মাধু বলেছিল শুনে, লাটসায়েবের মত একটা বাড়িতে থাকতে সাধ যায় না?
না।
মিথ্যে বোলো না!
সাধ আর স্বপ্নের তফাতটা মাধু এখন বোঝ না, এটাই আশ্চর্য! পেট ভরে ভাত খাওয়াও যেন সাধ, পোলাও খাওয়াও তাই। অথচ ওর বোঝা উচিত। দুটো পয়সা রোজগারের উপায় খুঁজে ছটফট করছে।
আঙুলে ধরা সিগারেট থেকে ধোঁয়া উঠছে, টানতেও যেন আলস্য লোকটার। দাঁড়াবার ভঙ্গিটাও আলসেমিতে ঢিল! কি হয় দেখবার জন্য দাঁড়িয়েছে কিন্তু আগ্রহের অভাবটা এমন স্পষ্ট। পাতলা পাঞ্জাবির পকেটে সিগারেটের রঙিন টিনটা দেখা যায়।
বিড়ি এক পয়সার কিনে একটা খেলে দোষ নেই। সাধ মিটিয়ে সিগারেট খাবার ক্ষমতা না। হলে সিগারেট হেবে না প্রতিজ্ঞা করেছে, বিড়ি কখনো খাবে না তা বলে নি নিজেকে। এমন বিশ্রী লাগছে ওদের দূরে থেকে দলভ্ৰষ্ট জাতনষ্ট পতিতের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে! একটা বিড়ি টানলে হয়তো একটু ভালো লাগত।
আজ নিয়ে পাঁচ দিন হল বিড়ি খায় না। বেশ কষ্ট হয়েছে না খেয়ে থাকতে, এখনো কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। খাবার ইচ্ছাটাও যে বেশ জোরালো আছে এখনো, সে তো বোঝাই যাচ্ছে। একটা বিড়ি খেয়ে পাঁচ দিনের লড়াইটা বাতিল করে দেবে। যাগে। কি হয় বিড়ি না খেলে।
বাবু? বাবু, শুনছেন? শিয়ালদহ যামু ক্যামনে?
এ এক আশ্চর্য ব্যাপার, অজয় ভাবে। গা থেকে যত গেঁয়ো মানুষ নতুন শহরে এসে ভ্যাবাঁচাকা খেয়ে যায়, সবাই যেন তারা হাঁ করে থাকে কখন অজয়বাবুর দেখা মিলবে, তাকে জিজ্ঞেস করে হদিস মিলবে পথঘাটের, মুশকিলের আসান হবে। কিছু জানবার থাকলে ভদ্রলোক তাকে এড়িয়ে জিজ্ঞেস করে অন্য লোককে, এরা সকলকে এড়িয়ে জিজ্ঞেস করে তাকে! এমন গেঁয়ো অজ্ঞ চাষা-ভূষোর মতোই কি দেখায় তাকে যে দেশগায়ের আপন লোক ভেবে ওরা ভরসা। পায়? ঘোমটাটানা ছোট্ট একটি কলাবৌ আর মাঝবয়সী একজন স্ত্রীলোকের সঙ্গে পাশের রাস্তায় খানিকটা ভেতরের দিকে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে লোকটি খানিকক্ষণ ধরে এদিক-ওদিক এর-ওর মুখের দিকে চাইছিল, এবার এত লোককে ডিঙিয়ে তার কাছে এসেছে।
একটু ঘুরে যেতে হবে বাপু।
পথ আর উপায় বাতলে দেয় অজয়, লোকটি মাথা চুলকোয়।
এস আমার সঙ্গে।
পাশের রাস্তা ধরে এগিয়ে ওদিকের মোড়ে রিকশা ডেকে ওদের তুলে দিয়ে অজয় নিজেও একটু ইতস্তত করে পথসংশয়ী পথিকের মতো। বাড়ি ফিরবে না ওখানে ফিরবে? সে ওদের নয়, তার পথ নয় ওদের পথ।
ইচ্ছে কিন্তু করছে ফিরে যেতে, ওরা কি করে দেখতে, শেষ পর্যন্ত কি হয় সঙ্গে থেকে জানতে। পরের মতোই না হয় সে দেখবে ওদের কার্যকলাপ, সে তো আর দাবি করছে না যে, মোটে আট মাস আমি ছাপ হারিয়েছি, আমায় তোমাদের মধ্যে ঠাঁই দাও!
