অসুস্থ হয়ে পড়েছেন? কি হয়েছে? কিন্তু আমি যে এদিকে
অমৃতের অনিচ্ছুক, ইতস্তত ভাব অদ্ভুত লাগে মনমোহনের। তারপর সে ভাবে, তার কথা থেকে অমৃত হয়তো খবরটার গুরুত্ব ধরতে পারে নি। সে বলে, হঠাৎ হার্টের এ্যাটাক হয়েছে। শুনলাম। অবস্থা ভালো নয়। আপনি এখুনি চলে যান।
হার্টের এ্যাটাক অরুণার পক্ষে মারাত্মক হওয়া আশ্চর্য নয়। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় তাকে সুস্থ দেখেছিল বটে, কিন্তু হার্টের ব্যাপার হলে দু-চার মিনিটে অবস্থা খারাপ দাঁড়ানো সম্ভব। কিন্তু এদিকের ব্যবস্থা তবে কি করা যায়? চরম সিদ্ধান্তটা আজ তবে বাদ দিতেই হল। তাড়াতাড়ি তার কথাগুলি বলে নিয়ে বাড়িই তাকে ফিরে যেতে হবে। অরুণার অসুখের কথাটাও উল্লেখ করে বলতে পারবে যে, ওদের এ অবস্থায় রেখে ফিরে যেতে তার প্রাণ চাইছে না, কিন্তু স্ত্রীর কঠিন অসুখের জন্য একান্ত নিরুপায় হয়েই–
আমি কিছু বলতে এসেছি আপনাদের। মিনিট দশেক বলেই শেষ করে বাড়ি যাব।
আপনাদের কোনো অ্যানাউন্সমেণ্ট?
ঠিক তা নয়, আমি নিজেই কিছু বলব। দেশজোড়া একটা আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এ ব্যাপার নিয়ে, আমি বলে দিতে চাই যে, সে আন্দোলন গড়ে তুলতে আমার যতখানি ক্ষমতা আছে। সব আমি কাজে লাগাব।
নিজেকে হঠাৎ বড় শ্ৰান্ত মনে হয় মনমোহনের। অসীম ধৈর্যের সঙ্গে ভাষা ও গলার গুরুত্বপূর্ণতা বজায় রেখে সে বলে, এখন বলা কি ঠিক হবে? কেউ বক্তৃতা শোনার মতো অবস্থায় নেই। কাল মিটিং হবে, সেখানে বলাই ভালো হবে।
আমায় বলতে দেবেন না তাহলে?
বলতে চাইলে বাধা দেব কেন? বলা উচিত কিনা আপনিই বুঝে দেখুন। আমাদের মরাল ঠিক আছে, আপনার বক্তৃতার ফলে বড়জোর কয়েকজনের উত্তেজনা বাড়বে। তার চেয়ে আপনি যদি কাল পাবলিকের কাছে বলেন আপনার কথা, তাতে বেশি কাজ হবে।
বাড়িতে ও গাড়িতে যে উৎসাহ ও উত্তেজনা বেড়ে উঠেছিল, এখন তা অনেকটা ঝিমিয়ে গেছে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে অমৃতের কেমন অস্বস্তি বোধ হয়, একটু ভয়ও করে। সশস্ত্র আক্রমণ ও নিরস্ত্র প্রতিরোধের যে সংঘর্ষ হয়ে গেছে তারই আলোয় এখনকার শান্ত পরিস্থিতিকেও অমৃতের অপরিচিত, ধারণাতীত মনে হয়। সে অনুভব করে, তার এতদিনকার অভিজ্ঞতার সঙ্গে খাপ খায় না। আজকের অবস্থা, তার জানাশোনা ধরাবাধা পুরোনো নিয়মে আজকের ঘটনা ঘটে নি। তার পক্ষে এই অবস্থার সঙ্গে এঁটে ওঠা কঠিন হয়তো অসম্ভব।
ফিরে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে নিজেকে অমৃতের মৃত মনে হয়।
হালিম জোরে চালাও।
মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে অমৃতের, চোখের সামনে কতগুলি তারা ঝিকমিক করে ওঠে।
একটু দূরে দূরেই থাকে অজয়, তফাত থেকে উদাসীনের মতো দ্যাখে।
মনে তার নালিশ নেই, ক্ষোভ জমা হয়ে আছে প্রচুর। তার উনিশ বছরের মনটা অভিমানে জর্জর।
ওরা শোভাযাত্রা করে এসে বাধা পেয়ে এখানে বসেছে রাস্তায়, এই নতুন উত্তেজনায় আরো মজাদার হয়েছে ওদের দল বেঁধে রাস্তায় নেমে মজা করা। বেশ খানিকটা হৈচৈ হবে চারিদিকে এই ব্যাপার নিয়ে। বড় বড় লোকেরা ছুটোছুটি করবে বড় কর্তাদের কাছে, আলাপ-আলোচনা চলবে কিছুক্ষণ; তারপর মিটমাট হবে আপস মীমাংসায়। গর্বে বুক ফুলিয়ে বাড়ি ফিরবে সবাই, আত্মীয়বন্ধু পাড়াপড়শির কাছে, মেসে হোটেলে চায়ের দোকানে, সচকিতা মেয়েটির কাছে, বলে বেড়াবে ওরা কিভাবে সংগ্রাম করেছে–সগ্ৰাম! আট মাস আগে হলে সেও যেমন হয়তো থাকত ওদের মাঝে, বাড়ি গিয়ে মাধুকে শোনাত সগ্রামের কাহিনী, চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে চেয়ে থাকত মাধু!
