ঠাণ্ডা কনকনে হাওয়া মুখে লাগছে। রাণীর শীতবোধ নেই। দূরে ওই অত্যাচারীর চিতার আগুনের তাপটাই সে অনুভব করছে, দেহমনের আর সব অনুভূতি মরে গেছে তার।
নিজে শীতে না কেঁপে, গণেশের মা বলেন যাদবকে, মোদের শোবার লেগে দশগণ্ডা হুকুম না ঝেড়ে, নিজে এসে কাত হও না একটু এদের পাশে কাথাটা গায়ে দিয়ে?
শোবার সময় এটা মোর আঁ?
বসে থেকে কি রাজ্য উদ্ধার করবে?–হাই চাপতে গণেশের মা রোগা হাতের মুঠিটাই। ঘষতে থাকে হাএ ভেবে কি হবে? ছেলে তো আছে শহরে, গিয়ে একবার পড়তে পারলে ভয়টা কি? নে যাবার সব তো করছে এরাই।
যাদব কথা কয়না।
একা তো নও আর? খুব তো সামলেছিলে মেয়াকে, বড়াই কত। সবার ঘরে মেয়ে বৌ, সবাই টের পেলে এমনি ব্যাপার চলতে দিলে আর বাঁচোয়া নেই, তাই না গেল সব মরিয়া হয়ে ছুটে। ধানতোলা নিয়ে না লাগলে এমন ক্ষেপত না লোক–ভগবানের আশীর্বাদ। মেয়াকে তোমার ছিনিয়ে আনলে, আগুন দিলে ঘাঁটিতে, হেথা সরিয়ে আনলে মোদের রাতারাতি, শহরতক পৌঁছে আর দিতে পারবে না? তুমি কোথা লাগবে উঠেপড়ে, তা নয়, ভয়ে ভাবনায় হাত-পা সেঁধিয়ে বসে আছ পেটের মধ্যে।
ডিবরির শিখাটা অবিরত কাঁপছে উত্তরের হাওয়ায়। গণেশের মার রোগা জীৰ্ণশীৰ্ণ দেহটা দেখতে দেখতে বাতাসের সরু গেঁটে বাঁশের দোলন মনে পড়ে যাদবের। যে ঝড়ে ঘরের চালা উড়ে যায়, বড় বড় গাছ মটমট ভেঙে পড়ে, সেই ঝড়েও গেঁটে বাঁশ শুধু দোল খায় নিশ্চিন্ত মনে। জীবনের ঝড়-ঝাপ্টা তাকে কাবু করে দিয়েছে, গণেশের মা ঠিক আছে তার নিজের মতিগতি বজায় রেখে। নইলে এত সব ভয়ানক বিপর্যয় কাণ্ডের পর, ঘরবাড়ি ছেড়ে পরের আশ্রয়ে এসে রাতারাতি শহরের উদ্দেশে অনির্দিষ্ট যাত্রার প্রতীক্ষা করার সময়, তাকে কঁথার নিচে ঢুকিয়ে একটু আরাম আর বিশ্রাম দেওয়াবার জন্য এত চালের কথা কইতে পারত গণেশের মা। সব ব্যাপারের মোটামুটি মানেটা বুঝেই গণেশের মা নিশ্চিন্ত। মেয়েকে তার জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল ব্যারাকে, গায়ের মানুষ সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেপে গিয়ে মেয়েকে তার উদ্ধার করে এনেছে, ব্যারাকে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, রাতারাতি তাদের সরিয়ে এনে ফেলেছে এখানে শহরে গণেশের কাছে পাঠিয়ে দেবার জন্য, এই পর্যন্ত জেনে গণেশের মা কদাকাটা হা-হুতাশ বাতিল করেছে। কত যে আরো ফ্যাকড়া আছে ও ব্যাপারে; সেটা তার খেয়াল নেই। এ ব্যাপারের জের যে কোথায় গড়াবে, কেন যে তাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে রাতারাতি, কত হাঙ্গামা কত দুর্দশা যে জমা হয়ে আছে তাদের জন্য সামনের দিনগুলিতে, যে সব কথা মাথায় আসে না ওর। শহরে গিয়ে ছেলের কাছে গিয়ে থাকবে ভেবেই সে খুশি, তার রোজগেরে ছেলে! মাসে মাসে টাকা পাঠাচ্ছে ছেলে, সে থাকতে ভাবনা কি তাদের?