গুলির আওয়াজটা তখন সে শুনতে পায়, কানে আসে তুমুল কলরব। সব ভুলে সে ছুটতে আরম্ভ করে, তার সমস্ত ক্ষোভ অভিমান পরিণত হয় একটিমাত্র ব্যাকুল প্রশ্নে, কি হল, কি হল? ভয়াতুর মানুষ ছুটে যায় তার পাশ কাটিয়ে বিপরীত দিকে, সে চেয়েও দেখে না। বরং তার একটা অদ্ভুত আনন্দ হয় যে এদের সংখ্যা বেশি নয়। দু-দশ জন পালাক, সকলে কি করছে দেখতে হবে।
তফাতে দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে সে ভুলে যায়, সোজা চলে যায় ওদের কাছে, ওদের মধ্যে।
০৪. মধুখালিতে তখন মাঝরাত্রি
মধুখালিতে তখন মাঝরাত্রি পার হয়ে গেছে। গায়ের পূর্ব প্রান্তের কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার আগুনের শিখায় রক্তিম হয়ে উঠেছে। অল্প দূরে নদীর জলও লাল হয়ে গেছে উদয়রশ্মির হেঁয়াচ লাগার মতো। সমুদ্রের দিকে প্রায় এক মাইল নামায় নদীর ধারে কেশব বদ্যির ঘর, সেখান থেকে মধুখালির আগুন দেখা যায়।
গোঙাতে গোঙাতে যাদব বলে, গণশার মা, শুলে পারতে না একটু? রাণী তুই শো না একটু বাছা? কত কষ্ট কত হাঙ্গামা আছে অদেষ্টে এখনো ঠিক কি তার?
শুয়ে কি হবে? শুলেই ডাকবে, বলবে চল এবার। কপালে দুঃখু আছে তো আছে! গণেশের মা জবাব দিয়ে মস্ত হাই তোলেন, হাঁ বুজবার আগেই কথাটা ঠিক করে দেন ছোট ছেলে দুটোর গায়ে। তারা অঘোরে ঘুমাতে আরম্ভ করেছে শোয়ার সুযোগ পাওয়ামাত্র।
রাণী উত্তরের বেড়ার জানালার ঝাপ উচু করে তাকিয়ে থাকে দূরের রক্তচিহ্নের দিকে। শুয়ে পড়ে একটু বিশ্রাম করে নেবার জন্য যাদবের আবেদন তার কানে পৌঁছেছে মনে হয় না। তার শরীরের শিরা-মাংস মাটিতে আছড়ে পড়ে বিশ্রাম খোঁজার মতো অবসন্ন, হঠাৎ হাঁটু ভেঙে হয়তো সত্যি সত্যি পড়ে যাবে, কে জানে। কিন্তু দূরের ওই আগুনের রক্তিম সংকেত থেকে চোখ সরিয়ে নেবার ক্ষমতা তার নেই। সাদা চুনকাম করা মাটির দেয়ালের ওপরে সুন্দর করে ছাওয়া কয়েকটা চালা শুধু পুড়ছে না ওখানে, সীতা দেবীর অগ্নিপরীক্ষার আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে দেবতারা তার সতীত্ব রক্ষার জন্য, একেবারে শেষ মুহূর্তে। হৈ হৈ রৈ রৈ আওয়াজ এসেছিল কানে, মনে হয়েছিল। দুকানে এতক্ষণের ঝিমঝিম আওয়াজ এবার বদলে গেল, কানের পর্দা ফেটে মাথার ঘিলু বেরিয়ে। আসছে বলে, এবার সে মরবে। যাক বাঁচা গেল, সে ভেবেছিল, মরার পর যা খুশি করুক তাকে নিয়ে বেঁটে মোটা লোকটা, সে তো আর জানবে না, বুঝবে না। গা সুদ্ধ লোক যে হৈ হৈ করে তাকে ছিনিয়ে নিতে এসেছে রাবণের হাত থেকে তা কি সে জানত! বিশ্বাস করতে পারে নি, মনে। হয়েছিল কোটালের জোয়ার বুঝি আসছে নদীতে, ও তারই গর্জন।
সে লোকটা কি পুড়েছে ওই আগুনে? ধীরেসুস্থে পোশাক ছেড়ে, তাকে বার বার ভয় নেই ভয় নেই বলতে বলতে, পা পর্যন্ত ঝোলা যে জামাটা গায়ে দিয়েছিল সেই জামাসুদ্ধ? রাণী জোরে নিশ্বাস টানে-ওখান থেকে এতদূরে ভেসে এসে যেন পোড়া মাংসের গন্ধ তার নাকে লাগা সম্ভব। সে যখন বেরিয়ে আসে পাগলের মতে, কয়েকজন মিলে সেটাকে মারছিল তার মনে পড়ে। খুন। করে কি রেখে এসেছে সেটাকে ওরা চিতায় পুড়বার জন্য? বেঁধে কি রেখে এসেছে নেওয়ারের খাটটার সঙ্গে জ্যান্ত অবস্থায়? ইস, একটু ধৈর্য ধরে সবাইকে বাইরে ডেকে সে নিজেই যদি বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে সেটাকে সজ্ঞানে জ্যান্ত অবস্থায় আগুনে পুড়ে মরবার ব্যবস্থা করে দিয়ে আসত!