একদিন দুপুরের পরে হিরন্ময়ীদের বাড়িতে পুলিস এসেছে শুনলাম। পুলিশ কিসের? একে ওকে জিজ্ঞেস করি কেউ সঠিক উত্তর দেয় না অথচ মনে হ’ল ব্যাপারটা সবাই জানে। এগিয়ে গেলুম–ওদের বাড়ির সামনের তেঁতুলতলায় বড় দারোগা চেয়ার পেতে ব’সে–পাড়ার লোকদের সাক্ষ্য নেওয়া চলেছে। দেখলাম গ্রামে ওদের মিত্র বড় কেউ নেই। আমি আগেও যে একথা না জানতাম এমন নয়–তবে পাড়াগাঁয়ের কানাঘুষোতে কান দিই নি।
বিকেলের দিকে হিরন্ময়ীর মা আর বিধবা দিদিকে থানায় ধরে নিয়ে গেল। কাছারির মুহুরী সাতকড়ি মুখুয্যে আমার কাছেই দাঁড়িয়েছিল। সে বলতে–ও মেয়েটার তত দোষ দিই নে–মা-ই যত নষ্টের গুরুমশাই। ওই তো ওকে শিখিয়েছে। নইলে মেয়েটার সাধ্যি কি,–কিন্তু মাগী কি ডাকাত! মেয়েটার প্রাণের আশঙ্কা করলি নে একবারও?
ব্যাপারটা বুঝতে আমার দেরি হল না। সাতকড়ি আরও বলল–কালীনাথ গাঙ্গুলী কি গ্রাম ত্যাগ করেছে সাধে? এইজন্যেই সে বাড়িমুখো হয় না, ওদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখে না।
এত কথা আমি কিন্তু জানতাম না–এই নতুন শুনলাম। আমি মুশকিলে পড়ে গেলাম–আমি এখন কি করি? হিরন্ময়ীর মা আর দিদি দোষী কি দোষী নয়–সে বিচারের ভার আছে অন্য বিচারকের ওপর–সাতকড়ি মুখুয্যের ওপর নয়। কিন্তু এদের মোকদ্দমা উঠলে উকীল নিযুক্ত কে ক’রে, এদের স্বার্থ বা কে দেখে, এদের জন্যে পয়সা খরচই বা কে করে?
এদিকে আর এক মুশকিল। ওর মা আর দিদিকে যখন ধরে নিয়ে গেল, হিরন্ময়ী তখন ওদের বাড়ির সামনে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে। সামনে অন্ধকার রাত, সেরাত্রে সে একাই বা বাড়িতে থাকে কেমন করে, বাড়িতে আর যখন কেউই নেই–অথচ সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউ তাকে নিজের বাড়িতে ডাকলে না। সন্ধ্যার সময় ও-পাড়ার কৈলাস মজুমদারের স্ত্রী এসে ওকে ও-অবস্থায় দেখে বললেন–ওমা, এ মেয়েটা এখানে একা দাঁড়িয়ে আছে যে! ছেলেমানুষ, বাড়িতে একা থাকবেই বা কি করে? ওর মা দিদি কি করেছে জানি নে– কিন্তু ওকে আমি চিনি। ও পাগলী, আনন্দময়ী। এস ত মা হিরণ, তোমাদের হারিকেনটা বাড়ির ভিতর থেকে নিয়ে ঘরে চাবি দিয়ে এস। ওকে জায়গা দিলে যদি জাত না থাকে–তবে না থাকল তেমন জাত!
মজুমদার-গিন্নী যদি কোন কথা না বলে নিঃশব্দে হিরন্ময়ীকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতেন তবে হয়ত কোনই গোলযোগ বাধতো না–কিন্তু শেষের কথাটি বলে ফেলে তিনি নিতান্ত নির্বোধের মত কাজ করে বসলেন। কাছেই গ্রামের সমাজপতি আচার্যি-মশায়ের বাড়ি। তাদের সঙ্গে বাধলো তুমুল ঝগড়া। শশধর আচার্যের স্ত্রী অনেকক্ষণ নিজের মনে একতরফা গেয়ে যাবার পর উপসংহারে বললেন–ও বড় ভাল মেয়ে–না? মুখ খুললেই অনেক কথা বেরিয়ে পড়বে। সব জানি, সব বুঝি। চুপ করে থাকি মুখ বুজে–বলি মাথার ওপর একজন আছেন, তিনিই দেখবেন সব–আমি কেন বলতে যাই?