আজ সে ওদের মধ্যে নেই। সে আর কলেজের ছেলে নয়। হাজার দুঃখদুর্দশার মধ্যেও হাসিখুশি আশা স্বপ্নের ওই নিশ্চিন্ত সুখের জীবন তার ফুরিয়ে গেছে, শোভাযাত্রা করে এসে লাঠি বন্দুকের বাধা মানব না বলে রাস্তায় বসে পড়ার মজা আর তার জন্যে নয়। সে এখন চাকুরে, কেরানি। মাসকারি চল্লিশ টাকা বেতনটাই এখন তার আশা আনন্দ ভবিষ্যৎ হাওড়ার ওই বস্তিঘেঁষা নোংরা পুরোনো ভদ্রপল্লীর ওই টিনের চাল মাটির দেয়াল আর লাল সিমেন্টের মেঝেওয়ালা বাড়িটার অংশটুকুতেই আটকে গেছে জীবন তার চিরদিনের জন্য, এই ঘরে-কাচা আধময়লা জামাকাপড় আর সস্তা হেঁড়া রংচটা আতোয়ানটি তার শুধু বেশভূষা নয়, আগামী পরিচয়ও বটে।
এমনি লোকও বহু জুটেছে ওদের সঙ্গে, পথের রাজপথের সাধারণ পথিক। তার চেনা ওই ছোকরা পর্যন্ত দলে ভিড়েছে, আপিসের সামনে বিড়ির দোকানে যাকে সে বিড়ি বানাতে দেখে। আসছে গত কয়েক মাস। তবু অভিমান নরম হয় না অজয়ের। পথিকেরা ভিড় করেছে মজা। দেখতে, কৌতূহলের বশে। ওদের মধ্যে গিয়ে ভিড়লে তাকেও ওরা ভাববে দলের বাইরের ওই রকম কৌতূহলী পথিক, ওদেরই মতো সেও যে ছিল কলেজের ছাত্র মাত্র কয়েক মাস আগে, এ পরিচয় ঘোষণা করলেও ওরা তাকে আপন ভাবতে পারবে না। সে আর ছাত্র নেই, সে পর হয়ে গেছে। ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবার দাবি তার নেই।
একটা বিড়ি টানতে ইচ্ছা করে। সঙ্গে নেই, কিনতে হবে।
বন্ধুদের কাছে সিগারেট মিলত, তার সঙ্গে নিজে দু-একটা কিনে চালিয়ে দেওয়া যেত একরকম। একটা সিগারেট তিনবারও রানো যায় নিভিয়ে রেখে রেখে। চাকরি নিয়ে পাঁচটা করে সিগারেট কিনছিল রোজ নিজের রোজগারের পয়সায়, কম দামি সিগারেট, পাঁচটা মোটে দুআনা এক বাণ্ডিল বিড়ির দাম। ছেড়ে দিতে হয়েছে। ট্রাম বাসের কটা পয়সা বাঁচাতে ব্রিজ থেকে যাকে হাঁটতে হয় আপিস পর্যন্ত, সে খাবে সিগারেট। বিড়ি ধরেছিল, ঘেন্নায় তাও ছেড়ে দিয়েছে। সিগারেট টানবার সাধ নিয়ে ক্ষমতার অভাবে টানতে হবে বিড়ি! ধোঁয়া খাওয়াই বন্ধ থাক তার চেয়ে!