- বইয়ের নামঃ চিহ্ন
- লেখকের নামঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ মাটিগন্ধা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. প্ৰাণ ধুকপুক করে না গণেশের
প্ৰাণ ধুকপুক করে না গণেশের।
বিস্ময় আর উত্তেজনা অভিভূত করে রাখে তাকে, আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়তে বুঝি খেয়ালও হয় না তার। বিশ-বাইশ বছর বয়সের জীবনে এমন কাণ্ড সে চোখে দেখে নি, মনেও। ভাবে নি। এত বিরাট, এমন মারাত্মক ঘটনা, এত মানুষকে নিয়ে। এ তার ধারণায় আসে না, বোধগম্য হয় না। তবু সবই যেন সে বুঝতে পারছে, অনুভব করছে, এমনিভাবে চেতনাকে তার গ্রাস করে ফেলেছে রাজপথের জনতা আর পুলিশের কাণ্ড। সে-ই যেন ভিড় হয়ে গেছে নিজে। ভিড়ে সে আটকা পড়ে নি, বন্ধ দোকানটার কোণে যেখানে সে দাঁড়িয়েছে যেখান থেকে পাশের সরু গলিটার মধ্যে সহজেই ঢুকে পড়তে পারে যখন ইচ্ছা হবে তার এখান থেকে সরে যেতে। কিন্তু যাবে কি, সে বাঁধা পড়ে গেছে আপনিই। জনতার গৰ্জনে, গুলির আওয়াজে, বুকে আলোড়ন উঠছে, চঞ্চল হয়ে উঠছে শিরার রক্ত। ভয় ভাবনা চাপা পড়ে গেছে আড়ালে। ভয়ে নয়, নিজেকে বাঁচাবার হিসাব কষে নয়, হাঙ্গামা থেকে তফাতে সরে যেতে হয় এই অভ্যস্ত ধারণাটি শুধু একটু তাগিদ দিচ্ছে পালিয়ে যাবার। কিন্তু সে জলো তাগিদ। হাঙ্গামা যে এমন অনড় অটল ধীরস্থির হয়, বন্দুকধারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে মানুষ এদিক-ওদিক এলোমেলো ছুটোছুটি করে না, এ তার ধারণায় আসে না। এ কেমন গণ্ডগোল যেখান থেকে কেউ পালায় না! তাই, চলে যাবার কথা মনে হয়, তার পা কিন্তু অচল। কেউ না পালালে সে পালাবে কেমন করে।
তা ছাড়া, মনে তার তীব্র অসন্তোষ, গভীর কৌতূহল। এমন অঘটন ঘটছে কেন, থেমে থাকছে কেন তার গায়ের পাশের হলদি নদীতে পূর্ণিমার কোটালের জোয়ার? দেড় ক্রোশ তফাতের সমুদ্র থেকে উন্মত্ত কোলাহলে ছুটে আসছে যে মানুষ-সমান উঁচু জলের তোড়, তা তো থামে না, কিছু তো ঠেকাতে পারে না তাকে। কত পূর্ণিমা তিথিতে অনেক রাতে সে চুপিচুপি কঁপ খুলে বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে মা-বাবাকে না জাগিয়ে, দাঁড়িয়ে থেকেছে ভাটার মরা নদীর ধারে কোটালের জোয়ারের রোমাঞ্চকর আবির্ভাবের জন্য।
দিনে ভাটার নদীর কাদায় শুয়ে কত কুমির রোদ পোহায়। দেখে মনে হয়, কত যেন নিরীহ ভালোমানুষ জীব। অল্প জলে হঠাৎ তীরের মতো কি যে তীব্র বেগে জলকে লম্বা রেখায় কেটে হাঙ্গর গিয়ে শিকার ধরে। কাদা-জলে লাফায় কত অদ্ভুত রকমের মাছ। কেমন তখন বিষণ্ণ হয়ে যায়। গণেশের মন। আহা দুঃখী নদী গো, হাঙ্গর কুমির মাছ মিলে কত জীব, তবু যেন জীবনের স্পন্দন নেই, ডাইনে-বায়ে যতদূর তাকাও ততদূর তক। এই নদীতে প্রাণ আসবে, স্বয়ং পাগলা শিবঠাকুর যেন আসছেন নাচতে নাচতে বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড কাপিয়ে সাদা ফেনার মুকুট পরে, তেমনিভাবে আসবে। প্রাণের জোয়ার। গণেশের প্রাণেও আনন্দ এত, যা মাপা যায় না।
সেই অভ্যস্ত, পরিচিত, অতি ভয়ানক, অতি উন্মাদনায় কোটালের জোয়ার যদি মনে ধেয়ে এল গর্জন করে, গা ছেড়ে আসবার এতদিন পরে শহরের পথে সে জোয়ার থেমে গেল, বসে পড়ল ফুটপাতে পিচের পথে। এ কেমন গতিহীন গর্জন, সাদা ফেনার বদলে এ কেমন কালো চুলের ঢেউ।
গুলি লেগেছে নাকি? না লাঠি?
