এখন যাবেন কি বাবু? গেলে পারতেন।
মাখন দিনে আপিসের বেয়ারা, রাতে আপিসের পাহারাদার! বড় ছোট সাহেব আর বাবুরা কোকালে বেরিয়ে গেছেন আপিস থেকে ভালোয় ভালোয়, দুশ টাকার এই বাবুটি টিকে আছেন এখন পর্যন্ত। এত কি ভয়, এত কি প্রাণের মায়াঃ সবাই বাড়ি যেতে পারল, ছেলেমানুষ সরল বাবু পর্যন্ত, ইনি ভয়ের চোটে তেতলা থেকে নিচেই নামলেন না মোটেই। রাতটা হয়তো এখানেই কাটাবার মতলব। জ্বালাতন করে মারবেন মাখনকে।
আবার বলে মাখন, ভয় নেই বাবু। আমি দুবার বাইরে থেকে ঘুরে এসেছি। ওদিক যাবেন। না, পাশের রাস্তা দিয়ে ঘুরে বাড়ি চলে যান, কোনো ভয় নেই। একটু হাঁটতে হবে।
মাখন–অক্ষয় বলে, আমি মরতে ভয় পাই না।
আজ্ঞে না বাবু–মাখন বলে সবিনয়ে। সে ভেবে পায় না বাইরে না বেরিয়েও অক্ষয় বাবু মাল টানলেন কি করে। সঙ্গেই থাকে হয়তো শিশিতে!
আমি একটু ঘুরে দেখে আসতে যাচ্ছি মাখন। আমি ঘুরে এলে তুমি ঘুমাবে।
ঘুরে আসবেন?
ঘুরে আসব। বেশি দেরি হবে না, আধঘণ্টার মধ্যে। সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায় অক্ষয়। দারোয়ান সদরের গেটে একেবারে তালা এঁটে দিয়েছে। অক্ষয়কে দেখে সে অবাকও হয়, কথা শুনে রাগও করে।
ঘুমকে আয়েগা ফিন?
জরুর আয়গা।
গেটে তালা বন্ধ থাকবে, গেট খোলা রাখতে পারবে না রাম সিং। এতক্ষণ এ বাবু ভয়ে লুকিয়ে ছিল আপিসের ভেতরে, বাড়ি যেতে সাহস পায় নি। অবজ্ঞায় মুখ বাঁকা হয়ে যায় রাম সিংয়ের। কেন বাইরে যাচ্ছে বাবু সে বুঝে উঠতে পারে না। খাবার বা বিড়ি-সিগারেটের দোকান খোলা নেই কাছাকাছি, তাছাড়া ওদের জন্য তো বাবুদের নিজের বাইরে যাওয়া রীতি নয়, তাকেই হুকুম করত এনে দেবার। বাইরেই যখন যাচ্ছে বাবু, বাড়ি না গিয়ে ঘুরে আসবে কেন?
বাবুদের চালচলন বোঝা দায়, রাম সিং ভাবে তার অনেক দিনের অভিজ্ঞতার জ্ঞানের সঙ্গে মিলিয়ে।
গেট পাশের রাস্তার ভিতরে। ঘটনাস্থলের বিপরীত দিকে এগোতে আরম্ভ করে অক্ষয়, একটু ঘুরে বারে যেতে হবে। ইতিমধ্যে বার যদি বন্ধ হয়ে গিয়ে থাকে? নটা প্রায় বাজে। বন্ধ না হলেও পেগ নিয়ে তাড়াতাড়ি গিলতে হবে। তার চেয়ে হোটলেই কি চলে যাবে একেবারে? সঙ্গে আবার টাকা আছে কম। আজ ইচ্ছে করে বেশি টাকা নিয়ে বার হয় নি। বারের মালিক তাকে চেনে, সেখানে দু-এক পেগ ধারে খাওয়া যেতে পারে। হোটেলে সঙ্গের পয়সায় দেড় পেগের বেশি হবে না।
বেশি খাবার মতলব তার আছে নাকি?
