতো।
ওসমানের কথার গতি ধরতে না পেরে শিবনাথ চুপ করে থাকে।
ওসমান বলে, সাচ্চা ছেলে, তবে দোষ ছিল একটা। ভাবত কি, রাজা বাদশা খানসাবরা গরিবের দুঃখ ঘোচাবে, বাবুরা বেহেস্ত বানিয়ে দেবে ওদের জন্য। রোজ বাঁধত হাবিবের সাথে, ঘরে থাকলে আমি শুনতাম চুপচাপ। একদিন হাবিবকে বলেছিলাম, যে শুনবে না বুঝবে না তার সাথে অত কথায় কাজ কি? হাবিব বলেছিল, ভেতরটা সাচ্চা আছে, ও ঠিক বুঝবে একদিন, এসব ছেলে যদি না বোঝে, না বদলায় তবে কে বুঝবে, কে বদলাবে?