মোর তরে সবার বিপদ হল, পালাতে কেমন লাগছে বদ্যিমশায়।
কেশব মাথা নেড়ে যেন তার এই অনুভূতির সঙ্গতিতেই সায় দেয়, বলে, পালাচ্ছ না তো, পালাবে কেন। ওরা তো ছেড়ে কথা কইবে না, কদিন তাণ্ডব চলবে চাদ্দিকে। তোমাদের ওপর ঝাল বেশি, প্রথম ধাক্কাটা পড়বে তোমাদের ওপর। তোমরা তাই কটা দিন নিরাপদ জায়গায় গিয়ে থাকবে। অবস্থা ভালো হলে, দেশের লোক প্রতিবাদ শুরু করলে অতটা যা তা করা চলবে না, যখন আইনসঙ্গত এনকোয়ারি শুরু হবে, কেশবের মুখে মৃদু হাসি দেখা দেয় ক্ষণিকের জন্য, তখন তোমরা ফিরে আসবে সাক্ষী দিতে। তোমার মেয়ে আমাদের তরফের বড় সাক্ষী।
সাক্ষী দিতে হবে? দেব। আমি সাক্ষী দেব। রাণী এতক্ষণে জানালা ছেড়ে সরে আসে।
কেশব নীরবে মাথা হেলিয়ে সায় দেয়।
কাছাকাছি থাকতে পারি না কোথাও গা ঢাকা দিয়ে? যাদব শুধোয় সংশয়ের সঙ্গে।
ছেলের কাছে যাবে বলেছিলে না? তাই ভালো। কলকাতাতেই যাও, কেশব বলে চিন্তিতভাবে দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে, সাক্ষী দেবার দরকার হবে কিনা শেষ পর্যন্ত তাই-বা কে বলতে পারে। উঁদে প্রজাগুলোকে জব্দ করার এ সুযোগ জগতবাবু ছাড়বে না। ও আবার কি পরামর্শ দেয়, কি দাড় করায়। নাঃ, ছেলের কাছেই যাও তুমি।
কেশবের স্ত্রী মেনকা এসে বিনা ভূমিকায় বলে, এস দিকি তোমরা খেয়ে নেবে দুটি। ডিবরিটা আনিস তো বাছা তুই, কি নাম যেন তোর মা, রাণী? ওমা, ডিবরি যে নিভল বলে।
তেল তো নেই অর। কেশব বলে।
রসুই ঘরের ডিবরি থেকে দিচ্ছি একটু।
সবাইকে একসাথে বসিয়ে দেয় মেনকা, রাণী আর গণেশের মাকে পর্যন্ত। খিচুড়ি খেতে বসে যাদবের চোখে হঠাৎ জল আসার উপক্রম হয়। তার মতো গরিব হাঘরে তুচ্ছ মানুষের জীবনেরও যে দাম আছে দশজনের কাছে, তার মতো লোকের মেয়ের সম্মান যে নিজের মেয়ের সম্মানের মতো হতে পারে দশজনের কাছে, এ জ্ঞান এ অভিজ্ঞতা তাকে প্রায় অভিভূত করে রেখেছে। প্রথমাবধি। চিরকাল নিজেকে সে জেনে এসেছে একান্ত অসহায়, দুর্ভিক্ষে হাড়ে মাসে টের। পেয়েছে সে বা তার পরিবারের বাচন মরণে কিছু এসে যায় না জগতের কারো। আজ সে জেনেছে। তা সত্যি নয়। ডান হাতে চোট লেগেছে, মুখে খাবার তুলতে কষ্ট হয়। কিন্তু সে বেদনা যেন গায়ে লাগে না যাদবের, ব্যাণ্ডেজের নিচে মাথার ক্ষতটা যে দপদপ্ করছে সে যন্ত্রণাও বাতিল হয়ে গেছে। তার কাছে। ভিতরে একটা ক্ষোভ আর আক্রোশকেই যেন জাগিয়ে বাড়িয়ে চলেছে শরীরের আঘাতগুলির যন্ত্রণা। সে ফিরে আসবে, বৌ-ছেলে-মেয়েকে গণেশের কাছে রেখে সে ফিরে আসবে তার জন্য যারা লড়ছে তাদের সাথে যোগ দিতে।
ভাগচাষের বাটোয়ারা আর বেগার খাটা নিয়ে যে লড়াই বাড়ছিল দিন দিন, যে হাঙ্গামার সুযোগে সঁজ সন্ধ্যায় মেয়েকে তার টেনে নিয়ে যাবার সাহস ওদের হয়েছে, তাতে ভালো করে যোগ দেয় নি বলে আফসোস হয় যাদবের। তাকে যারা আপন ভাবে, তার জন্য বচন মরণ তুচ্ছ করে, তাদের ব্যাপারে সে উদাসীন ছিল কেমন করে?