মন যেন কথা কয়ে ওঠে জবাবে : আগে বারে চল, ধারে চটপট দু-তিন পেগ খেয়ে নিয়ে নগদ যা আছে তা দিয়ে হোটেলে বসে যতটা জোটে মৌজ করতে করতে খাওয়া যাবে।
বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। চাদরটা অক্ষয় ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নেয়। এই ঠাণ্ডায় ওরা কি সারারাত রাস্তায় বসে থাকবে? শীতে জমে যাবে না? একটা জোরালো স্নায়বিক শিহরণ বয়ে যায়। অক্ষয়ের সর্বাঙ্গে, সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে তেরাস্তার মস্ত মোড়ে, আলো সেখানে ঝলমল করছে। বিশেষ ব্যবস্থায়। মাথাটায় কয়েকবার ঝুঁকি দিয়ে নেয়। তিন-চার বছর আগে হলেও সেও বোধহয় পারত গুলির মুখে নির্বিবাদে রাস্তায় বসে থাকতে, সারারাত ধরে শীতে জমতে। চাকরি নিয়েও বেশ কিছুকাল, যুদ্ধের বাজারে উপরি আয়ের উপায়টা খুঁজে পাওয়ার পর থেকে এই দশা হয়েছে তার।
পূর্বদিক থেকে ফুটপাত ধরে তাদের আপিসের মনমোহন হনহন করে এগিয়ে আসছে, দূর থেকেই অক্ষয় চিনতে পারে। মোড়ে এসে মনমোহন তাদের আপিসের পথে বাঁক নেবে, অক্ষয় তাকে ডাকল।
অক্ষয় এখন এ অঞ্চলে কি করছে মনমোহন ভালোভাবেই জানে! দুজনে কাছাকাছি হওয়ামাত্র সে বলে, আমি বড় ব্যস্ত ভাই।
হাঙ্গামার ওখানে যাবে নাকি?
হ্যাঁ, ওখানেই যাচ্ছি। তুমি কখন খবর পেলে? আপিস থেকে বেরোতে দেখি নি তোমায়।
আমি সঙ্গেই ছিলাম। টিফিনের আগেই বেরিয়ে পড়েছিলাম।
মনমোহন একটু আশ্চর্য হয়ে অক্ষয়ের মুখের দিকে তাকায়। সহজ স্বাভাবিক ভাবেই বলছে অক্ষয়, মদ যে খেয়েছে বোঝা যায় না।
এখন তবে–? অক্ষয় প্রশ্ন করে, বাড়ি থেকে ঘুরে এলে বুঝি?
কথা বলার সময় মনমোহন বোতাম খোলা কোটের দুটি প্রান্ত বুকের কাছে দুহাতে ধরে থাকে। খুব শীতের সময়েও অক্ষয় তাকে কোনোদিন কোটের বোমও লাগাতে দেখে নি, এই অভ্যাসের ব্যতিক্রমও দেখে নি।
বাড়ি যাওয়া হয় নি। একজন নেতার কাছে গিয়েছিলাম। আচ্ছা আসি ভাই আমি।
মদ খাই নি মোহন। বুঝলে? মদ আমি খাই নি। আমার সঙ্গে দুটো কথা কইলে জাত যাবে না।
তার আহত উগ্ৰ কথার মধ্যে চাপা আৰ্তনাদের সুরটাই বেশি স্পষ্ট হয়ে বাজে মনমোহনের কানে। মমতা সে একটু বোধ করে অক্ষয়ের জন্য, তার চেয়ে বেশি হয় তার আফসোস। কোন স্তরে মানুষকে টেনে নিয়ে যায় মদ! এই সেদিনও সুস্থ, সুখী, স্বাভাবিক ছিল এই মানুষটা। ব্যাংকের কাজের অবসরে, ছুটির পরে, কত আগ্রহের সঙ্গে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, স্বাধীনতা, চাষী-মজুরের ভবিষ্যৎ এসব বিষয়ে আলোচনা করেছে, স্থায়ী সমস্যা আর সাময়িক পরিস্থিতি সম্পর্কে মত ও পথের কথায় ধরা পড়েছে তার ভিতরের একটা জিজ্ঞাসু, উৎসুক, তেজস্বী দিক। কিছুদিনের মধ্যে কিভাবে এলোমেলো হয়ে গেছে তার কথাবার্তা, সব বিষয়ে আগ্রহ আর উৎসাহ গেছে ঝিমিয়ে। রাস্তায় হঠাৎ দেখা হলে পর্যন্ত বিশেষ প্রয়োজনে একজন তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়ে চলে যেতে চাইলে আজ তার বিকারগ্রস্ত মন অপমান বোধ করে, অবজ্ঞা খুঁজে নিয়ে উথলে ওঠে ছেলেমানুষি অভিমান! এ ভাবটা যে চেপে রাখবে, একটু সংযম পর্যন্ত নেই।