শঙ্কর ওকে বহন করে তাঁবুতে নিয়ে এল। মুখে জল দিল, তারপর গায়ের কোটটা খুলতে গিয়ে দেখে গলার নিচে কাঁধের দিকের খানিকটা জায়গার মাংস কে যেন ছিঁড়ে নিয়েছে! সারা পিঠটারও সেই অবস্থা। কোনো এক অসাধারণ বলশালী জন্তু, তীক্ষ্ণধার নখে বা দাঁতে পিঠখানা চিরে ফালা ফালা করেছে।
পাশেই নরম মাটিতে কোনো এক জন্তুর পায়ের দাগ— তিনটে মাত্র আঙুল সে পায়ে।
সারারাত্রি সেই ভাবেই কাটল, আলভারেজের সাড়া নেই, সংজ্ঞা নেই। সকাল হবার সঙ্গে হঠাৎ যেন তার চেতনা ফিরে এল। শঙ্করের দিকে বিস্ময় ও অচেনার দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলে, যেন এর আগে সে কখনো শঙ্করকে দেখেনি। তারপর আবার চোখ বুজল। দুপুরের পর খুব সম্ভবতঃ নিজের মাতৃভাষায় কী সব বকতে শুরু করল, শঙ্কর এক বর্ণও বুঝতে পারলে না। বিকেলের দিকে সে হঠাৎ শঙ্করের দিকে চাইলে। চাইবার সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করের মনে হল, সে ওকে চিনতে পেরেছে। এইবার ইংরেজীতে বললে— শঙ্কর! এখনো বসে আছ? তাঁবু ওঠাও, চল যাই— তারপর অপ্রকৃতিস্থের মতো নির্দেশহীন ভঙ্গীতে হাত তুলে বললে— রাজার ঐশ্বর্য লুকোনো রয়েছে ঐ পাহাড়ের গুহার মধ্যে— তুমি দেখতে পাচ্ছ না— আমি দেখতে পাচ্ছি। চল আমরা যাই— তাঁবু ওঠাও— দেরি কোরো না…
এই আলভারেজের শেষ কথা।
তারপর কতক্ষণ শঙ্কর স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। সন্ধ্যা হল, একটু একটু করে সমগ্র বনানী ঘন অন্ধকারে ডুবে গেল।
শঙ্করের তখন চমক ভাঙল। সে তাড়াতাড়ি উঠে আগে আগুন জ্বাললে, তারপর দুটো রাইফেলে টোটা ভরে তাঁবুর দোরের দিকে বন্দুকের নল বাগিয়ে, আলভারেজের মৃতদেহের পাশে একখানা শতরঞ্জির ওপর বসে রইল।
তারপর সে রাত্রে আবার নামল তেমনি ভীষণ বর্ষা। তাঁবুর কাপড় ফুঁড়ে জল পড়ে জিনিসপত্র ভিজে গেল। শঙ্কর তখন কিন্তু এমন হয়ে গিয়েছে যে, তার কোনোদিকে দৃষ্টি নেই। এই ক’মাসে সে আলভারেজকে সত্যিই ভালোবেসে ছিল, তার নির্ভীকতা, তার সংকল্পে অটলতা, তার পরিশ্রম করবার অসাধারণ শক্তি, তার বীরত্ব— শঙ্করকে মুগ্ধ করেছিল। সে আলভারেজকে নিজের পিতার মতো ভালোবাসতো। আলভারেজও তাকে তেমনি স্নেহের চোখেই দেখতো।
কিন্তু এসবের চেয়েও শঙ্করের বেশি মনে হচ্ছে যে, আলভারেজ শেষকালে মারা গেল সেই অজ্ঞাত জানোয়ারটারই হাতে। ঠিক জিম কার্টারের মতোই।
রাত্রি গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে তার মন ভয়ে আকুল হয়ে উঠল। সম্মুখে ভীষণ অজানা মৃত্যুদূত— ঘোর রহস্যময় তার অস্তিত্ব। কখন সে আসবে, কখন বা যাবে, কেউ তার সন্ধান দিতে পারবে না। ঘুমে ঢুলে না পড়ে শঙ্কর মনের বলে জেগে বসে রইল সারা রাত।
ওঃ, সে কি ভীষণ রাত্রি! যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন ও রাত্রির কথা সে ভুলবে না। গাছে গাছে, ডালে ডালে, হাজার ধারায় বৃষ্টি পতনের শব্দ ও একটানা ঝড়ের শব্দ, অরণ্যানীর অন্য সকল নৈশ শব্দ আজ ডুবিয়ে দিয়েছে। পাহাড়ের উপর বড় গাছ মড় মড় করে ভেঙে পড়ছে। এই ভয়ঙ্কর রাত্রিতে সে একা এই ভীষণ অরণ্যানীর মধ্যে! কালো গাছের গুঁড়িগুলো যেন প্রেতের মতো দেখাচ্ছে, অত বড় ঝড় বৃষ্টিতেও জোনাকির ঝাঁক জ্বলছে। সম্মুখে বন্ধুর মৃতদেহ। ভয় পেলে চলবে না! সাহস আনতেই হবে, নতুবা ভয়েই সে মরে যাবে। সাহস আনবার প্রাণপণ চেষ্টায় সে রাইফেল দুটির দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করলে। একটা উইনচেস্টার, অপরটি ম্যানলিকার— দুটোরই ম্যাগাজিনে টোটা ভর্তি। এমন কোনো শরীরধারী জীব নেই, যে এই দুই শক্তিশালী অতি ভয়ানক মারণাস্ত্রকে উপেক্ষা করে, আজ রাত্রে অক্ষত দেহে তাঁবুতে ঢুকতে পারে।
