কাওড়াপাড়া থেকে ফিরে আসতে আধ ঘণ্টার বেশী লাগল। মোহিনী বুড়ীকে চার আনা পয়সা দিয়ে রাত্রে হিরণদের বাড়িতে শোবার জন্য রাজী করিয়ে এলুম। ফিরে এসে দেখি দালানের চৌকাঠে বসে হিরন্ময়ী হাপুস নয়নে কাঁদছে। অনেক করে বোঝালুম। বড় কষ্ট হল ওকে এ অবস্থায় দেখে। বললে–মার আর দিদির কি হবে মাস্টার মশায়? আপনি কালই বাবাকে একটা চিঠি লিখে দিন। ওদের ফাঁসি হবে না তো?
হেসে সান্ত্বনা দিলাম। বললাম- রাঁধ হিরণ। খাওয়াদাওয়া কর। কিছু ভেবো না– আমি কাল রাণাঘাট যাব। ভাল উকীল দিয়ে জামিনে খালাস করে নিয়ে আসবার চেষ্টা করব, ভয় কি?
হিরণ কিছুতেই রাঁধতে চায় না–শেষে বললে–আপনিও এখানে খাবেন কিন্তু। ঠিক তো?
ও রাঁধছে ব’সে, আমাকে রান্নাঘরেই বসে থাকতে হল–ও যেতে দেয় না, ছেলেমানুষ, ভয় করে। কেবল জিজ্ঞেস করে, মা আর দিদির কি হবে!
রান্না হয়ে গেল, ঠাঁই করে আমায় ভাত বেড়ে দিল। এদিকে হিরণ বড় অগোছালো, কুটনো-বাটনা, এঁটো-কাঁটা, ভাতের ফেন, আনাজের খোসাতে রান্নাঘর এমন নোংরা করে তুলেছে! ভাত বাড়তে গিয়ে উনুনের পাড়ে আঁচল লুটিয়ে পড়েছে–নিতান্ত আনাড়ি।
বললাম–দিনমানে কোনরকমে একা থেকো। আমি সন্ধ্যের আগেই রাণাঘাট থেকে ফিরবো। রেঁধে খেও কিন্তু। না হলে বড় রাগ করব।
মোহিনী কাওরাণী এল রাত ন’টার পরে। তার পরে আমি আমার বাসায় চলে এলুম। পরদিন রাণাঘাটে গিয়ে দেখি কেস ওঠে নি আদালতে। উকীল ঠিক করে তার সঙ্গে জামিনের কথাবার্তা বলে এলুম। ফিরবার সময় হিরন্ময়ীর জন্যে দু-একটা জিনিস কিনে নিলুম ওকে একটু আনন্দ দেবার জন্যে। ফিরে দেখি ও ব’সে ব’সে আবার কাঁদছে কালকের মত। সারাদিন বোধ হয় রাঁধে নি, কিছু খায় নি। স্নানও করে নি, দু-এক গাছা রুক্ষ চুল মুখের আশেপাশে উড়ছে। মহা বিপদে পড়ে গেলুম ওকে নিয়ে। কি করি এখন? ওর বাবাকে আজ রাণাঘাটে পৌঁছেই টেলিগ্রাম করেছি, যদি তা পেয়ে থাকেন, তবে কাল তিনি এসে পৌঁছলেও তো বাঁচি। নইলে হিরন্ময়ীকে ভাবছি কালীগঞ্জে বৌদিদির কাছে রেখে আসব। কারণ, এসে শুনলুম মোহিনী বুড়ী ব’লে গিয়েছে সে রাত্রে এখানে আর শুতে আসতে পারবে না।
ও আমায় দেখেই ছুটে এসে বললে–মাকে দিদিকে দেখে এলেন মাস্টারমশাই? তারা কেমন আছে? খালাস পেলে না?