মজুমদার-গিন্নী বললেন–যা কর ন-বৌ, আবার এ মেয়েটার নামে কেন যা তা বলছ? সেটাই কি ভগবান সইবেন?
আচার্যি-মশায়ের স্ত্রী বারুদের মত জ্বলে উঠলেন–আরও দ্বিগুণ চেঁচিয়ে বললেন–ধর্ম দেখিও না বলে দিচ্ছি, ভাল হবে না। ওই রয়েছে মুখুয্যেরা, ভটচায্যিরা, জিজ্ঞেস কর গিয়ে। ওই মেয়ে ওই পাঠশালার মাস্টার-ছোকরার কাছে রাত বারোটা অবধি কাটিয়ে আসে–রোজ তিনশ তিরিশ দিন। সারারাত্তিরও থাকে এক এক দিন। বলুক ও মেয়েই বলুক, সত্যি না মিথ্যে। ভেবেছিলুম কিছু বলব না–মরুক গে, যার আঁস্তাকুড়, সেই গিয়ে ঘাঁটুক, না বলে পারলাম না। কে ও মেয়েকে ঘরে জায়গা দিয়ে কালকে আবার একটা হাঙ্গামা বাধাতে যাবে?
আমি এতক্ষণ চুপ করে ছিলুম, কথা বলি নি–কোন পুরুষমানুষ উপস্থিত ছিল না বলে। চেঁচামেচি শুনে আচার্য-মশায়, সাতকড়ি ও সনাতন রায় ঘটনাস্থলে এসে দাঁড়াতেই আমি এগিয়ে গিয়ে বললুম–আপনারা আমার মায়ের মত–আপনাদের কাছে একটা অনুরোধ, হিরণকে এ ঝগড়ার মধ্যে মিথ্যে আনবেন না। ও আমার ছাত্রী, ছেলেমানুষ, আমার কাছে যায় সন্ধ্যেবেলা গল্প শুনতে–কোনোদিন পড়েও। রাত নটা বাজতেই চলে আসে। একটা নিষ্পাপ নিরপরাধ মেয়ের নাম এ-সবের সঙ্গে না জড়ানোই ভাল। মা আপনি ওকে বাড়িতে নিয়ে যান।
এতে ফল হ’ল উলটো। ঝগড়া না থেমে বরং বেড়ে উঠল। মজুমদার মশায়ের দুই ছেলে ও ছোট ভাই এসে মজুমদার-গিন্নীকে বকাবকি করতে লাগল–তিনি কেন ওপাড়া থেকে এসে এই-সব ছেঁড়া ল্যাটার মধ্যে নিজেকে জড়াতে যান? এ বয়সেও তাঁর জ্ঞান যদি না হয় তবে আর কবে হবে…তিনি চলে আসুন বাড়ি। এ-পাড়ার ব্যবস্থা এ-পাড়ার লোকে বুঝবে, তিনি কেন মাথাব্যথা করতে যান ইত্যাদি।
যাকে নিয়ে এত গোলমাল, সে ভয়ে ও লজ্জায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েই আছে ওদের বাড়ির সদর দরজায়। ওর চোখে একটা দিশেহারা ভাব, লজ্জার চেয়ে চোখের চাউনিতে ভয়ের চিহ্নই বেশী। ওর সেই কথাটা মনে পড়ল–জানেন মাস্টার মশায়, আমায় সবাই ভয় করে, সবাই মানে এ পাড়ায়–আমার সঙ্গে লাগতে এলে দেখিয়ে দেব না মজা?
বেচারী মুখরা হিরন্ময়ী!
শেষ পর্যন্ত কৈলাস মজুমদারের স্ত্রী ওকে না নিয়েই চলে গেলেন। তাঁর দেওর ও ছেলেরা একরকম জোর করেই তাঁকে সরিয়ে নিয়ে গেল।
আমি তখন এগিয়ে গিয়ে বললুম–হিরণ, তুমি কিছু ভেবো না। আমি এতক্ষণ দেখছিলাম এরা কি করে। যে ভয়ে তোমাকে ডাকতে পারি নি, সে ভয় আমার কেটে গিয়েছে। তুমি একটু একলা থাক–আমি কাওরাপাড়া থেকে মোহিনী কাওরাণীকে ডেকে আনছি। সে তোমার ঘরের বারান্দাতে শোবে রাত্রে। তাহলে তোমার রাত্রে একা থাকবার সমস্যা মিটে গেল। আর এক কথা–তুমি রান্না চড়িয়ে দাও চাল-ডাল সব আছে তো?