এখনো জ্বলছে বাবা আগুন। দাউ দাউ করে জ্বলছে। রাণী হঠাৎ বলে মুখ না ফিরিয়েই।
তুই তো একটু শুলে পারতিস রাণী? গণেশের মা বলে আবেগহীন গলায়। এই মেয়েই যে যত ঝঞাট যত বিপাকের মূল এ কথা ভেবে তার কোনো জ্বালা নেই। সংসারের আর দশটা ঝঞাটে মেয়ে নয় বলে ওকে গঞ্জনা দেওয়া চলে, এই সৃষ্টিছাড়া ভয়ঙ্কর ব্যাপারে ওকে দায়িক ভাবা কি যায়? গণেশের মার অন্য দুশ্চিন্তা। মেয়ে তার খাঁটিই আছে, কিন্তু লোকে কি তা জানবে না মানবে! কেউ কিছু না বলুক, সবাই দরদ দেখাক, তবু মেয়ে তার ধৰ্মনাশের ছাপ মারা হয়ে রইল সকলের কাছে। সুধীর হয়তো মেয়েকে তার নেবে না এই অজুহাতে। এসব রাণী কি করে সইবে, অসহ্য হলে কেঁকের মাথায় কি করে বসবে, তাই ভাবে গণেশের মা। সেবার পদীর কচি মেয়েটাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল সাতরার ক্যাম্পে, সারারাত পদী মেয়ের কান্না শুনেছিল আর পাগলের মতো পাক দিয়েছিল ক্যাম্পের চারিদিকে। সকালে আমরা মেয়ে নিয়ে পদী গায়ে ফিরলে কি হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল চারিদিকে, কেমন মরিয়া হয়ে উঠেছিল চারিদিকের হিন্দু মুসলমান চাষাভূষো সব একজোট হয়ে, বড় হাকিম নিজে এসে ব্যবস্থা করার কথা না দিলে কাণ্ডই হয়ে যেত একটা। কাণ্ড হল শেষতক, তার মেয়েকে নিয়ে। পদীর মেয়ের দিকে ছিল সবাই, প্রাণ দিয়ে মায়া করেছে তাকে সবাই, সে নিজেও কি একদিন কেঁদে ফেলে নি তাকে বুকে জড়িয়ে দুটো কথা কইতে গিয়ে? তবু তো পুকুরে ড়ুবে মরল পদীর মেয়েটা। গায়ে থাকতে হলে রাণীই-বা কি করে বসত কে জানে? তার চেয়ে এ ভালো হয়েছে। ভাঙা ঘর আর ভিটেটুকু বাধা পড়ে আছে, ঋণের বোঝা জমে আছে পাহাড় হয়ে। কি হবে এ ভিটের মায়া করে? তার চেয়ে শহরে অচেনা লোকের মধ্যে রাণীও বাঁচবে শান্ত মনে, তারাও থাকবে সুখে শান্তিতে।
গণেশের মার সুখশান্তির স্বপ্নও ভোলা আর খোসা দিয়ে গড়া। তার বেশি চাইতে ভুলেও গেছে, সাহসও হয় না। না খেতে পেয়ে একেবারে না মরলে, রোগে বিপাকে মরণাপন্ন না হলে, মাথা গুঁজবার ঠাঁইয়ের অভাব না ঘটলে তার কত শান্তি কত সুখ লাভ হত।
কেশব একটি পুরোনো কম্বল হাতে করে ঘরে আসে, ঘরে তৈরী বালাপোষ গায়ে জড়িয়ে। বয়স প্রায় পঞ্চাশ হবে, শীর্ণ মুখে খোঁচা খোঁচা গোঁফদাড়ি। সহজ শান্ত ভাব, একটু গাম্ভীর্যপূর্ণ। মাঝরাত্রে হঠাৎ এই খাপছাড়া অতিথি পরিবারটির আবির্ভাবে তাকে কিছুমাত্র ব্যস্ত বা বিপন্ন মনে হয় না।
খিচুড়িটা নামবে এবার, কম্বলটা যাদবের কাছে নামিয়ে রেখে সে ঘরোয়া সুরে বলে, খেয়ে নিয়ে একটু বিশ্রাম করেই রওনা দিতে হবে। নৌকোয় ঘুমানো চলবে। নৌকো খুঁজতে গেছে।