ভয় ও বিপদ মানুষকে সাহসী করে। শঙ্কর সারারাত সজাগ পাহারা দিল। পরদিন সকালে আলভারেজের মৃতদেহ সে একটা বড় গাছের তলায় সমাধিস্থ করলে এবং দু’খানা গাছের ডাল ক্রুশের আকারে শক্ত লতা দিয়ে বেঁধে সমাধির উপর পুঁতে দিলে।
আলভারেজের কাগজপত্রের মধ্যে ওপর্টো খনি বিদ্যালয়ের একটি ডিপ্লোমা ছিল ওর নামে। তাদের শেষ পরীক্ষায় আলভারেজ সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছে। ওর কথাবার্তায় অনেক সময়েই শঙ্করের সন্দেহ হত যে, সে নিতান্তই মূর্খ ভাগ্যান্বেষী ভবঘুরে নয়।
লোকালয় থেকে বহুদূরে এই জনহীন গহন অরণ্যে, ক্লান্ত আলভারেজের রত্নানুসন্ধান শেষ হল। তার মতো লোকেরা রত্নের কাঙাল নয়, বিপদের নেশায় পথে পথে ঘুরে বেড়ানোই তাদের জীবনের পরম আনন্দ, কুবেরের ভান্ডারও তাকে এক জায়গায় চিরকাল আটকে রাখতে পারতো না।
দুঃসাহসিক ভবঘুরের উপযুক্ত সমাধি বটে। অরণ্যের বনস্পতিদল ছায়া দেবে সমাধির উপর। সিংহ, গরিলা, হায়েনা সজাগ রাত্রি যাপন করবে, আর সবার উপরে, সবাইকে ছাপিয়ে বিশাল রিখটারসভেল্ড পর্বতমালা অদূরে দাঁড়িয়ে মেঘলোকে মাথা তুলে খাড়া পাহারা রাখবে চিরযুগ।
১০. চাঁদের পাহাড় – দশম পরিচ্ছেদ
সে দিন সে রাত্রিও কেটে গেল। শঙ্কর এখন দুঃসাহসে মরিয়া হয়ে উঠেছে। যদি তাকে প্রাণ নিয়ে এ ভীষণ অরণ্য থেকে উদ্ধার পেতে হয়, তবে তাকে ভয় পেলে চলবে না। দু’দিন সে কোথাও না গিয়ে, তাঁবুতে বসে মন স্থির করে ভাববার চেষ্টা করলে, সে এখন কী করবে। হঠাৎ তার মনে হল আলভারেজের সেই কথাটা— সলস্বেরি… এখান থেকে পূর্ব-দক্ষিণ কোণে আন্দাজ ছশো মাইল…
সলস্বেরি! দক্ষিণ রোডেসিয়ার রাজধানী সলস্বেরি… যে করে হোক, পৌঁছুতেই হবে তাকে সলস্বেরিতে। সে এখনো অনেকদিন বাঁচবে, তার জন্মকোষ্ঠিতে লেখা আছে যে! এ জায়গায় বেঘোরে সে মরবে না।
শঙ্কর ম্যাপগুলো খুব ভালো করে দেখলে। পর্তুগিজ গভর্ণমেন্টের ফরেস্ট সার্ভের ম্যাপ, ১৮৭৩ সালের রয়েল মেরিন সার্ভের তৈরি উপকূলের ম্যাপ, ভ্রমণকারী স্যার ফিলিপো ডি ফিলিপির ম্যাপ, এ বাদে আলভারেজের হাতে আঁকা ও জিম কার্টারের সইযুক্ত একখানা জীর্ণ, বিবর্ণ খসড়া নক্সা। আলভারেজ বেঁচে থাকতে সে এই সব ম্যাপ ভালো করে বুঝতে একবারও চেষ্টা করেনি, এখন এই ম্যাপ বোঝার উপর তার জীবন-মরণ নির্ভর করছে। সলস্বেরির সোজা রাস্তা বার করতে হবে। এ স্থান থেকে তার অবস্থিতি বিন্দুর দিক নির্ণয় করতে হবে, রিখটারসভেল্ড অরণ্যের এ গোলকধাঁধা থেকে তাকে উদ্ধার পেতে হবে— সবই এই ম্যাপগুলির সাহায্যে।
অনেক দেখবার পর শঙ্কর বুঝতে পারলে এই অরণ্য ও পর্বতমালা সম্বন্ধে কোনো ম্যাপেই বিশেষ কিছুই দেওয়া নেই— এক আলভারেজ ও জিম কার্টারের খসড়া ম্যাপখানা ছাড়া। তাও সেগুলি এত সংক্ষিপ্ত এবং তাতে এত সাঙ্কেতিক ও গুপ্তচিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে যে শঙ্করের পক্ষে তা প্রায় দুর্বোধ্য। কারণ এদের সব সময়েই ভয় ছিল যে ম্যাপ অপরের হাতে পড়লে, পাছে আর কেউ এসে ওদের ধনে ভাগ বসায়।
চতুর্থ দিন শঙ্কর সে স্থান ত্যাগ করে আন্দাজমত পুব দিকে রওনা হল। যাবার আগে কিছু বনফুলের মালা গেঁথে আলভারেজের সমাধির ওপর অর্পণ করলে।
‘বুশ ক্র্যাফ্ট’ বলে একটা জিনিস আছে। সুবিস্তীর্ণ, বিজন, গহন অরণ্যানীর মধ্যে ভ্রমণ করবার সময় এ বিদ্যা জানা না থাকলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী। আলভারেজের সঙ্গে এতদিন ঘোরাঘুরি করবার ফলে, শঙ্কর কিছু কিছু ‘বুশ ক্র্যাফ্ট’ শিখে নিয়েছিল, তবুও তার মনে সন্দেহ হল যে, এই বন একা পাড়ি দেবার যোগ্যতা সে কি অর্জন করেছে? শুধু ভাগ্যের উপর নির্ভর করে তাকে চলতে হবে, ভাগ্য ভালো থাকলে বন পার হতে পারবে, ভাগ্য প্রসন্ন না হয়— মৃত্যু!