ওসমান জিজ্ঞেস করে গণেশকে দ্বিধা-সংশয়ের সুরে, গভীর সমবেদনায়। দোকানের কোণে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা, ঠিক কোথা থেকে রক্ত বেরিয়ে ভিজিয়ে লাল করে দিচ্ছে গায়ের ময়লা ঘেঁড়া ফতুয়াটা ঠিক বোঝা যায় না। গুলি যদি লেগেই থাকে, যেখানেই লেগে থাক, দাঁড়িয়ে আছে কি করে ছেলেটা, ফতুয়ার বুকের দিকটা যখন চুপসে যাচ্ছে রক্তে? চোখের চাউনিটা অদ্ভুত। মরা মানুষ যেন বেঁচে উঠে তাকিয়ে আছে বিহ্বলের মতো। কুলিমজুরিই সম্ভবত করে। মোটটা নামিয়ে রেখেছে।
আঁ? কি জানি বাবু। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ শোনায় গণেশের গলা, এরা এগোবে না বাবু?
বাবু! খচ্ করে একটু আঁচড় লাগে ওসমানের বুকে। কালিবুলি মাখা এই হাফশার্ট পরনে, রংচটা সুতোওঠা নীল প্যান্ট, পায়ে জুতো নেই, দাড়ি কামায় নি সাত দিন। তবু তাকে বাবু বলে ছেলেটা। ঘৃণ্য বাবু বলে গাল দেয়! ট্রামের কাজ ছেড়ে দেবার চলতি আফসোসটা আরেকবার নাড়া খায় ওসমানের। এ আফসোস তেজী হয়েছে ওসমানের গত ধর্মঘটের সাফল্যের পর। ট্রামের সেকেণ্ড ক্লাসেও কেউ কোনোদিন তাকে বাবু বলে অপমান করে নি।
তবে হ্যাঁ, এ ছেলেটা মুটে-মজুরি করে। গা থেকে এসেছে বোধহয় নেহাত পেটের খিদের তাড়নায়। ভিখারি আর মুটে-মজুর ছাড়া সবাইকে বাবু বলা অভ্যাস হয়ে গেছে।
এরা বসে দাঁড়িয়ে থাকবে বাবু? এগোবে না?
এবার ক্ষীণ শোনায় গণেশের গলা শ্লেষ্ময় আটকানো কাশির রোগীর গলার মতো, রক্তে আটকানো যক্ষ্মা রোগীর গলারও মতো।
এগোবে না তো কি? ওসমান মৃদু হেসে বলে, নিঃসংশয়ে। পিছু হটে ছত্ৰখান হয়ে পালিয়ে যখন যায় নি সবাই, লাইন ক্লিয়ার না পাওয়া ইঞ্জিনের মতো শুধু নিয়ম আর ভদ্রতার খাতিরে থেমে থেমে যুঁসছে এগিয়ে যাবার অধীরতায়, তখন এগোবে না তো কি! এগোবার কল টিপলেই এগোবে।
তবে কিনা–গণেশ জোরে বলবার চেষ্টা করে জড়িয়ে জড়িয়ে। দোকানের বিজ্ঞাপন আঁটা দেয়ালের গায়ে পিঠ ঘষড়ে সে নেমে যায় খানিকটা হাঁটু বেঁকে। পিঠ কুঁজো হয়ে মাথাটা ঝুলে পড়ে। যে বাড়ির কোণে ছোট একখানি ঘর তার পিছনে হেলান দেবার দোকান, সেই বাড়িরই উঁচু ভিতের বাঁকানো একটু খুঁজে না আটকালে সে হয়তো তখনি ফুটপাতে আশ্রয় নিত, আরো যে মিনিটখানেক পড়ে না গিয়ে আধ-খাড়া রইল তা আর ঘটত না।