তাদের খাওয়া শেষ হবার আগেই নৌকার খোজে যে দুজন গিয়েছিল তারা ফিরে আসে।
আধঘণ্টার মধ্যে তাদের নিয়ে নৌকা ছেড়ে দেয়। কারো বারণ না শুনে রাণী ছইয়ের বাইরে বসে চেয়ে থাকে, আগুনের রক্তিম আভার দিকে। মধুখালি অতিক্রম করেই নৌকা যাবে।
মরেই যে গেছে, বিশেষ করে যাকে স্পষ্টই চেনা যায় কুলি বা চাকর বলে, তার জন্য হাসপাতালের লোক বেশি আর মাথা ঘামাতে চায় না। মরণের খবর জানবার প্রয়োজন যেন কিছু কম তার আপনজনের, প্রাণহীন শরীরটা যেন কিছু কম মূল্যবান তাদের কাছে। বাঁচাবার চেষ্টা সাঙ্গ হবার সঙ্গে অবশ্য প্রধান কর্তব্য শেষ হয়ে যায় হাসপাতালে। জীবিতের দাবিই তখন বড়। ওসমান তা জানে। আচমকা বহুসংখ্যক আহত ও মরণাপন্নদের আবির্ভাবে সকলে খুব ব্যতিব্যস্তও বটে। তবু, চটমোড়া মালটা খুলে মৃত লোকটির নাম ঠিকানা জানবার কোনো উপায় মেলে কিনা এটুকু চেষ্টা করে দেখবার অবসর কি কারো নেই? কোনো একটা হদিস পেলে আজ রাত্রেই খোঁজ নিতে যাবার জন্য সে তো রাজি ছিল, যত রাস্তা হাঁটতে হয় হাঁটবে। কিন্তু কালকের জন্য ও কাজটা স্থগিত রাখা হয়েছে। মিছামিছি হাঙ্গামা করে লাভ নেই আজ। সকলে বড় ব্যস্ত।
গণেশের কুর্তার পকেটে এক টুকরো কাগজে পেন্সিল দিয়ে ইংরেজিতে লেখা একটা ঠিকানা পাওয়া গিয়েছিল। জেমস স্ট্রিটের একজন এল, ক্যামারনের ঠিকানা। অনেক বলে বলে ওখানে ওসমান একটা টেলিফোন করাতে পেরেছিল। ক্যামারন কিছুই জানে না। বর্ণিত মৃতদেহ তার কোনো জানা লোকের নয়। না, কোনো মালের সে অর্ডার দেয় নি, কোনো মাল তার কাছে পৌঁছবার কথা ছিল না।
আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই, অনেক রাত হয়ে গেছে। কাল একবার এসে খবর নিয়ে যাবে। এক আত্মীয়কে মৃত দেখে, অজানা রেখে যেতে হচ্ছে মনে হয় ওসমানের। হাসপাতালে আসবার সময়ও ভেতরে ক্ষীণ একটু প্রাণ ছিল ছেলেটার, বাইরে যার কোনো লক্ষণ ছিল না। খানিক পরেই জীবন শেষ হয়ে যায় নিঃশব্দে, চুপিচুপি। ওর আসল আশ্চর্য মরণ ঘটেছিল রাস্তায়। তার কাছে মাথায় গুলি লাগার পরেও দাঁড়িয়ে থেকে, কথা বলে, হঠাৎ দ্রুতগতিতে নির্জীব নিঝুম। হয়ে ঢলে পড়ে। একটি কাতরানির শব্দ বার হয় নি মুখ দিয়ে। একটি লক্ষণ প্রকাশ পায় নি মারাত্মক আঘাত লাগার, অসহিষ্ণু উদ্বেগের সঙ্গে শেষ প্ৰশ্ন উচ্চারণ করেছিল, ওরা এগোবে না? তখনো তো ওসমান জানত না জীবন ওর শেষ হয়ে এসেছে, এ জগতে আর কোনো কথাই সে জিজ্ঞাসা করবে না কাউকে, এগোতে গিয়ে বাধা পেয়ে যারা থেমেছে তারা এগোবে কিনা জানতে চাইবে না। মাথায় গুলি লাগার জন্য হয়তো এ রকম হয়েছে, মস্তিষ্কের একটা অংশ আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছে। ছোকরা ডাক্তারটি তার বর্ণনা শুনে যা বললেন, হয়তো তাই হবে, ওসমানের জানবার কৌতূহল নেই। তার চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এই মরণ। নিকট আত্মীয়কে হয়তো সে ভুলে যাবে, অদ্ভুত মরণের স্মৃতির মধ্যে ছেলেটি চিরদিন বাস করবে তার মনে। নিজের মরণের দিন পর্যন্ত সে ভুলতে পারবে না ছেলেটির ব্যাকুল প্রশ্ন : ওরা এগোবে না?