দুটো-তিনটে ছোট পাহাড় সে পার হয়ে চলল। বন কখনো গভীর, কখনো পাতলা। কিন্তু প্রকান্ড প্রকান্ড বনস্পতির আর শেষ নেই। শঙ্করের জানা ছিল যে, দীর্ঘ এলিফ্যান্ট ঘাসের জঙ্গল এলে বুঝতে হবে যে বনের প্রান্তসীমায় পৌঁছনো গিয়েছে। কারণ গভীর জঙ্গলে কখনো এলিফ্যান্ট বা টুসক ঘাস জন্মায় না। কিন্তু এলিফ্যান্ট ঘাসের চিহ্ন নেই কোনোদিকে— শুধু বনস্পতি আর নিচু বনঝোপ।
প্রথম দিন শেষ হল এক নিবিড়তর অরণ্যের মধ্যে। শঙ্কর জিনিসপত্র প্রায় সবই ফেলে দিয়ে এসেছিল, কেবল আলভারেজের ম্যানলিকার রাইফেলটা, অনেকগুলো টোটা, জলের বোতল, টর্চ, ম্যাপগুলো, কম্পাস, ঘড়ি, একখানা কম্বল ও সামান্য কিছু ঔষধ সঙ্গে নিয়েছিল— আর নিয়েছিল একটা দড়ির দোলনা। তাঁবুটা যদিও খুব হাল্কা ছিল, বয়ে আনা অসম্ভব বিবেচনায় ফেলেই এসেছে।
দুটো গাছের ডালে মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে সে দড়ির দোলনা টাঙাল এবং হিংস্র জন্তুর ভয়ে গাছতলায় আগুন জ্বাললে। দোলনায় শুয়ে বন্দুক হাতে জেগে রইল, কারণ ঘুম অসম্ভব। একে ভয়ানক মশা, তার উপর সন্ধ্যার পর থেকে গাছতলার কিছুদূর দিয়ে একটা চিতাবাঘ যাতায়াত শুরু করলে। গভীর অন্ধকারে তার চোখ জ্বলে যেন দুটো আগুনের ভাঁটা, শঙ্কর টর্চের আলো ফেললে পালিয়ে যায়, আবার আধঘন্টা পরে ঠিক সেইখানে দাঁড়িয়ে ওর দিকে চেয়ে থাকে। শঙ্করের ভয় হল, ঘুমিয়ে পড়লে হয়তোবা লাফ দিয়ে দোলনায় উঠে আক্রমণ করবে। চিতাবাঘ অতি ধূর্ত জানোয়ার। কাজেই সারারাত্রি শঙ্কর চোখের পাতা বোজাতে পারলে না। তার উপর চারধারে নানা বন্য জন্তুর রব। একবার একটু তন্দ্রা এসেছিল, হঠাৎ কাছেই কোথাও একদল বালক-বালিকার খিলখিল হাসির শব্দে তন্দ্রা ছুটে গিয়ে ও চমকে জেগে উঠল। ছেলে-মেয়েরা হাসে কোথায়? এই জনমানবহীন অরণ্যে বালক-বালিকাদের যাতায়াত করা বা এত রাত্রে হাস্য তো উচিত নয়। পরক্ষণেই তার মনে পড়ল একজাতীয় বেবুনের ডাক ঠিক ছেলেপুলের হাসির মতো শোনায়, আলভারেজ একবার গল্প করেছিল। ভোরবেলা সে গাছ থেকে নেমে রওনা হল। বৈমানিকরা যাকে বলেন ‘ফ্লাইং ব্লাইন্ড’— সে সেইভাবে বনের মধ্যে দিয়ে চলেছে, সম্পূর্ণ ভাগ্যের উপর নির্ভর করে, দু’চোখ বুজে। এই দু’দিন চলেই সে সম্পূর্ণভাবে দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েছে— আর তার উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম জ্ঞান নেই। সে বুঝলে কোনো মহারণ্যে দিক ঠিক রেখে চলা কি ভীষণ কঠিন ব্যাপার। তোমার চারপাশে সব সময়েই গাছের গুঁড়ি, অগণিত, অজস্র, তার লেখাজোখা নেই। তোমার মাথার উপর সব সময় ডালপালা লতাপাতার চন্দ্রাতপ। নক্ষত্র, চন্দ্র, সূর্য দৃষ্টিগোচর হয় না। সূর্যের আলোও কম, সব সময়েই যেন গোধূলি। ক্রোশের পর ক্রোশ যাও, ঐ একই ব্যাপার। কম্পাস এদিকে অকেজো, কি করেই বা দিক ঠিক রাখা যায়?
পঞ্চম দিনে একটা পাহাড়ের তলায় এসে সে বিশ্রামের জন্যে থামল। কাছেই একটা প্রকান্ড গুহার মুখ, একটা ক্ষীণ জলস্রোত গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে এঁকে বেঁকে বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়েছে।
অত বড় গুহা আগে কখনো না দেখবার দরুন কৌতূহলের বশবর্তী হয়েই সে জিনিসপত্র বাইরে রেখে গুহার মধ্যে ঢুকল। গুহার মুখে খানিকটা আলো— ভেতরে বড় অন্ধকার, টর্চ জ্বেলে সন্তর্পণে অগ্রসর হয়ে, সে ক্রমশঃ এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছুলো, যেখানে ডাইনে বাঁয়ে আরো দুটো মুখ। উপরের দিকে টর্চ উঠিয়ে দেখলে, ছাদটা অনেকটা উঁচু। সাদা শক্ত নুনের মতো ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের সরু মোটা ঝুরি ছাদ থেকে ঝাড় লন্ঠনের মতো ঝুলছে।
গুহার দেওয়ালগুলো ভিজে, গা বেয়ে অনেক জায়গায় জল খুব ক্ষীণধারায় ঝরে পড়ছে। শঙ্কর ডাইনের গুহায় ঢুকল, সেটা ঢুকবার সময় সরু কিন্তু ক্রমশঃ প্রশস্ত হয়ে গিয়েছে। পায়ে পাথর নয়, ভিজে মাটি। টর্চের আলোয় ওর মনে হল, গুহাটা ত্রিভূজাকৃতি। ত্রিভৃজের ভূমির এক কোণে আর একটা গুহামুখ। সেটা দিয়ে ঢুকে শঙ্কর দেখলে সে যেন দু’ধারে পাথরের উঁচু দেওয়ালওয়ালা একটা সংকীর্ণ গলির মধ্যে এসেছে। গলিটা আঁকাবাঁকা, একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে সাপের মতো এঁকে বেঁকে চলেছে, শঙ্কর অনেক দূর চলে গেল গলিটা ধরে।
ঘন্টা দুই এতে কাটল। তারপর সে ভাবলে, এবার ফেরা যাক। কিন্তু ফিরতে গিয়ে সে আর কিছুতেই সেই ত্রিভূজাকৃতি গুহাটা খুঁজে পেলে না। কেন, এই তো সেই গুহা থেকেই ওই সরু গুহাটা বেরিয়েছে, সরু গুহা তো শেষ হয়েই গেল— তবে সেই ত্রিভূজ গুহা কই?
অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরে শঙ্করের হঠাৎ কেমন আতঙ্ক উপস্থিত হল। সে গুহার মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেনি তো? সর্বনাশ!
সে বসে আতঙ্ক দূর করবার চেষ্টা করলে, ভাবলে— না, ভয় পেলে তার চলবে না। স্থিরবুদ্ধি ভিন্ন এ বিপদ থেকে উদ্ধারের উপায় নেই। মনে পড়ল, আলভারেজ তাকে বলে দিয়েছিল, অপরিচিত স্থানে বেশিদূর অগ্রসর হবার সময়ে পথের পাশে সে যেন কোনো চিহ্ন রেখে যায়, যাতে আবার সেই চিহ্ন ধরে ফিরতে পারে। কিন্তু এ উপদেশ সে ভুলে গিয়েছিল। এখন উপায়?
টর্চের আলো জ্বালতে তার আর ভরসা হচ্ছে না। যদি ব্যাটারি ফুরিয়ে যায়, তবে নিরুপায়। গুহার মধ্যে অন্ধকার সূচীভেদ্য। সেই দূর্নিরিক্ষ অন্ধকারে এক পা অগ্রসর হওয়া অসম্ভব। পথ খুঁজে বার করা তো দূরের কথা।
সারাদিন কেটে গেল— ঘড়িতে সন্ধ্যে সাতটা। এদিকে টর্চের আলো রাঙা হয়ে আসছে ক্রমশঃ। ভীষণ গুমোট গরম গুহার মধ্যে, তা ছাড়া পানীয় জল নেই। পাথরের দেওয়াল বেয়ে যে জল চুঁইয়ে পড়ছে, তার আস্বাদ— কষা, ক্ষার, ঈষৎ লোনা। তার পরিমাণও বেশি নয়। জিভ দিয়ে চেটে খেতে হয় দেওয়ালের গা থেকে।
বাইরে অন্ধকার হয়েছে নিশ্চয়ই, সাড়ে সাতটা বাজলো। আটটা, নটা, দশটা। তখনো শঙ্কর পথ হাতড়াচ্ছে। টর্চের পুরনো ব্যাটারি জ্বলছে সমানে বেলা তিনটে থেকে, এইবার তা এত ক্ষীণ হয়ে এসেছে যে, শঙ্কর ভয়ে আরও উন্মাদের মতো হয়ে উঠল। এই আলো যতক্ষণ, তার প্রাণের ভরসাও ততক্ষণ। নতুবা এই নরকের মতো মহা অন্ধকারে পথ খুঁজে পাবার কোনো আশা নেই— স্বয়ং আলভারেজও পারতো না।
টর্চ নিভিয়ে ও চুপ করে একখানা পাথরের উপর বসে রইল। এ থেকে উদ্ধার পাওয়া যেতে পারতো যদি আলো থাকতো, কিন্তু এই অন্ধকারে সে কি করে এখন? একবার ভাবলে, রাত্রিটা কাটুক না, দেখা যাবে তখন। পরক্ষণেই মনে হল— তাতে আর এমন কি সুবিধে হবে? এখানে তো দিনরাত্রি সমান।
অন্ধকারেই সে দেওয়াল ধরে ধরে চলতে লাগল। হায়, হায়, কেন গুহায় ঢুকবার সময়ে দুটো নতুন ব্যাটারী সঙ্গে নেয়নি। অন্ততঃ একটা দেশলাই।
ঘড়ি হিসেবে সকাল হল। গুহার চির অন্ধকারে কিন্তু আলো জ্বললো না। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় শঙ্করের শরীর অবসন্ন হয়ে আসছে। বোধ হয়, এই গুহার অন্ধকারে ওর সমাধি অদৃষ্টে লেখা আছে, দিনের আলো আর তাকে দেখতে হবে না।
আলভারেজের বলি গ্রহণ করে আফ্রিকার রক্ততৃষ্ণা মেটেনি, তাকেও চাই।
তিন দিন তিন রাত্রি কেটে গেল। শঙ্কর জুতোর সুকতলা চিবিয়ে খেয়েছে, একটা আরশোলা কি ইঁদুর, কি কাঁকড়াবিছে— গুহার মধ্যে কোনো জীব নেই যে সে ধরে খায়। মাথা ক্রমশঃ অপ্রকৃতিস্থ হয়ে আসছে, তার জ্ঞান নেই সে কি করছে বা তার কি ঘটবে— কেবল এইটুকু মাত্র জ্ঞান রয়েছে যে তাকে গুহা থেকে যে করে হোক বেরুতেই হবে, দিনের আলোর মুখ দেখতেই হবে। তাই সে অবসন্ন নির্জীব দেহেও অন্ধকার হাতড়ে হাতড়েই বেড়াচ্ছে, হয়তো মরণের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এইরকম ভাবে হাতড়াবে।
একবার সে অবসন্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। কতক্ষণ পরে সে জেগে উঠল তা সে জানে না। দিন, রাত্রি, ঘন্টা, ঘড়ি, দন্ড, পল মুছে গিয়েছে এই ঘোর অন্ধকারে। হয়তোবা তার চোখ দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েছে, কে জানে?