আমি ওদের নিজে দেখতে যাই নি, উকীলের মুখে হিরন্ময়ীর সংবাদ পাঠিয়ে বলেছিলুম হিরন্ময়ীর জন্যে যেন তারা কিছু না ভাবে। বললাম সেকথা।
তার পর হিরন্ময়ী আমাকে বালতি ক’রে জল তুলে দিলে স্নানের জন্যে–ঘরে প্রদীপ জ্বেলে উনুন ধরিয়ে চায়ের জল চড়ালে। রাণাঘাট থেকে ওর জন্যে কিছু খাবার এনেছিলুম, তার বেশী অর্ধেক আমায় রেকাবিতে ক’রে চায়ের সঙ্গে জোর করে খাওয়ালে–তার পর রান্না চাপিয়ে দিলে। ওর মনে সুখ নেই, কেমন যেন মুষড়ে পড়েছে, ছেলেমানুষ, নইলে ওর মত হাস্যময়ী আনন্দময়ী চঞ্চলা মেয়ে এতক্ষণ কত কথা বলত, হাসি-খুশীতে ঘর ভরিয়ে তুলত।
একবার জিজ্ঞেস করলে–রাণাঘাটে নাকি সার্কাস এসেছে সবাই বলে? দেখেছেন আপনি? এত দুঃখের মধ্যেও ওর ছেলেমানুষি মন সার্কাসের সম্বন্ধে কৌতূহলী না হয়ে পারে নি ভেবে আমার হাসি পেল।
এ রাত্রে মোহিনী বুড়ী এল না–আমি ওকে ঘরের মধ্যে রেখে বাইরের বারান্দাতে শুয়ে রইলাম। বারান্দায় বিছানা পাতছি, ও আবার এত সরলা, নিষ্কলুষ–আমায় অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে, আপনি বাইরে শোবেন কেন?
কোন নীতিবাদের সঙ্কোচ এনে ফেলে ওর নিষ্পাপ মনে দাগ দিতে আমার বাধল। বললাম–দেখছ না কি রকম গরম আজ? বাইরে শোওয়াই আমার অভ্যেস, তা ছাড়া–
সারারাত দু-জনে গল্প করে কাটালুম। ও ঘর থেকে কথা বলে, আমি বারান্দা থেকে তার উত্তর দিই।–বাবা বোধ হয় কাল আসবেন, না? মা, দিদি কবে আসবে? সার্কাসওয়ালা কোথায় তাঁবু ফেলেছে? কলকাতায় কখনও যাই নি–একবার যাবার ইচ্ছে আচ্ছে। কলকাতার থিয়েটার দেখতে কেমন? চৌধুরীরা বোধ হয় মোহিনী বুড়ীকে বারণ করে দিয়েছে এখানে আসতে। আমার শীত করছে কিনা। রাত বেশী, ঠাণ্ডা পড়েছে, গায়ে দেবার একটা মোটা চাদর দেবো? আরব্য-উপন্যাসের মত গল্প আর নেই। আচ্ছা, অঙ্ক কতদূর শেখা যায়? বিদ্যার শেষ নেই–না? এম-এ পাস করে আরও পড়া যায়, পড়বার আছে?
ওর বাবা এলেন পরদিন সকাল দশটার সময়। তাঁর মুখে শুনলুম পুলিস থেকে তাঁকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে শীঘ্র বাড়ি এসে মেয়ের ভার নিতে। তিনি অত্যন্ত বদমেজাজী লোক, দু-একটা কথা শুনেই বুঝতে দেরি হ’ল না। আমার ওপর আদৌ তিনি প্রসন্ন হতে পারলেন না–তাঁর মেয়ের তত্বাবধান করার জন্যে একটা ধন্যবাদ দেওয়া তো দূরের কথা, সেটাকেই তিনি আমার একটা অপরাধ বলে গণ্য করে নিলেন এবং যে মুখুয্যে ও চৌধুরীরা পরশু সন্ধ্যেবেলা হিরন্ময়ীকে বাড়িতে জায়গা দিতে চায় নি, তাদেরই বাড়িতে খোশামোদ করে তাদের সঙ্গে এ বিপদে পরামর্শ চাইতে গেলেন।
আরও একটা ব্যাপার দেখলুম, তিনি হিরন্ময়ীকে আদৌ দেখতে পারে না। আমার সামনেই তো তাকে তাড়না, তর্জন-গর্জন যথেষ্ট করলেন এ নিয়ে যে সে রাত্রে চৌধুরী গিন্নীর পায়ে পড়ে কেন অনুরোধ করে নি তাকে জায়গা দেবার জন্যে। কারণ, তারা দেখলুম লাগিয়েছে যে তাদের কি আর ইচ্ছে ছিল না ওকে জায়গা দেবার? ও মেয়ের তা ইচ্ছে নয়। হিরণের অপরাধ সে মুখ ফুটে কারও কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে নি। এ ওরা কেউ বুঝল না যে হিরণের বয়সের মেয়েরা মুখে কোন নাটুকে-ধরনের কথা বলে আশ্রয় চাইতে পারে না পরের কাছে–বিশেষ করে হিরন্ময়ীর মত একটু তেজী মেয়েরা।