ঘুমোবার পর সে যেন একটু বল পেল। আবার উঠল, আবার চলল, আলভারেজের শিষ্য সে, নিশ্চেষ্টভাবে হাত-পা কোলে করে বসে কখনোই মরবে না। সে পথ খুঁজবে, খুঁজবে যতক্ষণ বেঁচে আছে…
আশ্চর্য, সে নদীটাই বা গেল কোথায়? গুহার মধ্যে গোলকধাঁধায় ঘুরবার সময় জলধারাটাকে সে কোথায় হারিয়ে ফেলেছে। নদী দেখতে পেলে হয়তো উদ্ধার পাওয়াও যেতে পারে, কারণ তার এক মুখ যেদিকেই থাক, অন্য মুখ আছে গুহার বাইরে। কিন্তু নদী তো দূরের কথা একটা অতি ক্ষীণ জলধারার সঙ্গেও আজ তিন দিন পরিচয় নেই। জল অভাবে শঙ্কর মরতে বসেছে। কষা, লোনা, বিস্বাদ জল চেটে-চেটে তার জিভ ফুলে উঠেছে, তৃষ্ণা তাতে বেড়েছে ছাড়া কমেনি।
পাথরের দেওয়াল হাতড়ে শঙ্কর খুঁজতে লাগল, ভিজে দেওয়ালের গায়ে কোথাও শেওলা জন্মেছে কিনা— খেয়ে প্রাণ বাঁচাবে। না, তাও নেই! পাথরের দেওয়াল সর্বত্র অনাবৃত, মাঝে মাঝে ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের পাতলা সর পড়েছে, একটা ব্যাঙের ছাতা কি শেওলা জাতীয় উদ্ভিদও নেই। সূর্যের আলোর অভাবে উদ্ভিদ এখানে বাঁচতে পারে না।
আরও একদিন কেটে রাত এল। এত ঘোরাঘুরি করেও কিছু সুবিধে হচ্ছে বলে তো বোধ হয় না। ওর মনে হতাশা ঘনিয়ে এসেছে। সে কি আরও চলবে, কতক্ষণ চলবে? এতে কোনো ফল নেই, এ চলার শেষ নেই। কোথায় সে চলেছে এই গাঢ় নিকষ কালো অন্ধকারে এই ভয়ানক নিস্তব্ধতার মধ্যে! উঃ, কি ভয়ানক অন্ধকার, আর কি ভয়ানক নিস্তব্ধতা! পৃথিবী যেন মরে গিয়েছে, সৃষ্টিশেষের প্রলয়ে সোমসূর্য নিভে গিয়েছে, সেই মৃত পৃথিবীর জনহীন, শব্দহীন, সময়হীন শ্মশানে সে-ই একমাত্র প্রাণী বেঁচে আছে।
আর বেশিক্ষণ এ-রকম থাকলে সে ঠিক পাগল হয়ে যাবে।
১১. চাঁদের পাহাড় – একাদশ পরিচ্ছেদ
শঙ্কর একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল বোধ হয়, কিংবা হয়তো অজ্ঞান হয়েই পড়ে থাকবে। মোটের উপর যখন আবার জ্ঞান ফিরে এল তখন ঘড়িতে বারোটা— সম্ভবতঃ রাত বারোটাই হবে। ও উঠে আবার চলতে শুরু করলে। এক জায়গায় তার সামনে একটা পাথরের দেওয়াল পড়ল— তার রাস্তা যেন আটকে রেখেছে। টর্চের রাঙা আলো একটিবার মাত্র জ্বালিয়ে সে দেখল যে দেওয়াল ধরে সে এতক্ষণ যাচ্ছিল, তারই সঙ্গে সমকোণ করে এ দেওয়ালটা আড়াআড়ি ভাবে তার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে।
হঠাৎ সে কান খাড়া করলে… অন্ধকারের মধ্যে কোথায় যেন ক্ষীণ জলের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না…?
হ্যাঁ, ঠিক জলের শব্দই বটে, …কুলু-কুলু, কুলু-কুলু… ঝরনা ধারার শব্দ— যেন পাথরের নুড়ির ওপর দিয়ে মাঝে মাঝে বেধে জল বইছে কোথাও। ভালো করে শুনে ওর মনে হল, জলের শব্দটা হচ্ছে এই পাথরের দেওয়ালের ওপারে। দেওয়ালে কান পেতে শুনে ওর ধারণা আরও বদ্ধমূল হল। দেওয়াল ফুঁড়ে যাবার উপযুক্ত ফাঁক আছে কিনা, টর্চের রাঙা আলোয় অনুসন্ধান করতে করতে এক জায়গায় খুব নিচু ও সংকীর্ণ প্রাকৃতিক রন্ধ্র দেখতে পেলে। সেখান দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে অনেকটা গিয়ে হাতে জল ঠেকল। সন্তর্পণে উপরের দিকে হাত দিয়ে বুঝল, সেখানটাতে দাঁড়ানো যেতে পারে। দাঁড়িয়ে উঠে ঘন অন্ধকারের মধ্যে কয়েক পা যেতেই, স্রোতযুক্ত বরফের মতো ঠান্ডা জলে পায়ের পাতা ডুবে গেল…
ঘন অন্ধকারের মধ্যেই নিচু হয়ে ও প্রাণ ভরে ঠান্ডা জল পান করে নিলে। তারপর টর্চের ক্ষীণ আলোয় জলের স্রোতের গতি লক্ষ্য করলে। এ ধরনের নির্ঝরের স্রোতের উজানের দিকে গুহার মুখ সাধারণতঃ হয় না। টর্চ নিভিয়ে সেই মহা নিবিড় অন্ধকারে পায়ে পায়ে জলের ধারা অনুভব করতে করতে অনেকক্ষণ ধরে চললো। নির্ঝর চলেছে এঁকে বেঁকে, কখনো ডাইনে কখনো বাঁয়ে। এক জায়গায় সেটা তিন-চারটে ছোট বড় ধারায় বিভক্ত হয়ে গিয়ে এদিক ওদিক চলে গিয়েছে, ওর মনে হল।
এখানে এসে শঙ্কর দিশেহারা হয়ে পড়ল। টর্চ জ্বেলে দেখল স্রোত নানামুখী। আলভারেজের কথা মনে পড়ল, পথে চিহ্ন রেখে না গেলে, এখানে আবার গোল পাকিয়ে যাবার সম্ভাবনা।
নিচু হয়ে চিহ্ন রেখে যাওয়ার উপযোগী কিছু খুঁজতে গিয়ে দেখলে, স্বচ্ছ নির্মল জলাধারের এপারে ওপারে দু’পারেই এক ধরনের পাথরের নুড়ি বিস্তর পড়ে আছে। সেই ধরনের পাথরের নুড়ির ওপর দিয়েও প্রধান জলধারা বয়ে চলেছে।
অনেকগুলি নুড়ি পকেটে নিয়ে, সে প্রত্যেক শাখা শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা করবে ভেবে, দুটো নুড়ি ধারার পাশে রাখতে রাখতে গেল। একটা স্রোত থেকে খানিকদূর গিয়ে আবার অনেকগুলো ফেক্ড়ি বেরিয়েছে। প্রত্যেক সংযোগস্থলে ও নুড়ি সাজিয়ে একটা ‘S’ অক্ষর তৈরি করে রাখলে।
অনেকগুলো স্রোতশাখা আবার ঘুরে শঙ্কর যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকেই যেন ঘুরে গেল। পথে চিহ্ন রেখে গিয়েও শঙ্করের মাথা গোলমাল হয়ে যাবার যোগাড় হল।
একবার তার পায়ে খুব ঠান্ডা কি ঠেকতেই, আলো জ্বেলে দেখলে, জলের ধারে এক প্রকান্ডকায় অজগর পাইথন কুন্ডলী পাকিয়ে আছে। পাইথন ওর স্পর্শে আলস্য পরিত্যাগ করে মাথাটা উঠিয়ে কড়ির দানার মতো চোখে চাইতেই টর্চের আলোয় দিশেহারা হয়ে গেল— নতুবা শঙ্করের প্রাণ সংশয় হয়ে উঠতো। শঙ্কর জানে অজগর সাপ অতি ভয়ানক জন্তু— বাঘ সিংহের মুখ থেকেও হয়তো পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে, অজগর সাপের নাগপাশ থেকে উদ্ধার পাওয়া অসম্ভব। একটি বার লেজ ছুঁড়ে পা জড়িয়ে ধরলে আর দেখতে হত না।
এবার অন্ধকারে চলতে ওর ভয়ানক ভয় করছিল। কি জানি, কোথায় আবার কোন পাইথন সাপ কুন্ডলী পাকিয়ে আছে! দুটো-তিনটে স্রোতশাখা পরীক্ষা করে দেখবার পরে ও তার নিজের চিহ্নের সাহায্যে পুনরায় সংযোগস্থলে ফিরে এল। প্রধান সংযোগস্থলে ও নুড়ি দিয়ে একটি ক্রুশচিহ্ন করে রেখে গিয়েছিল। এবার ওরই মধ্যে যেটাকে প্রধান বলে মনে হল, সেটা ধরে চলতে গিয়ে দেখলে, সেও সোজামুখে যায়নি। কিছুদূর গিয়েই তারও নানা ফেক্ড়ি বেরিয়েছে। এক-এক জায়গায় গুহার ছাদ এত নিচু হয়ে নেমে এসেছে যে কুঁজো হয়ে, কোথাওবা মাজা দুমড়ে, অশীতিপর বৃদ্ধের ভঙ্গিতে চলতে হয়।
হঠাৎ এক জায়গায় টর্চ জ্বেলে সেই অতি ক্ষীণ আলোতেও শঙ্কর বুঝতে পারলে, গুহাটা সেখানে ত্রিভূজাকৃতি— সেই ত্রিভূজ গুহা, যাকে খুঁজে বার না করতে পেরে মৃত্যুর দ্বার পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। একটু পরেই দেখলে বহুদূরে যেন অন্ধকারের ফ্রেমে আঁটা কয়েকটি নক্ষত্র জ্বলছে। গুহার মুখ! এবার আর ভয় নেই। এ-যাত্রার মতো সে বেঁচে গেল।
শঙ্কর যখন বাইরে এসে দাঁড়াল, তখন রাত তিনটে। সেখানটায় গাছপালা কিছু কম, মাথার উপর নক্ষত্রভরা আকাশ দেখা যায়। গুহার সেই মহা অন্ধকার থেকে বার হয়ে এসে রাত্রির নক্ষত্রালোকিত স্বচ্ছ অন্ধকার তার কাছে দীপালোকখচিত নগরপথের মতো মনে হল। প্রাণভরে সে ভগবানকে ধন্যবাদ দিল, এ অপ্রত্যাশিত মুক্তির জন্যে।
ভোর হল। সূর্যের আলো গাছের ডালে ফুটলো। শঙ্কর ভাবলে এ অমঙ্গলজনক স্থানে আর একদন্ডও সে থাকবে না। পকেটে একখানা পাথরের নুড়ি তখনো ছিল, ফেলে না দিয়ে গুহার বিপদের স্মারক স্বরূপ সেখানা সে কাছে রেখে দিলে।
পরদিন এলিফ্যান্ট ঘাস দেখা গেল বনের মধ্যে, সেদিনই সন্ধ্যার আগে অরণ্য শেষ হয়ে খোলা জায়গা দেখা দিল। রাত্রে শঙ্কর অনেকক্ষণ বসে ম্যাপ দেখলে। সামনে যে মুক্ত প্রান্তরবৎ দেশ পড়ল, এখান থেকে এটা প্রায় তিনশো মাইল বিস্তৃত, একেবারে জাম্বেসি নদীর তীর পর্যন্ত। এই তিনশো মাইলের খানিকটা পড়েছে বিখ্যাত কালাহারি মরুভূমির মধ্যে, প্রায় ১৭৫ মাইল, অতি ভীষণ, জনমানবহীন, জলহীন, পথহীন মরুভূমি। আলভারেজ মিলিটারি ম্যাপ থেকে নোট করেছে যে, এই অঞ্চলের উত্তর-পূর্ব কোণ লক্ষ্য করে একটি বিশেষ পথ ধরে না গেলে, মাঝামাঝি পার হতে যাওয়ার মানেই মৃত্যু। ম্যাপে এর নাম দিয়েছে ‘তৃষ্ণার দেশ’ (Thirstland Trek)! রোডেসিয়া পৌঁছুতে পারলে যাওয়া অনেকটা সহজ হয়ে উঠবে, কারণ সে-সব স্থানে মানুষ আছে।
শঙ্কর এখানে অত্যন্ত সাহসের পরিচয় দিলে। পথের এই ভয়ানক অবস্থা জেনে-শুনেও সে দমে গেল না, হাত-পা হারা হয়ে পড়ল না। এই পথে আলভারেজ একা গিয়ে সলস্বেরি থেকে টোটা ও খাবার কিনে আনবে বলেছিল। বাষট্টি বছরের বৃদ্ধ যা পারবে বলে স্থির করেছিল, সে তা থেকে পিছিয়ে যাবে?
কিন্তু সাহস ও নির্ভীকতা এক জিনিস, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। ম্যাপ দেখে গন্তব্যস্থানের দিক নির্ণয় করার ক্ষমতা শঙ্করের ছিল না। সে দেখলে ম্যাপের সে কিছুই বোঝে না। মিলিটারি ম্যাপগুলোতে দুটো মরুমধ্যস্থ কূপের জায়গায় ল্যাটিচিউড লঙ্গিচিউড দেওয়া আছে, ‘ম্যাগনেটিক নর্থ’ আর ‘ট্রু নর্থ’ ঘটিত কি একটা গোলমেলে অঙ্ক কষে বার করতো আলভারেজ, শঙ্কর দেখেছে কিন্তু শিখে নেয়নি।
সুতরাং অদৃষ্টের উপর নির্ভর করা ছাড়া আর উপায় কি? অদৃষ্টের উপর নির্ভর করেই শঙ্কর এই দুস্তর মরুভূমিতে পাড়ি দিতে প্রস্তুত হল। ফলে, দু’দিন যেতে না যেতেই শঙ্কর সম্পূর্ণ দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ল। ম্যাপ দেখে যেকোন অভিজ্ঞ লোক যে জলাশয় চোখ বুজে বার করতে পারতো— শঙ্কর তার তিন মাইল উত্তর দিয়ে চলে গেল, অথচ তখন তার জল ফুরিয়ে এসেছে, নতুন পানীয় জল সংগ্রহ করে না নিলে জীবন বিপন্ন হবে।
প্রথমতঃ শুধু প্রান্তর আর পাহাড়, ক্যাকটাস ও ইউফোর্বিয়ার বন, মাঝে মাঝে গ্রানাইটের স্তূপ। তার পর কী ভীষণ কষ্টের সে পথ-চলা! খাবার নেই, জল নেই, পথ ঠিক নেই, মানুষের মুখ দেখা নেই। দিনের পর দিন শুধু সুদূর, শূন্য দিগ্বলয় লক্ষ্য করে সে হতাশ পথ-যাত্রা। মাথার উপর আগুনের মতো সূর্য, পায়ের নিচে বালি পাথর যেন জ্বলন্ত অঙ্গার। সূর্য উঠছে— অস্ত যাচ্ছে, নক্ষত্র উঠছে, চাঁদ উঠছে— আবার অস্ত যাচ্ছে। মরুভূমির গিরগিটি একঘেয়ে সুরে ডাকছে, ঝিঁঝি ডাকছে— সন্ধ্যায়, গভীর রাত্রে।
মাইল-লেখা পাথর নেই, কত মাইল অতিক্রম করা হল তার হিসেব নেই। খাদ্য দু-একটা পাখি, কখনোবা মরুভূমির বাজার্ড শকুনি, যার মাংস জঠুর ও বিস্বাদ। এমন-কি একদিন একটা পাহাড়ী বিষাক্ত কাঁকড়াবিছে, যার দংশনে মৃত্যু— তাও যেন পরম সুখাদ্য, মিললে মহা সৌভাগ্য।
দু’দিন ঘোর তৃষ্ণায় কষ্ট পাবার পরে পাহাড়ের ফাটলে একটা জলাশয় পাওয়া গেল। কিন্তু জলের চেহারা লাল, কতকগুলো কি পোকা ভাসছে জলে, ডাঙায় কি একটা জন্তু মরে পচে ঢোল হয়ে আছে। সেই জলই আকন্ঠ পান করে শঙ্কর প্রাণ বাঁচালে।
দিনের পর দিন কাটছে, মাস গেল, কি সপ্তাহ গেল, কি বছর গেল হিসেব নেই। শঙ্কর শুকিয়ে রোগা হয়ে গিয়েছে, কোথায় চলেছে তার কিছুই ঠিক নেই— শুধু সামনের দিকে যেতে হবে এই সে জানে। সামনের দিকেই ভারতবর্ষ— বাঙলা দেশ।
তারপর পড়ল আসল মরু, কালাহারি মরুভূমির এক অংশ। দূর থেকে তার চেহারা দেখে শঙ্কর ভয়ে শিউরে উঠল। মানুষ কি করে পার হতে পারে এই অগ্নিদগ্ধ প্রান্তর! শুধুই বালির পাহাড়, আর তাম্রাভ কটা বালির সমুদ্র। ধূ-ধূ করে যেন জ্বলছে দুপুরের রোদে। মরুভূমির কিনারে প্রথম দিনেই ছায়ায় ১২৭ ডিগ্রী উত্তাপ উঠল থার্মোমিটারে।
ম্যাপে বার বার লিখে দিয়েছে, উত্তর-পূর্ব কোণ ঘেঁষে ছাড়া কেউ এই মরুভূমি মাঝামাঝি পার হতে যাবে না। গেলেই মৃত্যু, কারণ সেখানে জল একদম নেই। জল যে উত্তর-পূর্ব ধারে আছে তাও নয়, তবে ত্রিশ মাইল, সত্তর মাইল ও নব্বুই মাইল ব্যবধানে তিনটি স্বাভাবিক উনুই আছে— যাতে জল পাওয়া যায়। ঐ উনুইগুলি প্রায়ই পাহাড়ের ফাটলে, খুঁজে বার করা বড়ই কঠিন। এই জন্যেই মিলিটারি ম্যাপে ওদের জায়গার অক্ষ ও দ্রাঘিমা দেওয়া আছে।
শঙ্কর ভাবলে, ওসব বার করতে পারবো না। সেক্সট্যান্ট আছে, নক্ষত্রের চার্ট আছে, কিন্তু তাদের ব্যবহার সে জানে না। যা হয় হবে, ভগবান ভরসা। তবে যতদূর সম্ভব উত্তর-পূর্ব কোণ ঘেঁষে যাবার চেষ্টা সে করবে।
তৃতীয় দিনে নিতান্ত দৈববলে সে একটা উনুই দেখতে পেল। জল কাদাগোলা, আগুনের মতো গরম, কিন্তু তাই তখন অমৃতের মতো দুর্লভ। মরুভূমি ক্রমে ঘোরতর হয়ে উঠল। কোনো প্রকার জীবের বা উদ্ভিদের চিহ্ন ক্রমশঃ লুপ্ত হয়ে গেল। আগে রাত্রে আলো জ্বাললে দু-একটা কীটপতঙ্গ আকৃষ্ট হয়ে আসতো, ক্রমে তাও আর আসে না।
দিনে উত্তাপ যেমন ভীষণ, রাতে তেমনি শীত। শেষ রাত্রে শীতে হাত-পা জমে যায় এমন অবস্থা, অথচ ক্রমশঃ আগুন জ্বালবার উপায় শেষ হয়ে গেল, কারণ জ্বালানি কাঠ আর একেবারেই নেই। কয়েক দিনের মধ্যে সঞ্চিত জলও গেল ফুরিয়ে। সেই সুবিস্তীর্ণ বালুকাসমুদ্রে, একটি পরিচিত বালুকণা খুঁজে বার করা যতদূর অসম্ভব, তার চেয়েও অসম্ভব ক্ষুদ্র হাত-দুই পরিধির এক জলের উনুই বার করা।
সেদিন সন্ধ্যার সময় তৃষ্ণার কষ্টে শঙ্কর উন্মত্তপ্রায় হয়ে উঠল। এতক্ষণে শঙ্কর বুঝেছে, এ ভীষণ মরুভূমি একা পার হওয়ার চেষ্টা করা আত্মহত্যার শামিল। সে এমন জায়গায় এসে পড়েছে, যেখান থেকে ফেরবার উপায়ও নেই।
একটা উঁচু বালিয়াড়ির উপর উঠে সে দেখলে, চারধারে শুধুই কটা বালির পাহাড়, পূর্বদিকে ক্রমশঃ উঁচু হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমে সূর্য ডুবে গেলেও সারা আকাশ সূর্যাস্তের আভায় লাল। কিছুদূরে একটা ছোট ঢিবির মতো পাহাড় এবং দূর থেকে মনে হল একটা গুহাও আছে। এ ধরনের গ্রানাইটের ছোট ঢিবি এদেশে সর্বত্র, ট্রান্সভাল ও রোডেসিয়ায় এদের নাম ‘Kopje’ অর্থাত্ ক্ষুদ্র পাহাড়। রাত্রে শীতের হাত থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে শঙ্কর সেই গুহায় আশ্রয় নিলে।
এইখানে এক ব্যাপার ঘটল।
১২. চাঁদের পাহাড় – দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
গুহার মধ্যে ঢুকে শঙ্কর টর্চ জ্বেলে দেখলে (নতুন ব্যাটারী তার কাছে তখনো ডজন দুই ছিল) গুহাটা ছোট, বেশ একটা ছোটখাটো ঘরের মতো, মেঝেটাতে অসংখ্য ছোট ছোট পাথর ছড়ানো। গুহার এক কোণে চোখ পড়তেই শঙ্কর অবাক হয়ে গেল। একটা ছোট্ট কাঠের পিঁপে! এখানে কি করে এল কাঠের পিঁপে?
দু-পা এগিয়েই সে চমকে উঠল।
গুহার দেয়ালের ধার ঘেঁষে শায়িত অবস্থায় একটা সাদা নরকঙ্কাল, তার মুন্ডুটা দেয়ালের দিকে ফেরানো। কঙ্কালের আশেপাশে কালো কালো থলে ছেঁড়ার মতো জিনিস, বোধহয় সেগুলো পশমের কোটের অংশ। দু’খানা বুট জুতো কঙ্কালের পায়ে তখনো লাগানো। একপাশে একটা মরচে পড়া বন্দুক।
পিঁপেটার পাশে একটা ছিপি-আঁটা বোতল। বোতলের মধ্যে একখানা কাগজ, ছিপিটা খুলে কাগজখানা বার করে দেখলে, তাতে ইংরেজীতে কি লেখা আছে।
পিঁপেটাতে কি আছে দেখবার জন্যে যেমনি সে সেটা নাড়াতে গিয়েছে, অমনি পিঁপের নিচ থেকে একটা ফোঁস ফোঁস শব্দ শুনে ওর শরীরের রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেল। নিমেষের মধ্যে একটা প্রকান্ড সাপ মাটি থেকে হাত তিনেক উঁচু হয়ে ঠেলে উঠল। বোধ হয় ছোবল মারবার আগে সাপটা এক সেকেন্ড দেরি করেছিল। সেই এক সেকেন্ড দেরি করার জন্যে শঙ্করের প্রাণ রক্ষা হল। পরমুহূর্তেই শঙ্করের ৪৫ অটোম্যাটিক কোল্ট গর্জন করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে অতবড় ভীষণ বিষধর স্যান্ড ভাইপারের মাথাটা ছিন্নভিন্ন হয়ে, রক্ত মাংস খানিকটা পিঁপের গায়ে, খানিকটা পাথরের দেওয়ালে ছিটকে লাগল। আলভারেজ ওকে শিখিয়েছিল, পথে সর্বদা হাতিয়ার তৈরি রাখবে। এ উপদেশ কতবার তার প্রাণ বাঁচিয়েছে।
অদ্ভুত পরিত্রাণ! সব দিক থেকেই। পিঁপেটা পরীক্ষা করে দেখা গেল সেটাতে অল্প একটু জল তখনো আছে। খুব কালো শিউ গোলার মতো রং বটে, তবুও জল। ছোট পিঁপেটা উঁচু করে তুলে পিঁপের ছিপি খুলে ঢক্ঢক্ করে শঙ্কর সেই দুর্গন্ধ কালো কালির মতো জল আকন্ঠ পান করলে। তারপর সে টর্চের আলোতে সাপটা পরীক্ষা করলে। পুরো পাঁচ হাত লম্বা সাপটা, মোটাও বেশ। এ ধরনের সাপ মরুভূমির বালির মধ্যে শরীর লুকিয়ে শুধু মুন্ডুটা উপরে তুলে থাকে— অতি মারাত্মক রকমের বিষাক্ত সাপ!
এইবার বোতলের মধ্যের কাগজখানা খুলে মন দিয়ে পড়লে। যে ছোট্ট পেন্সিল দিয়ে এটা লেখা হয়েছে— বোতলের মধ্যে সেটাও পাওয়া গেল। কাগজখানাতে লেখা আছে…